অর্ণব মল্লিক, কাপ্তাই ॥
প্রায় ১৫ থেকে ২০ বছর পূর্বেও শীতকাল আসলেই রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার বিভিন্ন গ্রামীণ পাহাড়ী অঞ্চলে চোখে পড়ত রসের হাড়ি ও খেজুর গাছ কাটার সরঞ্জাম সহ গাছির ব্যস্ততার দৃশ্য। ভোর হলেই খেজুরের রস নিয়ে গাছিরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে হাকডাক দিতেন। শীতের মৌসুম শুরু হতেই বাড়ি বাড়ি চলতো খেজুরের রস কিংবা রসের পাঠালি গুড় দিয়ে বিভিন্ন মজাদার পিঠাপুলির আয়োজন। তবে কালের বিবর্তনে কাপ্তাই উপজেলা বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে এখন আর সেই দৃশ্য তেমন চোখে পড়ে না। অনেকটা আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারাতে বসেছে গ্রামীণ সেই ঐতিহ্য। বিশেষ করে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করতে গিয়ে খেজুর গাছ নিধন কিংবা জরাজীর্ণ হওয়ায় ঝড়, তুফানে খেজুর গাছ ভেঙে পড়ে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
তবে বর্তমানে উপজেলার ওয়াগ্গা, চন্দ্রঘোনা, চিৎমরম, কাপ্তাই ও রাইখালী ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম্য এলাকায় কিছুসংখ্যক খেজুর গাছ ঠিকে রয়েছে। সেই গাছগুলোতে এখন গাছিরা শীত মৌসুম পুরোপুরি আগমনের পূর্বেই রস সংগ্রহের জন্য আগাম প্রস্তুতি নিতে দেখা গেছে।
প্রায় দীর্ঘ বেশ কয়েকবছর ধরে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে আসছেন কাপ্তাইয়ের ওয়াগ্গা ইউনিয়নের বাসিন্দা গাছি খোকন চন্দ্র নাথ। তার সাথে কথা হলে তিনি জানান, একসময় কাপ্তাই উপজেলায় ১০০টির ও বেশি খেজুর গাছ ছিল। যেই গাছগুলো পরিচর্যা করতে তিনি ব্যস্ত সময় পার করতেন। এবং তখন খেজুরের রসের এতই চাহিদা ছিল যে তিনি সংগ্রহ করতে হিমশিম খেতেন। কিন্তু বর্তমানে গাছগুলো জরাজীর্ণ হওয়ায় ঝড়-তুফানে অনেক গাছ মরে গেছে। এছাড়া বিভিন্ন দালান কৌঠা নির্মাণ ও সড়কের উন্নয়ন কাজ সহ বিভিন্ন কারণেও অনেক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। বর্তমানে কাপ্তাই উপজেলায় সব মিলিয়ে ৪০ থেকে ৫০টির মতো গাছ টিকে আছে। যেগুলোর মধ্যে কয়েকটি গাছের তিনি পরিচর্যা করেন এবং সামনে রস সংগ্রহ করবেন বলে আশা করছেন। এছাড়া কালের বির্বতনে অনেক গাছি এই পেশা থেকে দুরে চলে এসেছেন। তাছাড়া বর্তমানে নতুনভাবে আর কাউকে খেজুর গাছ লাগাতে দেখা যায়না। তাই খেজুরের রসের এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে বেশি বেশি করে খেজুর গাছ লাগানোর পরামর্শ দেন তিনি।
কী উপায়ে খেজুর রস গাছ থেকে সংগ্রহ করেন এবিষয়ে জানতে চাইলে গাছি খোকন চন্দ্র নাথ জানান, এক মাস আগ থেকেই ডালপালা কেটে রস সংগ্রহে জন্য গাছকে উপযোগী করা হয়। এবং গাছের বুকের শুকনা অংশ কেটে রস বের করার জন্য গাছের কিছু অংশ পরিস্কার করা হয়। এছাড়া গাছ কেটে বাঁশের নাট ও খিল লাগানোর ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। এছাড়া এক মাস পর অর্থাৎ শীত আগমনের অগ্রহায়ণ মাসের শেষের দিকে খেজুর রস সংগ্রহ করা হবে। তিনি ইতিমধ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন বলে জানান।
কাপ্তাইয়ের স্থানীয় বাসিন্দা মোঃ কবির হোসেন, সুমন পাটোয়ারি সহ কয়েকজন বলেন, একসময় শীতের সকালে খেজুর রস নিয়ে আসতো গাছিরা। তখন আমরা খেজুরের রস কিনে পরিবার নিয়ে বিভিন্ন পিঠাপুলির আয়োজন করে খেতাম। কিন্তু বর্তমানে খেজুরের রসের চাহিদা থাকলেও তেমন একটা খুঁজে পাওয়া যায়না। অন্যদিকে এখন ভোর বেলায় গাছিদের খেজুরের রস বিক্রয় করতে দেখাও যায়না। কালের বিবর্তনে এই ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে কাপ্তাই উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মোঃ ইমরান আহমেদ জানান, খেজুর গাছ ও খেজুর রস আমাদের গ্রাম বাংলার অন্যতম ঐতিহ্য। বিশেষ করে শীতের মৌসুমে খেজুর এর রস এর চাহিদাও অনেক বৃদ্ধি পায়। তাই বেশি বেশি করে খেজুর গাছের চারা লাগানোর উদ্যোগ নিতে হবে। গ্রাম বাংলার এই ঐতিহ্য আবার ফিরিয়ে আনতে হবে।