শাহরিয়ার ইউনুস, খাগড়াছড়ি ॥
খাগড়াছড়িতে কোনভাবেই থামছে না পাহাড় কাটা। জেলাজুড়েই পাহাড়, টিলা কাটার প্রতিযোগিতা চলছে প্রতিনিয়ত। শহর ছাড়িয়ে এখন দুর্গম এলাকায় চলছে পাহাড় কাটার কর্মতৎপরতা। কোথাও দিনে আবার কোথাও রাতে নানা অজুহাতে পাহাড়, টিলা কেটে সমান করা হচ্ছে। এর নেপথ্যে রয়েছে সিন্ডিকেট। অপরদিকে, জেলায় বাড়ছে ইট ভাটার সংখ্যা। জরিপ বলছে, গত দুই বছরে নতুন করে ১০টি ইট ভাটা স্থাপিত হয়েছে জেলায়। নতুন আরোও ইটভাটা স্থাপনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে একটি চক্র। তবে এসব ভাটার কোন বৈধতা নেই। অর্থাৎ আইনের লঙ্ঘন করেই প্রতিনিয়িত জ¦লছে ৪৩ টি ইট ভাটা।
এসব ভাটায় ব্যবহার হচ্ছে পাহাড়, টিলার মাটি ও কৃষি জমির টপসয়েল। জ¦ালানি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে বনের কাঠ। পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে জেনেও প্রশাসন নির্বিকার বলছেন স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ। তাদের অভিযোগ, নির্বিচারে পাহাড় কাটা, বন উজাড়, নদী, খাল, জলাশয় ভরাট হলেও প্রশাসনের কারো কোন তৎপরতা না থাকায় দিনের পর দিন এর বিস্তৃত বাড়ছে। এর জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের গাফিলতিকেও দুষছেন অনেকে।
এমন অবস্থা চলতে থাকলে পাহাড় ও তার প্রকৃতি-পরিবেশ স্বাভাবিক নিয়ম হারিয়ে বিরূপ আচরণ করবে। গত কয়েকদিনের টানা দাবদাহে জনজীবন অতীষ্টের পেছনে পরিবেশ দূষণের ফল হিসেবে দেখছেন স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন ও উন্নয়ন সংস্থার কর্মীরা। জেলা জুড়ে নির্বিচারে পাহাড় কাটা ও বন উজাড়, নদী-ছড়া, খাল, জলাশয় ভরাট হলেও দেখার যেন কেউ নেই। অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলন, জেলা সদর, দীঘিনালা, মাটিরাঙ্গা, গুইমারা, মানিকছড়ির বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ের মাটি কাটাসহ নানা স্বার্থে নির্বিচারে বিলীন করে দিচ্ছে একটি চক্র। বিগত কয়েক বছরের এর মাত্রা বেড়েছে কয়েকগুণ। এসবের জন্য প্রশাসনের উদাসীনতাকে দায়ী করছেন তারা।
সুরক্ষিত খাগড়াছড়ির পরিবেশ ধংসের নেপথ্যে শক্তিশালী সিন্ডিকেকেটের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে স্বোচ্ছার হওয়ার আহবান জানিয়েছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন-এর জেলা শাখার সভাপতি এড. নাসির উদ্দীন।
খাগড়াছড়ির ক্রীড়াবিদ ও সাংবাদিক আজিম উল হক বলেন, গাছ-পালা ও জেলার ছড়া-খাল, জলাশয় বিপন্ন হয়ে গেছে। সুরক্ষিত সুন্দর পরিবেশ হারিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। অল্প বৃষ্টিতে বন্যা হচ্ছে, পানিবন্দি হয়ে পড়ছে জেলা শহরের মানুষ। ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে কৃষক ও ফসলি জমি। প্রকৃতির উপর অন্যায়ের কারনে পাহাড়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। শক্তিশালীদের কালো থাবার কারণে জেলার পরিবেশ দূষণ হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। পাহাড় ও গাছ কাটা রোধে প্রশাসনের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে জেলায় পাহাড় কাটার বিষয়ে উদ্বেগ জানান খাগড়াছড়ি পরিবেশ আন্দোলন সংগঠনের সদস্য ও বেলা’র নেটওয়ার্ক মেম্বার আবু দাউদ। তিনি বলেন, পাহাড় কাটার ব্যাপারে প্রশাসন উদাসীন। একাধিকবার অবহিত করার পরও প্রশাসনের কোন ধরণের তৎপরতা দেখা যায়নি। পাহাড়ের পাহাড়, প্রকৃতি-জীবন, বৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে। ছড়া-নদী, খালকে বাঁচাতে হবে। অন্যথায় এখানকার জীববৈচিত্র্য বিলীন হয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
খাগড়াছড়ি চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক সুদর্শন দত্ত বলেন, জেলায় নদী রক্ষা কমিটি, বন এবং পরিবেশ রক্ষা কমিটি থাকলেও তা কাগজে কলমে। মাঠ পর্যায়ে তাদের কোন তৎপরতা বা ফলোআপ নেই। ফলে শহরের অনেক ছড়া, খাল দখল হয়ে গেছে। শাখা-প্রশাখাগুলো দখল-দূষণে মৃত প্রায়। ভাঙ্গা ব্রীজ ছড়া ও উন্নয়ন বোর্ডের পেছনের ছড়াগুলো ক্ষমতাবানরাই দখল করেছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। সংশ্লিষ্টদের কার্যকারী পদক্ষেপ না নিলে শহর তলিয়ে যাবে অল্প বৃষ্টিতে এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করেন তিনি।
আধুনিককালে যেভাবে পাহাড়ে বন উজাড় হচ্ছে এটি অত্যন্ত ক্ষতিকারক। বন উজাড় বন্ধ করতে হলে মানুষের মানসিকতার উন্নয়ন ঘটাতে হবে বলছেন, স্থানীয় উন্নয়ন কর্মী ও গবেষক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা। ইট ভাটায় বনের কচি গাছ এবং সবধরণের কাঠই পোড়ানো হচ্ছে। যদিওবা ভাটাগুলোতে জ¦ালানি কাঠ পোড়ানোর কোন বিধান নেই। তারপরও আইনের লঙ্ঘন করে জ¦ালানো হচ্ছে। এতে পরিবেশেরও ক্ষতি হচ্ছে। পাহাড় কেটে মাটিও ব্যবহার করা হচ্ছে ভাটায়। আইন সম্মতভাবে ইট ভাটাগুলো পরিচালিত হলে জেলায় পাহাড় কাটা ও বন উজাড় কিছুটা হলেও কমবে। এছাড়াও সামাজিকভাবে গাছ লাগানোর তাগাদা দেন উন্নয়ন কর্মী মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা।
সুজন-এর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও প্রকৌশলী নির্মল দাশ বলেন, পাহাড়ের বিরূপ পরিবেশের জন্য ইট ভাটা, গাছ ও পাহাড় কাটাকে দায়ী করেছেন। সরকারিভাবে অবৈধ ইট ভাটা বন্ধের নির্দেশনা থাকলেও খাগড়াছড়িতে তা পালন হচ্ছেনা। যার কারনে পাহাড়ের মাটি, বনের জ¦ালানি কাঠ ব্যবহারেও কোন বাধা নেই। প্রশাসনের অবহেলাই সাধারণ মানুষকে উৎসাহিত করছে। পরিবেশের যারা ক্ষতি করছেন, দূষণ করছেন তাদের প্রতিরোধে সাধারণ মানুষ প্রশাসনের সাথে রয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। নদী, ছড়া-খাল দখলমুক্ত করা না গেলে পর্যটনবান্ধব খাগড়াছড়ি তার চিরচেনা রুপ হারাবে।
সুজন’র জেলা শাখার সভাপতি এডভোকেট নাসির উদ্দীন উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, পাহাড় হবে সমস্ত প্রাণীন অভয় আরণ্য। কিন্তু এখন আর সেটি নেই। যে হারে পাহাড়ের বুকে অত্যাচার-নির্যাতন চলছে তাতে বন্য প্রাণী বাদ সাধারণ মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে ওঠছে। প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগের অভাবকে দায়ী করে তিনি বলেন, পরিবেশ রক্ষার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচিতে এসে জানান দিতে হবে আমাদের জীবন কতো বিপন্ন। একটি বিশুদ্ধ শহর গড়ে তোলার জন্য আইনে যা বলা আছে তা খাগড়াছড়িতে নেই। একটি প্রকৃত শহরের জন্য নদী-ছড়া, খাল এবং জলাশয় থাকা দরকার। কিন্তু এসব এখন নেই। সব দখল দূষণে ভরে গেছে। ৮০’র দশকের গোড়াপত্তনের খাগড়াছড়ি শহর চোখের সামনে তার রূপ হারিয়েছে। কিছু লোক সব গিলে খাচ্ছে। এরজন্য প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের গাফিলতিকে দুষছেন তিনি। প্রকল্পও নেয়া হয় সিন্ডিকেটদের জন্য। সুন্দর পরিবেশে যাতে পাহাড়ের মানুষ বেঁচে থাকে সেজন্য অতিদ্রুত মাস্টার প্লান করে দখল হওয়া নদী-ছড়া, খাল, পুকুর উদ্ধার ও নির্বিচারে পাহাড় কাটা ও বন উজাড় বন্ধের দাবি জানান তিনি।
খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান বলেন, পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে প্রশাসন তৎপর। ইতিমধ্যে অভিযান করে জরিমানা ও মামলা দায়ের করা হয়েছে। ইট ভাটায় বেআইনি কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে প্রশাসন সজাগ রয়েছে। সচেতন করা হচ্ছে ভাটা মালিকদের। দখলের কোন অভিযোগ পেলে প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে বলেও জানান ডিসি।
তবে প্রশাসনের কাছে বৈধ কোন ইট ভাটার তালিকা নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিসি বলেন, জেলা প্রশাসন থেকে কোন ইট ভাটার অনুমোদন দেয়া হয়নি।