গ্যাস ক্রয়ে বৈষম্যের অভিযোগ করেছে কর্ণফুলী পেপার মিলস (কেপিএম)। এক সময় বিদ্যুৎ ও শিল্প গ্রাহক হিসাবে গ্যাস ক্রয় করত কেপিএম। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ কেমিক্যাল করপোরেশনের (বিসিআইসি) অন্যান্য শিল্প কারখানার চেয়ে বেশি দামে গ্যাস ক্রয় করায় ধারাবাহিক লোকসানের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে বলে দাবি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। গ্যাস ক্রয়ের ক্যাটাগরি পরিবর্তনের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের সংকট থেকে উত্তোরণ চায় রাষ্ট্রয়ত্ত্ব কাগজকলটি।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল করপোরেশনের (বিসিআইসি) অপর কারখানাগুলো সার উৎপাদন করায় শুধুমাত্র সার ক্যাটাগরির হিসাবে গ্যাস ক্রয় করে। কিন্তু প্রধান কাঁচামাল হিসাবে গ্যাসের ব্যবহার হলেও এসব কারখানায় নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থাও রয়েছে। এ কারণে বিসিআইসি’র অন্যান্য কারখানার চেয়েও সংকট সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে নিয়মিত উৎপাদন স্বাভাবিক থাকায় (গড়ে ২৫ থেকে ৩০ টন) দৈনিক প্রায় দেড় কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে কেপিএমের। ক্যাপটিভ পাওয়ার ক্যাটাগরির গ্রাহক হিসাবে গ্যাসের মূল্য পরিশোধ করায় লোকসানের সমপরিমাণ বাড়তি মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন কেপিএম কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেপিএমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. এম এম এ কাদের বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে কেপিএম দেশের কাগজ শিল্পের নেতৃত্ব দিয়েছে। তবে সাম্প্রতিক লোকসানের কবল থেকে বের হয়ে আসতে কেপিএম নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। গ্যাসের বাড়তি মূল্য পরিশোধের কারণে কেপিএমের উৎপাদন খরচ এখনো দেশের প্রতিযোগিতামূলক বাজারের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। আমরা বিষয়টি কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ছাড়াও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জানিয়েছি। ক্যাটাগরি পরিবর্তন হলে কেপিএম লাভের ধারায় ফিরে আসবে বলে আশা করছেন তিনি।
এক সময় কেপিএম জ¦ালানী হিসাবে ফার্নেস অয়েল ব্যবহার করতো। সাশ্রয়ী জ¦ালানী হিসাবে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারে ১৯৮৪ সালের ১৪ নভেম্বর তৎকালীন বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (বর্তমানে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি-কেজিডিসিএল) এর সাথে চুক্তি করে। ১৯৮৭ সালের জুন পর্যন্ত শিল্প গ্রাহক হিসাবে বিল পরিশোধ করে। কিন্তু কারখানায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করায় ১৯৮৭ সালের আগষ্ট থেকে ৯০ শতাংশ বিদ্যুৎ ও ১০ শতাংশ শিল্প গ্রাহক হিসাবে গ্যাসের বিল পরিশোধ করে। এরপর ১৯৯০ সালের মার্চ থেকে ১৯৯৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎ ও ৩০ শতাংশ শিল্প গ্রাহক হিসাবে গ্যাসের মূল্য পরিশোধ করে। কিন্তু সরকারি গ্যাস বিক্রয় সার্কুলারের প্রেক্ষিতে বয়লারে গ্যাস ব্যবহারের মাধ্যমে সীমিত পরিসরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেও ১৯৯৪ সালের ২৩ অক্টোবর থেকে ৭০ শতাংশ ক্যাপটিভ পাওয়ার ও ৩০ শতাংশ শিল্প গ্রাহকের গ্যাস বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। সাধারণ বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ খাতের সরকারি-বেসরকারি কারখানাগুলো বর্তমানেও ৪ দশমিক ৪৫ টাকা দরে প্রতি ঘনমিটার গ্যাস বিল পরিশোধ করে। কিন্তু সরাসরি জেনারেটরে ব্যবহার না করেও কেপিএম-কে ক্যাপটিভ পাওয়ার খাতের কোম্পানির মতো সর্বোচ্চ ১৩ টাকা ৮৫ পয়সা দরে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় খাতের এ কাগজকলটি নিজস্ব বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি স্থানীয় সশ¯্র বাহিনীর ক্যাম্প, কাপ্তাই উপজেলাস্থ স্থানীয় জনগোষ্ঠী, কেপিএমের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকদের আবাসিক খাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ দিয়ে আসছে। এ কারণে ক্যাপটিভ পাওয়ার খাতের গ্রাহক হিসাবে সর্বোচ্চ দরে গ্যাসের মূল্য পরিশোধের কারণে লাভের ধারায় ফিরতে পারছে না বলে অভিযোগ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান প্রশাসন।
জানা গেছে, বিসিআইসি’র বিভিন্ন সার কারখানাও সরকারের বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে সার গ্রাহক হিসাবে গ্যাস ক্রয় করে। এসব কারখানাগুলোর পণ্য উৎপাদনের মূল কাঁচামাল গ্যাস হওয়ায় সর্বনি¤œ সার গ্রাহকের বিল পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু এসব কারখানা সার উৎপাদনের পাশাপাশি নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পরিচালিত জেনারেটর ব্যবহার করে। ২০০০ সালে গ্যাসের মূল্যের হিসাবে প্রতি ঘনমিটার বিদ্যুৎ গ্রাহক ও ক্যাপটিভ পাওয়ারের মধ্যে পার্থক্য ছিল এক টাকা ২৮ পয়সা। কিন্তু ক্যাপটিভ পাওয়ার খাতের গ্যাসের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বাড়ানোর ফলে উভয় গ্রাহকের গ্যাসের মূল্য পার্থক্য ৯ টাকা ৪০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। ফলে প্রতি মাসে প্রায় দুই কোটি টাকারও বেশি গ্যাসের মূল্য পরিশোধ করায় কেপিএম সংস্কার কার্যক্রমের মাধ্যমেও লাভের ধারায় ফিরতে পারছে না বলে দাবি করেছেন রাষ্ট্রয়াত্ত্ব কোম্পানিটির কর্মকর্তারা।
এদিকে চলতি বছরের ২১ আগষ্ট কেপিএম কর্তৃপক্ষ কেজিডিসিএল ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের গ্যাস ক্রয়ের গ্রাহক ক্যাটাগরি পরিবর্তনে একটি চিঠি দেয়। কেপিএমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মহাব্যবস্থাপক (এমটিএস) ও পরিচালক (উৎপাদন ও গবেষণা) স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে কেপিএমকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে গ্যাস গ্রাহকের ক্যাটাগরি পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন কর্তৃক ঘোষিত সর্বনি¤œ রেট নির্ধারণের আবেদন জানানো হয়। এক্ষেত্রে গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও প্রসেসের জন্য গ্যাসের মূল্য ক্যাপটিভ ও শিল্প গ্রাহকের পরিবর্তে বিদ্যুৎ (পিডিবি/আইপিপি) অথবা বিসিআইসি’র অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসাবে সার গ্রাহক হিসাবে পরিবর্তনের দাবি জানানো হয় ওই চিঠিতে।
জানতে চাইলে কেজিডিসিএলের মহাব্যবস্থাপক (ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস ডিভিশন) মো. সারওয়ার হোসেন বলেন, কেজিডিসিএল শুধুমাত্র বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান। গ্রাহকদের ক্যাটাগরি পরিবর্তনের ক্ষমতা কেজিডিসিএলের নেই। যেকোন কারখানা গ্যাস ক্রয় করে নিজস্ব প্রয়োজনে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে ক্যাপটিভ গ্রাহক হিসাবে বিল পরিশোধ করতে হবে। তবে কেপিএম জেনারেটরের পরিবর্তে বয়লারের মাধ্যমে স্ট্রিম দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। বিষয়টি কেজিডিসিএলের হাতে নেই। এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন কিংবা মন্ত্রণালয় যদি চায় তবে কেজিডিসিএলের এ বিষয়ে কোন আপত্তি থাকবে না বলে জানিয়েছেন তিনি।
কেপিএমের প্রকৌশল বিভাগের ঊর্দ্ধতন এক কর্মকর্তা অভিযোগ করে বলেন, কেপিএম প্রথমত সরকারি প্রতিষ্ঠান। নিজস্ব বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট বা জেনারেটর ব্যবহার করে না। তবে ব্যবহৃত বয়লারের স্ট্রিম দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে কারখানার প্রয়োজনে ব্যবহার ছাড়াও শ্রমিক-কর্মচারীদের কয়েক হাজার বাসাবাড়িতে বিতরণ করে। এছাড়াও এক সময় কাপ্তাই উপজেলার বিভিন্ন গ্রাহককে ( কেপিএমের সাথে যুক্ত নয় এমন আবাসিক গ্রাহক) বিদ্যুৎ সরবরাহ করতো। অন্যদিকে স্থানীয় একটি সশ¯্র বাহিনীর ক্যাম্পেও বিদ্যুৎ দেয়া হয় কেপিএম থেকে। দেশের গ্যাস বিতরণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দরে গ্যাসের দাম পরিশোধ করায় কাগজ উৎপাদনের খরচ অস্বাভাবিক। এ কারণে দেশের কাগজ শিল্পের স্থিতিশীলতার স্বার্থে কেপিএমের গ্রাহক ক্যাটাগরি দ্রুত পরিবর্তন করা উচিত বলে দাবি করেন তিনি।
জানা গেছে, বকেয়ার কারণে চলতি বছরের ৩ আগষ্ট থেকে কেপিএম এর উৎপাদন প্রায় এক মাস বন্ধ ছিল। কেপিএমের কাছে প্রায় ৮০ কোটি টাকার গ্যাস বিল বকেয়া থাকায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল কেজিডিসিএল। এরপর প্রায় ৫ কোটি টাকা পরিশোধের মাধ্যমে সংযোগ ফিরে পায় কেপিএম। এরপর থেকে প্রতিদিন গড়ে ২৫ থেকে ৩০ টন পর্যন্ত কাগজ উৎপাদন হচ্ছে এখানে। কেপিএম প্রতিদিন প্রায় ২ লক্ষ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দিয়ে ২৪ ঘণ্টায় ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।
কেপিএমের উৎপাদন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে কেপিএমে ৩ হাজার টন কাগজ উৎপাদন হয়েছিল। কিন্তু উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনায় সর্বশেষ অর্থ বছরে উৎপাদন হয়েছে ৬ হাজার টন কাগজ। চলমান উৎপাদন (দৈনিক ২৫ থেকে ৩০ টন ) ধরে রাখা গেলে চলতি অর্থ বছরে কেপিএমের উৎপাদন ১০ হাজার টনে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। ২০০৫-০৬ অর্থ বছরে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক উৎপাদন ছিল ২৫ হাজার ৭০৪ টন। ওই সময়ে টনপ্রতি কাগজ উৎপাদনের ব্যয় ছিল মাত্র ৪৯ হাজার ৭৪৫ টাকা। কিন্তু গ্যাসের ক্রমাগত মূল্য বৃদ্ধি-সহ নানান কারণে টনপ্রতি কাগজ উৎপাদনের ব্যয় বেড়ে যায়। ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে কেপিএমের কাগজ উৎপাদন ব্যয় ছিল এক লাখ ৩৭ হাজার ২৩২ টাকা। যদিও ওই সময়ে দেশীয় বাজার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে টনপ্রতি ৮৩ হাজার ৩৬০ টাকায়। এই হিসাবে বর্তমানে প্রতি মাসে প্রায় দেড় কোটি টাকা পরিচালন লোকসানে রয়েছে কেপিএম। গ্যাসের মূল্য পরিশোধে ক্যাটাগরি পরিবর্তন হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে কেপিএম লাভের ধারায় ফিরে আসবে বলে আশা করছেন উৎপাদন ও বিতরণ বিভাগ।
১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত কারখানাটির উৎপাদন কমতে থাকায় ১৯৯৭ সালে কারখানাটি সংস্কারে উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০০৮ সালে কেপিএমে ১৮১ দশমিক ৫ কোটি টাকায় ব্যালেন্সিং মডার্নাইজেশন রেনোভেশন অ্যান্ড এক্সপেনশন (বিএমআরই) হয়। কিন্তু নানান সংকটে এখনো লাভের ধারায় ফিরতে পারেনি পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত এশিয়ার বৃহত্তম এই কাগজকলটি।