মিশু মল্লিক ॥
দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ কাপ্তাই হ্রদ অস্বাভাবিকভাবে শুকিয়ে গেছে। হ্রদের পানি শুকিয়ে নানা স্থানে ভেসে উঠেছে চর। ফলে একদিকে যেমন হ্রদের পানির উপর নির্ভরশীল নৌ-যোগাযোগ ব্যহত হচ্ছে, ক্ষতি হচ্ছে নৌ-কেন্দ্রীক ব্যবসা-বাণিজ্যের, অন্যদিকে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন নেমেছে সর্বনিন্ম পর্যায়ে। পাশাপাশি প্রভাব পড়েছে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসা-বাণিজ্যের উপরও।
রাঙামাটির দশটি উপজেলার মধ্যে প্রায় ৭টি উপজেলারই যোগাযোগের মাধ্যম নৌ-পথ। কিছু উপজেলায় নৌ-পথের পাশাপাশি সড়ক যোগাযোগের ব্যবস্থা থাকলেও জুরাছড়ি. বিলাইছড়ি ও বরকল উপজেলায় যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌ-পথ। হ্রদের পানি অতিরিক্ত পরিমাণ কমে যাওয়াতে এসব উপজেলায় এখন জেলা সদর থেকে কোন লঞ্চ যাতায়ত করছে না। ছোট ডিঙি নৌকা অথবা স্পিডবোটের মাধ্যমে এসব উপজেলায় যাতায়াত করছে উপজেলার বাসিন্দারা। এতে করে যেমন বেড়েছে যাতায়াত খরচ তেমনি বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়।
রাঙামাটির সবচেয়ে বড় পাইকারী বাজার রিজার্ভ বাজারের চালের আড়তদার অসীম দাশ বলেন, প্রতিবছর পানি কমে গেছে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। উপজেলার লঞ্চঘাট পর্যন্ত কোন লঞ্চ চলাচল করে না। ছোট নৌকা করে পণ্য পরিবহন করতে প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া গুণতে হয় এবং পরিবহন শ্রমিক মজুরিও বেশি। এতে করে পণ্যের দামও বেড়ে যায়, যা মাঝেমাঝে সাধারণ মানুষজনের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়।
বরকল উপজেলার বাসিন্দা সুশোভন দেওয়ান বলেন, আগে পানি কমলেও এত বেশি কমে যেত না। কিন্তু এই বছর অতিরিক্ত পানি কমে গিয়েছে। বরকল থেকে রাঙামাটি আসা-যাওয়া করতে আমাদের আগে যে ভাড়া লাগতো, এখন তার তিনগুণ ভাড়া দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। এতে আমাদের কষ্টও বেড়েছে, আর্থিক ক্ষতিও হচ্ছে।
মাইনীর বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম বলেন, আগে যখন হ্রদে পানি ছিল তখন মাইনী থেকে রাঙামাটি আসতে আমাদের সময় লাগতো ৪ ঘন্টার মত আর এখন ৬ ঘন্টারও বেশি সময় লাগে। এখন লঞ্চও চলে না, ছোট বোটে যাতায়াত যেমন কষ্টসাধ্য তেমনি ব্যয়বহুল।
বোটচালক ইউনুস মিয়া বলেন, এখন সুবলং ইউনিয়ন পর্যন্তও বোট নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। কারণ সব জায়গায় চর পড়েছে এবং চরে বোট আটকে যাচ্ছে। আগে বরকল পর্যন্ত যেতে আমাদের খরচ হতো ১২ লিটার তেল এখন সেখানে ২০লিটার তেল দিয়েও পৌঁছানো যায় না। খরচ বাড়লেও ভাড়া বাড়েনি।
রাঙামাটি বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে কাপ্তাই হ্রদ। টুরিস্ট বোটে করে হ্রদে ভ্রমণ করতেই বেশি পছন্দ করেন পর্যটকরা। কিন্তু হ্রদে পানি না থাকায় পর্যটক কেন্দ্রীক ব্যবসা বাণিজ্যেও ভাটা পড়েছে। কমেছে পর্যটকদের সংখ্যা।
টুরিস্ট বোট চালক মো. ইয়াসিন বলেন, রাঙামাটিতে এখন পর্যটক নেই বললেই চলে। আগে যেখানে দৈনিক কয়েক হাজার পর্যটক আসতেন সেখানে এখন একশ জন পর্যটকও আসেন না। আর লেকে পানি না থাকায় কেউ আর লেক ভ্রমণেও বের হন না। আমরা খুব কষ্টে আছি।
রাঙামাটি পর্যটন ঘাটের ইজারাদার এবং ট্যুরিস্ট বোট মালিক সমিতির সহ-সভাপতি রমজান আলী বলেন, আমাদের খুব খারাপ সময় যাচ্ছে। প্রায় বোট চালকই এখন কর্মহীন অবস্থায় আছে। পেটের দায়ে অনেকে বোট চালনার পরিবর্তে অন্যান্য কাজ শুরু করেছে।
রাঙামাটি ট্যুর এন্ড ট্রাভেলস গাইড এর স্বত্ত্বাধিকারী হিমু বাপ্পী জানান, আমরা প্রায় এখন অলস সময় কাটাচ্ছি। লেকে পানি নেই মানে পর্যটকও নেই। যারা আগে বোটে করে বিভিন্ন ট্যুারিস্ট স্পটগুলো ঘুরতে বের হতেন, এখন রাঙামাটি বেড়াতে আসা পর্যটকরা হ্রদে বেড়ানোর মত কোন সুযোগ নেই।
নৌযান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল (যাত্রী পরিবহন) রাঙামাটি জোনের সভাপতি মঈনউদ্দীন সেলিম বলেন, রাঙামটির মোট ৬টি উপজেলায় যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের জন্য আমাদের লঞ্চগুলো চলাচল করে। সাধারণত শুষ্ক মৌসুম শুরু হওয়ার সময় লেকের পানি কমতে থাকলেও এবার গতবছরের নভেম্বর ডিসেম্বর থেকেই পানি কমতে শুরু করেছে। প্রায় চার মাসেরও বেশি সময় ধরে উপজেলার সাথে আমাদের লঞ্চ যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। আগে যেখানে দৈনিক চার থেকে পাঁচ হাজার মানুষ বিভিন্ন উপজেলায় যাতায়াত করতেন এখন সেটা দুইশ থেকে তিনশত নেমে এসেছে, কারণ যোগাযোগের মাধ্যম বন্ধ।
তিনি আরো বলেন, কাপ্তাই হ্রদে এই মুহুর্তে ড্রেজিং করা খুব বেশি জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন সময়ে আমরা নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়, বিআইডব্লিওটিএ, রাঙামাটি জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন জায়গায় কাপ্তাই হ্রদ ড্রেজিংয়ের আবেদন করেছি। কিন্তু দীর্ঘ একটা সময় পার হয়ে গেলেও কখনো কাপ্তাই হ্রদে ড্রেজিং হয়নি। এই কারণেই বিভিন্ন স্থানে চরের সৃষ্টি হয়েছে। আর এই ড্রেজিং না হওয়ার কারণেই শুষ্ক মৌসুমে হ্রদে পানির প্রবাহটা ঠিক থাকছে না। হ্রদে অতি দ্রুত ড্রেজিং করার দাবি জানান তিনি।
হ্রদে পানি না থাকার ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ধস নেমেছে হ্রদের পানির উপর নির্ভরশীল কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের ৫টি ইউনিট শুধুমাত্র বর্ষা মৌসুমেই চালু করা সম্ভব হয় যখন হ্রদে সর্বোচ্চ পরিমাণ পানি থাকে। এছাড়া বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস থেকে কাপ্তাই হ্রদের পানির উচ্চতা কমতে থাকে। এপ্রিল মাসের শুরুর দিক থেকে তীব্র দাবদাহের কারণে হ্রদের পানি হ্রাস পেতে থাকে খুব দ্রুত। ফলে হ্রদের পানির ওপর নির্ভরশীল কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
শুক্রবার সকালে কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক এটিএম আব্দুজ্জাহের বলেন, রুলকার্ভ অনুযায়ী কাপ্তাই হ্রদে এখন পানি থাকার কথা ৭৬ এমএসএল (মীনস সি লেভেল), কিন্তু পানি আছে ৭২.৬৭ এমএসএল। যা স্বাভাবিকের তুলনায় কম। মৌসুম হিসেবে বৃষ্টি শুরু হয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও বৃষ্টি হচ্ছে না, ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন সর্বনি¤œ পর্যায়ে নেমে এসেছে। বর্তমানে একটি ইউনিট সচল আছে যা থেকে ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে।
রাঙামাটির পরিবেশবাদী সংগঠন গ্লোবাল ভিলেজের পরিচালক হেফাজত বারী সবুজ বলেন, ১৯৬২ সালে কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টির পর থেকে এখনো একবারও ড্রেজিং করা হয়নি। যেহেতু এটি একটি কৃত্রিম হ্রদ তাই এটির রক্ষাণাবেক্ষণ এবং ড্রেজিং করা অত্যন্ত জরুরি। ড্রেজিং না করার ফল আমরা ইতিমধ্যেই পাচ্ছি। যেমন-হ্রদে এই সময়ে যে পরিমাণ পানি থাকার কথা তা নেই। অতি দ্রুত যদি কাপ্তাই হ্রদ ড্রেজিং করা না হয় তবে অদূর ভবিষ্যতে দেখা যাবে পার্বত্যঞ্চলেও বন্যার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।