অর্ণব মল্লিক, কাপ্তাই ॥
রাঙামাটি জেলায় অবস্থিত দেশের অন্যতম বৃহৎ কৃত্তিম জলাধার কাপ্তাই হ্রদ। ষাটের দশকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করা হলে এই বৃহৎ কৃত্তিম জলাধার সৃষ্টি হয়। কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টির ফলে এই হ্রদের ওপর নির্ভরশীল হয় এখানকার স্থানীয় জনসাধারণ। বিশেষ করে রাঙামাটির কয়েকটি উপজেলা কাপ্তাই হ্রদের মাধ্যমে নৌপথে যাতায়াত করতে হয়। তবে কাপ্তাই হ্রদ যখন পানিতে পরিপূর্ণ থাকে তখন সবকিছু স্বাভাবিক থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে যখন পানি কমে যায় তখন দেখা দেয় চরম দুর্ভোগ।
বিশেষ করে হ্রদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের এনিয়ে নানা সমস্যায় পড়তে হয়। এদিকে সারাদেশে বয়ে যাচ্ছে তাপদাহ। বছরের এই মৌসুমে বৃষ্টিপাত কম হওয়াতে কাপ্তাই হ্রদের পানি দিন দিন কমতে শুরু করেছে। হ্রদে পানি কমায় একদিকে যেমন নৌপথে চলাচল ব্যাহত হচ্ছে তেমনি অন্যদিকে অর্থনৈতিক ভাবেও এর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই নয় কাপ্তাই হ্রদের পানি কমার প্রভাব পড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। বর্তমানে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন সর্বনি¤œ পর্যায়ে এসে ঠেকেছে।
কাপ্তাই হ্রদের সংযোগস্থলে অবস্থিত কাপ্তাই উপজেলার অন্যতম ব্যস্ততম জেটিঘাট বাজার। তিন পার্বত্য অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম ব্যবসায়িক প্রধান প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি রয়েছে কাপ্তাই জেটিঘাট বাজারের। যেখানে কাপ্তাই হ্রদ ব্যবহার করে নৌপথে দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল থেকে বিভিন্ন ফসল সহ গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম আনয়ন করা হয়। এছাড়া কাপ্তাই জেটিঘাট ব্যবহার করেই রাঙামাটি সদর, বিলাইছড়ি সহ কয়েকটি পাহাড়ি এলাকায় নৌ পথে যাতায়াত করতে হয়।
সম্প্রতি কাপ্তাই জেটিঘাটে গিয়ে দেখা যায়, কাপ্তাই হ্রদের পানি কমে যাওয়ায় এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে এলাকাজুড়ে। বিশেষ করে নৌপথে চলাচলে চরম ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। পানি স্বল্পতায় সঠিকভাবে ইঞ্জিত চালিত বোটগুলি চলাচল করতে না পারায় ভাড়া ও বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুন। এতে করে নৌপথে চলাচলকারী যাত্রী ও চালকদের দুর্ভোগ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এবিষয়ে কথা হলে স্থানীয় বোট চালক মো. সোহেল, রতন দাশ সহ কয়েকজন জানান, পানি কমে গেলে বোট চালক সহ যাত্রীদের বেশ দুর্ভোগ শুরু হয়। বিশেষ পাহাড়ি অনেক জায়গায় বড় বোট গুলো যাওয়া সম্ভব হয় না। ছোট ছোট বোটগুলি নিয়ে চলাফেরা করতে হয়। কাপ্তাই হ্রদের অনেক জায়গায় বোট আটকে যায়। ঠেলা দিয়ে বোট সচল করতে হয়। এক কথায় চরম দুর্ভোগ বাড়ছে।
কথা হলে কাপ্তাই জেটিঘাটে প্রতিদিন চলাচলকারী স্থানীয় যাত্রী আয়েশা বেগম, চিংনু মারমা, সুব্রত বড়ুয়া সহ কয়েকজন জানান, কাপ্তাই হ্রদে প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে পানি কমে গেলে এই দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়। এজন্য সরকার কোন উদ্যোগ গ্রহন করে না। কাপ্তাই হ্রদে ড্রেজিং করার আলোচনা ও প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। তাই এবিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
এদিকে কাপ্তাই হ্রদের পানি কমায় এর প্রভাব পড়েছে অর্থনৈতিক ভাবে। কেননা এখন কাপ্তাই জেটিঘাট বাজারে আগের মতো পণ্যদ্রব্য, মৌসুমী ফল, ফসল আসছে না। নৌপথে ভাড়া বৃদ্ধি, পানি কমে যাওয়ায় অনেক পাহাড়ি এলাকায় যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এতে কাপ্তাই জেটিঘাটের ওপর নির্ভরশীল শ্রমিকদের আয় রোজগার কমেছে।
কাপ্তাই হ্রদের ওপর নির্ভরশীল শ্রমিক মোঃ আকবর, রহমত আলী, হারাধন দাশ সহ কয়েকজন জানান, বর্তমানে পানি কমে যাওয়ায় পাহাড়ের দুর দুরান্ত থেকে চাষীরা ফসল আনছেনা। কারণ বড় বোটগুলি ওখানে যেতে পারছেনা। ভাড়াও বেড়ে গেছে, তাছাড়া ছোট ছোট বোট দিয়ে ফসল আনলেও তা বিক্রি করে তেমন লাভবান হওয়া যায় না। আর বিভিন্ন ফসল না আসলে শ্রমিকদের আয় রোজগার বন্ধ হয়ে বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
কাপ্তাই হ্রদে পানি কমাতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে দেশের একমাত্র পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। বর্তমানে কাপ্তাই হ্রদের ওপর নির্ভরশীল কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন সর্বনিম্ম পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৫টি ইউনিটের মধ্যে মাত্র ১টি ইউনিট চালু আছে। যেখানে দৈনিক ৩৫ থেকে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। অথচ কাপ্তাই হ্রদের পানি পরিপূর্ণ থাকলে কেন্দ্রটি ৫টি ইউনিটে দৈনিক ২২০ থেকে ২৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সক্ষমতা ছিলো। এদিকে সহসায় ভারী বৃষ্টিপাত না হলে কাপ্তাই হ্রদের পানি বাড়ার সম্ভাবনাও নেই।
এদিকে কাপ্তাই হ্রদের পানি কমায় এর প্রভাব পড়েছে কর্ণফুলী নদীতেও। কারণ দেশের একমাত্র জল বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর কাপ্তাই হ্রদের পানি কর্ণফুলী নদীতে নির্গত হয়। এরপর কর্ণফুলী নদীর পানি শোধনাগারে পরিশোধন করে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম শহরে সরবরাহ করে থাকে চট্টগ্রাম ওয়াসা। কর্ণফুলী নদীর পানি বছরজুড়ে প্রবাহিত না হলে সমুদ্রের পানির গতিবেগ বাড়ার সুযোগ থাকায় লবণাক্ততা বাড়তে পারে ওয়াসার পরিশোধিত পানিতে। অনেকটা চট্টগ্রাম নগরে পানি সরবরাহের সঙ্গে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাই সারাবছর জুড়েই সচল রাখতে হয় কেন্দ্রটির বিদ্যুৎ উৎপাদন।
তবে কাপ্তাইয়ের স্থানীয় সচেতন মহল মনে করছেন, কাপ্তাই হ্রদে একসময় যেই গভীরতা ছিলো তা দিন দিন কমছে। বিশেষ করে হ্রদের বেশ কিছু অংশে পলি মাটি জমে গভীরতা কমে গেছে। তাই কাপ্তাই হ্রদে ড্রেজিং করা গেলে হয়তো হ্রদের এই সমস্যা কিছুটা কমে আসতো।
এবিষয়ে রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ বলেন, কাপ্তাই হ্রদে যে একটি স্টাটেজিক ইস্যু রয়েছে। যেমন কাপ্তাই হ্রদে পানি কমিয়ে দিলে তিন চারটি উপজেলার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আবার পানি যদি বেশি রাখা হয় সেক্ষেত্রে অনেক জমি চাষের আওতায় আনা যায় না। এটার যে উভয়মুখী সমস্যা এটার একটি উল্লেখযোগ্য সমাধান হবে যদি ড্রেজিংটা করা যেতে পারে। আর এই ড্রেজিং এর বিষয়ে ইতিমধ্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কাজ চলছে। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্ট এবিষয়ে কাজ করছেন। এটা সম্ভাবতা যাচাই হয়েছে। এই কাজ শীঘ্রই শুরু হবে বলে আমরা জেনেছি এবং আমরা আশাবাদী।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের বৃহৎতম এই কাপ্তাই হ্রদে পানির ধারণ ক্ষমতা ১০৯ এমএসএল (মিনস সি লেভেল)। তবে বুধবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত কাপ্তাই হ্রদে পানি রয়েছে ৭৬ দশমিক ৭৯ মিনস সি লেভেল (এমএসএল)। যদিও স্বাভাবিকভাবে পানি থাকার কথা ৯২ দশমিক ৯০ এমএসএল। অর্থাৎ রুল কার্ভের হিসেব অনুযায়ী বর্তমানে কাপ্তাই হ্রদে প্রায় ১৬ দশমিক ১১ এমএসএল পানি কম রয়েছে।