জাকির হোসেন, দীঘিনালা
পাহাড়ি অঞ্চলে স্থানীয় পাহাড়ি-বাঙালি সকল জনগোষ্ঠীর মধ্যেই শুটকির চাহিদা অনেক বেশি। বিশেষ করে দুর্গম এলাকার লোকজন সাপ্তাহিক হাট থেকে বেশি করে শুটকি ক্রয় করে থাকেন বেশিদিন ঘরে সংরক্ষণ করার সুবিধায়। এছাড়া জুম চাষিরা হাট-বাজার থেকে অনেক দুরে বসবাস করায় তাদের বেশি প্রয়োজন হয় শুটকি।
আর এ শুটকিতে বিষ, ফরমালিন বা কেমিক্যাল মিশ্রণের ভয়ঙ্কর তথ্যও পাওয়া যায় সংবাদ মাধ্যমে। এসব কারণে প্রয়োজনীয় এ খাদ্যটি নিয়ে শঙ্কা থেকে যায় ভোক্তাদের মনে। স্থানীয় ভোক্তাদের হাতে কেমিক্যালমুক্ত শুটকি তুলে দেওয়ার জন্য ভেজালমুক্ত শুটকি তৈরি করছেন দরিদ্র কৃষক পরিবারের এক তরুণ উদ্যোক্তা। তৈরি করা হচ্ছে ছুরি মাছের শুটকিসহ কয়েক প্রজাতির শুটকি। স্থানীয় সকল জনগোষ্ঠীর নিকট ছুরি শুটকির চাহিদা বেশি। তবে, সকল শুটকি ছোট, মাঝারি ও বড় আকারের রয়েছে।
কেমিক্যালমুক্ত শুটকি তৈরি করছেন খাগড়াছড়ির দীঘিনালার দুর্গম গ্রামের এক তরুণ উদ্যোক্তা। মেশিনের সাহায্যে নয় রোদে শুকানোর কারণে এ শুটকি সুস্বাদুও হচ্ছে।
মাত্র তিনমাস আগে শুরু করে সফলতার পথেই এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এখন তাঁর এ উদ্যোগ ব্যবসায়িক পেশায় পরিণত হয়েছে; ছোট্ট পরিসরে শুরু করলেও প্রতিদিন সেখানে কাজ করে সংসার চলছে আরও ১৫-২০জন শ্রমিকের।
এ উদ্যোক্তা হলেন উপজেলার বাবুছড়া ইউনিয়নের মইগ্যা কার্বারি পাড়ার প্রিয় শান্তি চাকমার ছেলে সজীব চাকমা (২৮)। তিনি জানান, এইচএসসি পাশ করার পর আর লেখাপড়া করার সুযোগ হয়নি। শুরু করেন সংসার জীবন; কিন্তু কৃষক পিতার আর্থিক অবস্থার কারণে বড় কিছু করা সম্ভব হয়নি। ভাড়ায় মোটর সাইকেল চালিয়ে সামান্য আয় করতেন। এর মধ্যে শুটকির গুণগত মান আর সংবাদের মাধ্যমের খবরে শুটকি নিয়ে তাঁর মধ্যে শঙ্কা সৃষ্টি হয়। ভেজালমুক্ত খাদ্য হিসেবে শুটকি তৈরি করা যায় কিনা ভাবতে থাকেন। বিভিন্নভাবে শুটকি তৈরির খোঁজ নিয়ে এক প্রকার ঝুঁকি নিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করেন শুটকি তৈরি।
প্রথম দফায় লাভের ওপর ধার-দেনা করে পূঁজি খাটান ৩লাখ টাকা। এর মধ্যে ঘর তৈরি, পানির ব্যবস্থা এবং মাছ শুকানোর জন্য বাঁশের মাচা ও বেড়া-ঘেরাসহ খরচ হয় ৫০হাজার টাকা। আর আড়াই লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন কাঁচা মাছ সংগ্রহ ও শ্রমিকের বেতনে। কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে কাচা মাছ সংগ্রহ করা হয়।
তবে প্রথম দফায় শুটকি তৈরিতে বিপত্তি ঘটে অসময়ের বৃষ্টির কারণে। মাছ শুকাতে নির্ধারিত সময়ের চেয়েও অনেক দিন বেশি সময় লাগে। এছাড়া বেশ কিছু মাছ নষ্টও হয়ে যায় শুকাতে না পেরে। তখন ধারণা ছিল লাখ টাকার বেশি লাভ হওয়ার কিন্তু লাভ টিকে ৭০হাজার টাকার মতো। এতেই খুশি হয়ে তিনি স্বপ্ন দেখেন শুটকি তৈরিকে ব্যবসায়িক পেশা হিসেবে নেওয়ার।
এবারের চালানে মাছ সংগ্রহে ৪লাখ ৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছেন। ইতিমধ্যে পর্যায়ক্রমে শুটকি বিক্রয় শুরু হয়েছে। এবার সময়মতো মাছ শুকাতে পারলে ২লাখ টাকার বেশি লাভের আশা করছেন সজীব।
তবে সজীব জানান, বিনিয়োগ করা সম্পূর্ণ টাকা লাভের ওপর সংগ্রহ করা। টাকার লাভ পরিশোধ করার পর নিজের অর্জিত টাকার বড় একটা অংশ চলে যায়। তাই সরকারি বা কোন বেসরকারি সংস্থা থেকে যদি ঋণ সহযোগিতা পেতেন তাহলে ব্যবসার পরিসর বৃদ্ধি করা যেত। এতে এলাকায় কেমিক্যালমুক্ত শুটকির চাহিদা পূরনের সাথে স্থানীয় অনেক শ্রমিকের কর্মসংস্থান বাড়তো।
কেমিক্যালযুক্ত ও কেমিক্যালমুক্ত শুটকি তৈরির বিষয়ে সজীব চাকমা বলেন, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে যাঁরা শুটকি তৈরি করেন তাঁরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ির নিকট পাইকারি বিক্রেতা। তাঁরা শুটকি তৈরি করেন অনেক বেশি। মেশিনে অধিকাংশ শুটকি শুকানা হয়। মজুদও রাখেন অনেকদিন, মাসের পর মাসও মজুদ রাখা হয়। এমনকি বাজারে পৌছার পর বিক্রয়ের আগ পর্যন্ত অনেক সময় বছরও পর হয়। সেকারণেই হয়তো নিরাপদ খাদ্যের চিন্তা না করে ব্যাবসায়িক চিন্তায় তাদের অনেকেই শুটকি নষ্ট না হওয়ার জন্য বিষজাতীয় কেমিক্যাল প্রয়োগ করেন।
আর ভাল শুটকি তৈরির জন্য শুধু প্রয়োজন ভালভাবে পরিষ্কার, পরিচর্চার মাধ্যমে ভালভাবে রোদে শুকানো। সজীব যা করছেন, কাঁচা মাছের পেটের ভিতরের ময়লা ফেলে দিয়ে ভাল করে পরিষ্কার করে ৩/৪বার ড্রামভর্তি পানিতে ধুয়ে তার পর রোদে শুকানো। কোন কোন মাছে প্রয়োজন হলে সামান্য লবন ব্যবহার করা হয়। এর বাইরে আর কিছু ব্যবহার করা হয় না।
শ্রমিক খরচ বেশি হয় পরিষ্কার করা আর শুকানোতে। রোদে শোকানোর জন্য ঝুলন্ত মাছকে সময়মতো উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে শুকিয়ে টাটকা শুটকি করাই আসল কাজ। এই শুকানোতেই সৃষ্টি হয় গুণগত ভাল মানের শুটকি।
বৃষ্টি-বাদলের ঝামেলা না হলে এক চালান বাজারজাত করতে সময় লাগে ১০-১২দিন। সজীব জানান, কাঁচা মাছ সংগ্রহ করে নিয়ে আসা, পরিষ্কার করা এবং শুকানো পর্যন্ত সময় লাগে মাত্র ১০ দিন। সব মিলিয়ে শুরু থেকে বাজারজাত পর্যন্ত সময় লাগবে সর্বোচ্চ ১০/১২দিন।