অর্ণব মল্লিক, কাপ্তাই ॥
রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনায় অবস্থিত ৯০ দশকের আলোড়ন সৃষ্টি করা চান্দিমা সিনেমা হল। যেই সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে ভিড় জমতো কাপ্তাই, রাঙ্গুনিয়াসহ আশপাশের বিভিন্ন উপজেলার হাজারো বিনোদনপ্রেমী মানুষের। কালের বিবর্তনে সেই ৯০ দশকের সিনেমাহলটি বর্তমানে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি সিনেমাহলটিতে গিয়ে দেখা যায়, পুরো সিনেমাহল এলাকাজুড়ে ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। চারিদিকে জঙ্গলে আচ্ছাদিত করে ফেলেছে সিনেমা হলটিকে। অথচ গত ২৫ বছর পূর্বেও এই সিনেমাহলের সামনে টিকিট কিনতে ভিড় জমে যেতো মানুষের। অনেক সময় মানুষের চাপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা লাগতো। সেই সোনালী দিন এখন কেবলই স্বপ্ন। কেননা বর্তমানে হাজারো মানুষের আবেগ, বিনোদনের খোরাক মেটানো সিনেমাহলটি নীরবতার কান্নায় দিনাতিপাত করছে।
সিনেমাহলটির পাশের এলাকায় বসবাসকারি সুমি আক্তার, আব্দুর রহমান সহ স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা সিনেমাহলটির স্মৃতিচারণ করে বলেন, সেই ১৯৯১ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে চন্দ্রঘোনা কেপিএমের আওতাধীন চান্দিমা সিনেমা হল। পরে অবশ্য কিছুটা মেরামত করে শুরু করলেও বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি সিনেমা হলটি। নানা লোকসানে বন্ধ হয়ে যায় ঐতিহ্যবাহী এই চান্দিমা সিনেমা হল। তবে সিনেমাহলটির বর্তমান অবস্থা বলতে গিয়ে তারা অনেকটা হতাশ হয়ে পড়েন। বর্তমানে সিনেমাহলটিতে জনমানবহীন এক ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার ফলে রাত বিরাতে এখন এই সিনেমাহলের পরিত্যক্ত ভবনে বসে মাদকসেবীদের আড্ডা। বিভিন্ন প্রকার মাদক এবং অনৈতিক কর্মকান্ড সংঘঠিত হয় এই সিনেমাহলের পরিত্যক্ত ভবনে। যা দিন দিন যুব সমাজকে ধ্বংস করে ফেলছে। তাই তারা চান্দিমা সিনেমা হলটির এই পরিত্যক্ত ভবনটি রক্ষায় কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান।
এদিকে কাপ্তাইয়ের কেবল চান্দিমা সিনেমাহল নয়, একে একে আকাশ সংস্কৃতির দৌরাত্ম্য আর দর্শকের অভাবে গত ২০ বছরে বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় ৭টি সিনেমা হল। তারমধ্যে প্রথম কাপ্তাইয়ের বিনোদন অঙ্গনে ধস নামে ১৯৮৮ সালে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিচালনাধীন অলিম্পিয়া সিনেমা হল বন্ধের মাধ্যমে। পরবর্তীতে ২০০৩ সালে বন্ধ হয় চন্দ্রঘোনার সাড়া জাগানো চান্দিমা সিনেমাহল। এরপর একে একে বনলতা সিনেমাহল, শান্ত সিনেমা হল, বজ্রঙ্গনাসহ সবকটি সিনেমাহল বন্ধ হয়ে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। পরবর্তীতে দীর্ঘ অনেক বছর অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত এসব সিনেমা হল চালানোর আর কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
এবিষয়ে কাপ্তাই শিল্পকলা একাডেমির প্রবীণ নাট্য ব্যক্তিত্ব ও অভিনেতা এম ইসমাইল ফরিদ জানান, এভাবে কাপ্তাইয়ের স্মৃতি বিজড়িত সবকটি সিনেমাহল বন্ধ হয়ে যাওয়া, আসলেই বিষয়টি দুঃখজনক। পরিবার পরিজন নিয়ে বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিলো এই সিনেমাহলগুলো। বর্তমানেও যদি কাপ্তাইয়ে সিনেমাহল গুলো বিনির্মাণে ভূমিকা রাখা হয়, তবে এখনো বিনোদন প্রেমীদের সাড়া পাওয়া সম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন ।
কাপ্তাইয়ের আরেকজন গুণী নাট্যজন ব্যক্তিত্ব মো. আনিসুর রহমান বলেন, একসময় এই সিনেমা হলগুলোতে পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব নিয়ে সবাই একত্রিত হয়ে আসতো সিনেমা দেখতে। একসাথে সকলেই হারানো দিনের সিনেমাগুলো উপভোগ করতো। বিনোদনের জন্য সময়টি ছিলো স্মরণীয়। তবে এখন আর সেই আনন্দ নেই। বিশেষ করে তিনি বলেন, কাপ্তাই চন্দ্রঘোনায় ঐতিহ্যবাহী চান্দিমা সিনেমাহলটি অনেক স্মৃতি বিজড়িত। যেই সিনেমাহলে ৯০ দশকের মানুষের রয়েছে অনেক স্মৃতি। তবে বর্তমানে টেলিভিশন কিংবা মোবাইলে সিনেমা দেখলেও সেই আনন্দটি আর নেই বললেই চলে। এছাড়া তিনিও আশা ব্যক্ত করে বলেন, বর্তমান তরুন প্রজন্মের মধ্যে এখনো সিনেমাহলে গিয়ে সিনেমা দেখার প্রতি অনেকটা ভালোলাগা ও আগ্রহ রয়েছে। তারই প্রেক্ষিতে কাপ্তাইয়ে যদি আবারো এই সিনেমাহল গুলোর যাত্রা শুরু করানো যায়, তবে সেই পুরনো ঐতিহ্য আবার ফিরে আসবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।