পূব আকাশে সূর্য তখনো তার আভা বিলানো শুরু করেনি। আড়মোড়া ভেঙে সবে বিদায় নিতে শুরু করেছে কুয়াশারা। শীতল বাতাস কাপ্তাই হ্রদের স্বচ্ছ জল ছুঁয়ে উঠে আসছে হ্রদের কোল ঘেঁষে দাড়িয়ে থাকা রাঙামাটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। এরমধ্যেই অভিভাবকদের হাত ধরে শহীদ মিনারের দিকে আসছিলো শিশু কিশোররা। আজ তাদের লেখা ও আঁকার দিন।
গত ২১ বছর ধরে একুশের সকালে বর্ণলিখন-চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা আয়োজন করে আসছে রাঙামাটির প্রথিতযশা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গ্লোবাল ভিলেজ । প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি সকালবেলা রাঙামাটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতায় রাঙামাটির বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্র্থীরা অংশ নেয়। রংতুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলে বাহান্নর ভাষা আন্দোলন অথবা প্রাণের শহীদ মিনারকে।
শিশুশ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী অবধি শিক্ষার্থীরা যে যার মত করেই এঁকেছেন,কেউবা শহীদ মিনার,কেউ কেউ প্রভাতফেরি,কেউবা ভাষা শহীদদের মুখায়ব এঁকেছে ভালোবাসায়,শ্রদ্ধায়। র্শিশু শিক্ষার্থী বাংলা বর্ণমালার স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ লিখেছে নিজ হাতে।
পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন অতিথি ও আয়োজকরা। অতিথি ছিলেন জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মোঃ ওমর ফারুক, সাধারন সম্পাদক ললিত সি চাকমা, সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন’র জেলা সেক্রেটারি জিসান বখতেয়ার,কবি ও লেখক মলয় ত্রিপুরা কিশোর, তরুণ সংগঠক ডা: নিশু সাহা,দৈনিক পার্বত্য চট্টগ্রামের বার্তা সম্পাদক শংকর হোড়,স্কুলবেলার সম্পাদক জসীমউদ্দীন, গ্লোবাল ভিলেজ’র পরিচালক হেফাজত সবুজ ও ফিরোজ আল মাহমুদ,পার্বত্য চট্টগ্রাম ডিবেট ফেডারেশন’র সংগঠক রায়হান সাঈদ,শুভসংঘ’র সংগঠক বাবলু আহমেদ, আবৃত্তি সংগঠন আফ্রোদিতি’র সংগঠক সাইফুল হাসান,চারুশিল্পী ও বিচারক রেজাউল করিম রেজা,মোঃ ইব্রাহীম।
স্কুলবেলার সম্পাদক জসীমউদ্দীন বলেন, ২০০৪ সালে যখন এই আয়োজনটি আমরা শুরু করি,তখনো ভাবনাতেই ছিলো না,এই আয়োজনটি এত দীর্ঘ সময় ধরে টেনে নিয়ে যাবো বা যেতে পারব। আজ যখন পেছন ফিরে দেখি, নিজেরাই ভীষণ আপ্লুত হই। পাহাড়ের প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় আমরা গ্লোবাল ভিলেজ রাঙামাটি প্রতিষ্ঠা করেছিলাম ২০০২ সালে আর স্কুলবেলার প্রকাশনা শুরু করি,২০০৩ সালে। এর একবছর পর থেকে আমাদের এই আয়োজনটি,যা এখন পুরো রাঙামাটির একুশের আয়োজনের অংশ হয়ে গেছে।
গ্লোবাল ভিলেজ রাঙামাটির পরিচালক হেফাজত সবুজ জানাচ্ছেন, এই আয়োজনটাকে এখন আর আমরা নিজেদের আয়োজন মনে করিনা। আমরা এটাকে রাঙামাটির একুশের অপরিহার্য অংশ হয়ে গেছে। আমরা শুধু আয়োজনের দায়িত্বই পালন করছি। কোনপ্রকার প্রচার প্রচারণা ছাড়াই,শুধুমাত্র প্রোগ্রামের দিনকয়েক আগে ফেসবুকে একটি কাভার ফটো পোস্ট করে আমরা এই আয়োজনটির কথা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেই। আমাদের শহরের অভিভাবক,শিক্ষার্থীরা সকলেই জানে যে, একুশের সকালে এই আয়োজনটি হবেই।’
অনুষ্ঠানের আয়োজক গ্লোবাল ভিলেজের নির্বাহী পরিচালক ফজলে এলাহী বলেন, ২০০৪ সালে রাঙামাটির শিশু কিশোরদের সৃষ্টিশীলতা বিকাশের জন্য আমাদের স্কুলবেলা পত্রিকার মধ্য দিয়ে এই প্রতিযোগিতা শুরু করি। গত ২১ বছর ধরে আমরা এই প্রতিযোগিতাটি আয়োজন করে আসছি। আমরা এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য কোন বিদ্যালয়ে কোনপ্রকার নোটিশ পাঠাই না। স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং চিত্রাংকনের বিষয় জানিয়ে শুধুমাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা প্রচার করে থাকি। আমরা চেষ্টা করি অংশগ্রহণকারীদের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যাক বাচ্চাদের পুরস্কৃত করতে।
প্রতিযোগিতার বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন রাঙামাটি চারুশিল্পী পরিষদের সভাপতি এবং বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী রেজাউল করিম রেজা ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ ইব্রাহিম। তারা আয়োজকদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, রাঙামাটিতে এখন শিশু-কিশোরদের মধ্যে শিল্পচর্চার অভ্যেস অনেকটাই কমে গিয়েছে। এই প্রতিযোগিতা তাদের মধ্যে সৃষ্টিশীলতার বিকাশ ঘটাতে ভ‚মিকা রাখবে।
প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী মুনতাহা আজীজ বলেন, আমি গত পাঁচ বছর যাবৎ এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছি। আমরা যারা চিত্রাংকন করি তারা সারাবছর অপেক্ষা করে থাকি আজকের দিনটির জন্য। এখানে অংশগ্রহণ করতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত।
আরেক ক্ষুদে অংশগ্রহণকারি তখন একমনে শহীদ মিনারের মাঝের সূর্যটিকে লাল রঙে রাঙাচ্ছিল। কাছে গিয়ে কেমন লাগছে জানতে চাওয়াতে লাজুক হেসে বললো, খুব ভালো লাগছে।
গ্লোবাল ভিলেজের পরিচালক জসিম উদ্দিন বলেন, প্রতিযোগিতাটি আয়োজন করতে আমাদের অনেক বাঁধা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। সময়ের সাথে সাথে আমরা সকল বাঁধাকে জয় করে এখনো আয়োজন করে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে আমরা যদি নাও থাকি তবুও এই অনুষ্ঠান চলমান থাকবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ডিবেট ফাউন্ডেশনের সংগঠক রায়হান সাঈদ প্রতিযোগিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, শিশু-কিশোরদের সুন্দর মেধা ও মননের বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই ধরণের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। আমি বিশ্বাস করি যে একুশের এই চেতনা যদি আমরা সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিতে পারি তবে অসাম্প্রদায়িক যে বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখি তা বাস্তবে রুপ দেয়া সম্ভব হবে।
অতিথিরা তাদের বক্তব্যে, সৃজনশীল এমন আয়োজনের ধারাবাহিকতায় বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, টানা একুশ বছর ধরে একুশের এমন আয়োজনকে ছোট করে দেখার কোন সুযোগ নেই। এটি একটি বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা জাগানো উদ্যোগ। আমরা প্রত্যাশা করি,বহুবছর ধরেই এই আয়োজনটি চলবে,এই পার্বত্য জনপদে।