অর্ণব মল্লিক, কাপ্তাই
রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবিউর রহমান। ১৯৫৫ সালের ২২মে ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা উপজেলার শিবচরে তিনি জন্মগ্রহণ করলেও তিনি দীর্ঘবছর কাপ্তাইয়ে বসবাস করে আসছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা আবিউর রহমান ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নৌ-কমান্ডো হয়ে অংশ নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ঘটনা জানতে চাইলে তিনি বেশ কিছু ঘটনা এই প্রতিবেদকের নিকট স্মৃতিচারণ করেন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আবিউর রহমান এর বয়স ছিলো মাত্র ১৭ বছর। পিতাকে হারিয়ে তখন অভাবের সংসার চলছিলো। ওইসময় তিনি তাঁর মামার বাড়ি বাড়বকুন্ডে চলে আসেন এবং সেখানে লেখাপড়ার পাশাপাশি একটি কেমিক্যাল কারখানায় চাকরিও করতেন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতার ডাক দেন তখন এই আবিউর রহমান সহ ওই কারখানার শ্রমিক, কর্মচারীরা সকলে ঢাকা চট্টগ্রাম ট্রাঙ্ক রোড অবরোধ করেন। পরবর্তীতে যখন ২৫শে মার্চ পাকিস্তানীরা বাঙালিদের ওপর আক্রমণ শুরু করেন তখন তিনি মামার বাড়িতে গিয়ে দেখেন সবাই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। একা নিরুপায় হয়ে অজানা উদ্দেশ্যে পথচলা শুরু করেন তিনি। পরে সিন্ধান্ত নেন, ভারতে চলে যাবেন। যেইভাবা সেইকাজ। অনেক পথ পাড়ি দিয়ে কুমিল্লার লাকসামে পৌঁছান তিনি। লাকসাম থেকে পাড়ি দেন ভারতের উদ্দেশ্যে। এদিকে ১৯৭১ সালের ২৯ শে মার্চ ভারতের সাতবাড়িয়া বর্ডার পার হওয়ার সময় তিনি ভারতের সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী বিএসএফ নিকট গ্রেফতার হন। পরে বিএসএফ সদস্যরা সবকিছু যাচাই করে আগরতলা রিফিউজি ক্যাম্পে তাঁকে হস্তান্তর করেন। পরে সেখান থেকে আসামে পাঠানো হয় তাঁকে। সেখানে ভারতের কাঁঠালিয়া রিফিউজিকে ক্যাম্পে আসেন এবং সেখানে ২৮ এপ্রিল মো. কাদের নামে এক ভারতীয় অফিসার তাঁকে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তাব প্রদান করেন। তিনি সাথে সাথেই সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিবেন বলে সিন্ধান্ত গ্রহন করেন। এদিকে সেখান থেকে তাঁকে নেওয়া হলো আখাউড়া মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। তিনি সহ সেখানে ৪০ জন অবস্থান করছিলেন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য। সেখানে থেকে তাঁদের কুমিল্লা মতিনগর ক্যাম্পে নিয়ে এসে প্রায় ১ সপ্তাহ গ্রেনেড চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু উনাদের সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে না পাঠিয়ে আবারো ভারতের কাঠালিয়া বড় মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অন্তত ১০ হাজার যুবকদের একসাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ট্রেনিং প্রদান করা হয়। সেইসাথে ভারতের দুর্গম গারো পাহাড়ে নিয়ে গিয়েও সেখানে প্রশিক্ষণে দেওয়া হয়েছিলো। এক পর্যায়ে ভারতীয় সৈন্যরা ওখানে যাচাই করে আবিউর রহমান সহ একটি চৌকশ দলকে বিমানে করে ভারতের মুর্শিদাবাদের ঐতিহাসিক পলাশী তে নিয়ে যায়। সেখানেই সবচেয়ে বেশি সময় ধরে কমান্ডো ট্রেনিং নেন আবিউর রহমান। ওই স্থানে তাঁদের সকলকে কঠোর কমান্ডো ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিলো। বিশেষ করে পানির নিচে থেকে কিভাবে মাইন, গ্রেনেড দিয়ে জাহাজ ধ্বংস করা হবে সেই বিশেষ ট্রেনিংটি সেখানে দেওয়া হয়েছিলো। আবিউর রহমান নৌ কমান্ডো হিসাবে বিশেষ দক্ষতা সেই ট্রেনিং থেকে অর্জন করেছিলেন।
শেষে আসলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। এবার ভারতীয় সৈন্যরা সিন্ধান্ত নিলো আবিউর রহমান সহ তাঁদের অপারেশেন জ্যাকপটের জন্য বাংলাদেশে পাঠানো হবে। ১৯৭১ সালের ১৪ই আগস্ট ভারতের হাসনাবাদ দিয়ে সুন্দরবন হয়ে কুশখালী একটা ক্যাম্পে পৌঁছান তারা। সেখানে সিন্ধান্ত হলো মংলা সমুদ্র বন্দরে থাকা বিদেশী জাহাজ ধ্বংসের মাধ্যমে পাকিস্তানীদের সহযোগী জাহাজগুলো ধ্বংস করা হবে। সেই সিন্ধান্ত অনুয়ায়ী ওই টিমের লেফটেন্যান্ট কর্নেল বদি আলম এর নেতৃত্বে আবিউর রহমানসহ একটি টিম সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তখন উত্তাল সাগরে অনেকটা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা অভিযান শুরু করেন। এবং পরপর বিভিন্ন দেশের ৬টি জাহাজ ধ্বংস করেন তারা। এদিকে সেই খবর ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। এভাবে একের পর এক সফল অভিযান শেষে তারা সুন্দরবন এলাকাতে অবস্থান করছিলো। এদিকে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন ঘোষনার মধ্য দিয়ে শেষ হলো মহান মুক্তিযুদ্ধ। নৌ কমান্ডো বীর মুক্তিযোদ্ধা আবিউর রহমান গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন। বাড়িতে অসুস্থ মা বেঁচে থাকতে দেখে তিনি অনেক আনন্দিত হন কিন্তু এই দুঃসাহসী অভিযানে তিনি বেদনাভরে স্মরণ করেন মহান মুক্তিযুদ্ধে হারানো সেই আপনজনদের।
পরিশেষে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবিউর রহমান জানান, স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও মহান মুক্তিযুদ্ধের এই স্মৃতিকথা এখনো চোখে ভাসে তাঁর। মুক্তিযুদ্ধে এই ঘটনাগুলো তিনি এখনো নৌ-কর্মকর্তা সহ বিভিন্ন জনের নিকট স্মৃতিচারণ করেন। এবং তাঁর একটাই ইচ্ছা যেন দেশের নতুন প্রজন্ম এই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান আজীবন মনে রাখেন। দেশপ্রেমের এই আত্মত্যাগে যেন নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠে তিনি এই প্রত্যাশা করেন।