বাবা হারানো ক্লাবে আমি এক নতুন সদস্য। সমাজে বাবা মারা গেলে ছেলে সন্তানরা মাথা নেড়া করেন। সন্তানরা শ্রমণ বা ভিক্ষু জীবন গ্রহণ করেন। জীবনে বেশ কয়েক বার রং কাপড় নেওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে। বাবার সাথেও একবার সিঙ্গিনালায় গিয়ে শ্রমণ/ভিক্ষু জীবন গ্রহণ করেছি। বাবার সাথে মজার সম্পর্ক বলে, গুরু ভিক্ষুকে একবার খুব করে ধরেছিলাম বাবার আগে রং কাপড় পরিয়ে দিতে। হেডম্যান পাড়ার ‘বুয়া চেড়া’ রাজি হননি। শ্রমণ বা ভিক্ষু হতে, আমাদেরকে সিঙ্গিনালা নয়তো উহ্লা প্রু টিলায় যেতে হতো। বাকি সময়টুকু আমরা গ্রামের বিহারে কাটিয়ে দিতাম। সে সময়ে বিহারকে ঘিরে ফলমূলের গাছের কোন অভাব ছিল না। লোভ সামলানো কঠিনই ছিল।
এবার নিজ গ্রামের বিহারে শ্রমণ জীবন নিয়েছি। বাবা মৃত্যুর দুদিন পরে আবার ভিক্ষু জীবন নিয়ে সাপ্তাহিক ক্রিয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত কাটিয়েছি। শ্রমণ আর ভিক্ষু জীবন নিয়ে সপ্তাহ ১০দিন থাকার সুযোগ পেলে ও গ্রামবাসীর সামনে কিছু বলার সুযোগ হয়নি। মনে মনে কত কথা বলতে চেয়েছিলাম, বলার সুযোগ পাইনি।.
তবে বিহারে থাকা কম বয়সী ছোট ছোট শ্রমণদের সাথে মজার সম্পর্ক স্থাপন করেছি। সকল শ্রমণের সাথে সম্পর্কে আফু হয়েছি [আমরা একে অপরকে আফু সম্বোধন করে বলতাম]। ছোট ছোট শ্রমণেরা সময় হলে নিজেরা পড়তে বসে। দুপুর বেলায় লম্বা সময় পর্যন্ত বিশ্রাম নেয়। তাদের দুপুরের ঘুম দেখলে, যাদের নানা কারনে ঘুম একটু পাতলা হয়, তাদের এক প্রকার হিংসাই হবে। তাদের মধ্যে থেকে যার বয়স অন্যদের তুলনায় বড়, সে শ্রমণই প্রতিদিন আমায় লম্বা সময় নিয়ে বুদ্ধ বন্দনা আর পিন্ড খাওয়ার আগের প্রার্থনা করতে সহায়তা করেছে।
বিহারাধ্যক্ষ প্রায় প্রতিদিনই নানা গ্রামে নিমন্ত্রণে অংশ নিতে ব্যস্ত থাকতেন বলে, খুব কম সময়ই তাঁকে পেয়েছি। বয়সে কম হলেও ভিক্ষুটি ইতিমধ্যে এলাকায় নাম কুঁড়িয়েছেন। বিহারাধ্যক্ষের অনুপস্থিতির সুযোগে দুপুরের পিন্ড খাওয়ার সময় এক সাথে একই মর্যাদায় খাওয়ার সুযোগ দিয়েছি। মজার খাবার পেলে তাদের দিয়ে দিয়েছি। রাতে বসে মহাভারতের গল্প শুনানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু বিহারে সব সময় মানুষের ভিড় লেগে থাকতো বেল, তেমন জমাতে পারিনি।
মহাভারত কোন প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছিল, কাদের দ্বারা রচিত হয়েছিল, তার পটভূমি বলার চেষ্টা করেছি। তারা অন্তত জেনেছে বেদব্যাস গণেশ, সৌতি, সাত অমর ছাড়াও যযাতি, শ্রক্রাচার্য, দেবযানী ও কচের ন্যায় কিছু চরিত্রের। বড় হয়ে পড়তে গিয়ে তাদের চরিত্রগুলোর কথা মনে করে দিবে বলে বিশ্বাস।
অফুরন্ত অবসরে, একদিন বিকেল বেলায় পাড়ার স্কুল কলেজ ছেলেমেয়েদের ডেকে, তাদের স্বপ্ন, ইচ্ছাগুলো শুনার চেষ্টা করেছি। ১৮জন শিশু কিশোরদের ইচ্ছাগুলো আগ্রহ নিয়ে শুনেছি। গ্রামের শিশুরা কেউ ব্যাংকার হতে চায়। কেউ হতে চায় ডাক্তার। কেউ বা ইঞ্জিনিয়ার। আবার ইঞ্জিনিয়ার হতে না পারলে ৪জন হতে চায় পুলিশ । দুইজন হতে চায় শিল্পী। তাদের একজন হতে চায় আর্মি। ৫জন বাইক চালিয়ে ঘুরে বেড়াতে চায়। শুধু দেশে নয় নানা দেশ ঘুরে দেখতে চায়। উসাচিং(১৪), হতে চায় বিসিএস কর্মকর্তা। সে বিমান চড়ে বিদেশ ঘুরতে চায়। সে মাউন্ট এভারেস্ট জয় করতে চায়। একই সাথে গানও শিখতে চায়। শিশুদের নিয়ে বসে গল্প করার এমনি এক চিন্তা ঘুরপাক করছিল। উসাচিংকে কাছে পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ”কি হতে চাও?” সে সময়েও সে একই কথাই বলেছিল। মাউন্ট এভারেস্ট নিয়ে তার টুকটাক ধারণা আছে। সে ঠান্ডায় কষ্ট স্বীকার করতে প্রস্তুত। ছাত্রী ক্রানুচিং, ডাক্তার হতে চেষ্টা করবে। তার স্বপ্ন, স্কলারশীপ নিয়ে বিদেশে পড়ালেখা করার। উক্যচিং (১৪),এর স্বপ্ন আছে, সে গান রচনা করবে। উসানু মনে করে, কমার্স ছাত্রদের জন্য এলাকায় কোচিং সুবিধাদি নেই। তাই বড় হয়ে সে এলাকায় কমার্স ছাত্রদের জন্য কোচিং এর সুবিধাদি দিতে কাজ করবে। উসাই (১৫), এর প্রথম পছন্দই শিল্পী হওয়ার। বাইকে চড়ে ভ্রমণ করা তার খুব শখ। গ্রামের জন্য একটা ক্লাব স্থাপন করতে চায়। খেলাধুলার সুবিধাদি দিতে তৈরি করে দিতে চায়, একটা সুন্দর মাঠ। চিংথোয়াই (১৬), বড় হলে গ্রামের ছেলেদের নিয়ে একটি ফুটবল টিম গঠন করতে চায়।
তাদের সকলের ইচ্ছা, শখ, স্বপ্ন শোনার পর বললাম, “তোমাদের সবার স্বপ্ন পূরণযোগ্য। বিমল মুখার্জি [১৯২১-২৬ সাইকেলে চড়ে ভারত দেখা শেষ করে , ১৯২৬-পৃথিবী ঘুরতে বেরিয়েছিলেন, ফিরে আসেন ১৯৩৭ সালে] যদি দু চাকার সাইকেল নিয়ে বিশ্ব ভ্রমণ করতে পারেন, তোমরা বাইক দিয়ে কেন নয়? বাইক চালিয়ে ঘুরে বেড়ানো আরো সহজ এবং সোজা হওয়ার কথা। বিশ্ব ভ্রমণ করতে চাইলে বিশ্ব নাগরিক হতে হবে। ধৈর্য্য, কষ্ট, পরিশ্রম করার ইচ্ছা শক্তি থাকতে হবে। সকল ধরনের কাজ করার আগ্রহ থাকতে হবে। বিমল মুখার্জি দু চাকায় বিশ্ব ভ্রমণ করতে গিয়ে স্কটল্যান্ডের জাহাজে আইসল্যান্ড অঞ্চলে মাছ ধরার চাকরি নিয়েছিলেন। আর্কটিক সমুদ্রে আইসল্যান্ড ট্রলার চালিয়ে মাছ ধরা সহজ কাজ নয়। এককথায় কঠিন জীবন। কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারলেই কেবল জীবনে মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের দেখার সুযোগ মেলে। যেমন, বিমল ট্রলারে মাছ ধরতে গিয়ে আলবাট্রস্ বার্ড কিভাবে মাছ ধরে তা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন-সেই সময়ে। তিনি একই সাথে হক নামে আরেক ধরনের পাখি দেখতে পেয়েছিলেন। যে পাখিদের কাজ হলো মাছ খেয়েছে পাখিটিকে ধাওয়া করতে করতে পাখিটি এক সময় ক্লান্ত হয়ে বমি করে দিলে, সেই বমি করে ফেলে দেওয়া মাছকে খাওয়া। আর আমরা এখন যুদ্ধের কারণে ইউক্রেন দেশকে চিনি। কিন্তু বিমল ইউক্রেন সমতল দেশ বলে সেই সময়ে দেশ সম্পর্কে লিখতে গিয়েছেন”
ছেলেবেলায় আমাদের নিয়ে গল্প করার, স্বপ্ন দেখানোর কাউকে পাইনি। কোন শিক্ষক একটি ভালো বই পড়তে উৎসাহ যোগাননি। কলেজে গিয়েও একজন শিক্ষককেও পাইনি, যিনি আমাদের স্বপ্ন শুনার কিংবা স্বপ্ন দেখানোর চেষ্টা করেছেন। উল্টো সে সময়ে আমি আজকের সূর্যোদয়ে লিখতাম বলে ক্লাশে লজ্জা দিয়েছিলেন। আবার একটি পত্রিকায় আমার লেখা প্রকাশিত হয়েছিল বলে, সে সময়ে স্থানীয় এক সাংবাদিক তাকে না জানিয়ে তার পত্রিকায় কেন লিখেছি সে অপরাধে ৩০০টাকা দাবি করেছিলেন। অপরাধ হয়েছে ভেবে নিয়ে ৩০০ টাকা কিভাবে দিবো সে চিন্তায় কত রাত আমার ঘুম নষ্ট হয়েছিল, সে সাংবাদিক হয়তো মনেও রাখেননি।
শিশুদের শুধু শেখানো নয়, তাদের থেকেও শেখার আছে। আমিও স্বপ্ন দেখি, আমার গ্রামের ছেলেমেয়েরা একদিন বিসিএস কর্মকর্তা হবে, ডাক্তার হবে, আর্মি অফিসার হবে, পুলিশ হবে, তারা বাইকে চড়ে সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়াবে। আমাদের মহালছড়ির পতাকা মাউন্টএভারেস্ট এ নিয়ে যাবে।
তাদের এই স্বপ্নপূরণে এলাকার স্কুল কলেজ শিক্ষকদের ও স্বপ্ন দেখার, স্বপ্ন দেখানোর ইচ্ছাশক্তি থাকা চাই। স্কুল-কলেজের শিক্ষকরাই পারেন তাদের মাউন্টএভারেস্ট এ পৌঁছে দিতে। এই ক্ষেত্রে কলেজ শিক্ষকরা যদি নিত্যদিন “রাম জাদিতে” গিয়ে স্বপ্ন বুনেন কিংবা শিক্ষকরা যদি নিজের ছেলেমেয়েদেরকে ভালো ভালো স্কুল কলেজে পড়ার সুযোগ করে দিতে দূরে পাঠিয়ে এলাকায় শিক্ষকতা করেন, আমার গ্রামের শিশুদের স্বপ্নপূরণে অন্তরায় হিসেবে কাজ করবে।
আমি আমার গ্রামের ছেলেমেয়েদের নিয়ে দারুণ আশাবাদী। দুই চাকায় বিশ্বভ্রমণকারী বিমল মুখার্জি ও রামনাথ বিশ্বাস [তিনবার সাইকেলে চড়ে ১৯৩১-১৯৪০ পর্যন্ত চারটি মহাদেশ ভ্রমণ করেছিলেন]রা পারলে আমার গ্রামের কিশোররা কেন নয়? তাই সুযোগ পেলে এলাকার স্কুল শিক্ষক বন্ধুদের শিক্ষকতায় মনোনিবেশ করতে নানা ভাবে উদ্বুদ্ধ করি। অনুপ্রাণিত করতে, উদাহরণ হিসেবে আমার বাবার কথাও বলি। একজন স্কুল শিক্ষকও অনেক সম্মানের পাত্র হতে পারেন। আমার বাবা তার একটি ছোট উদাহরণ।
ঞ্যোহ্লা মং, কলাম লেখক। ইমেইল: nyohlamong2@gmail.com