মিশু মল্লিক
রাঙামাটি শহরের সম্প্রীতির মেলা হিসেবে পরিচিত জগদ্ধাত্রী পূজা ও মহোৎসব উপলক্ষে আয়োজিত জগদ্ধাত্রী মেলা না হওয়াতে হতাশা ব্যক্ত করেছে রাঙাামটির বিভিন্ন স্তরের মানুষ। ক্ষোভের ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। এই বছর মেলা বন্ধ হয়ে যাওয়াতে ক্ষোভ প্রকাশ করে নানান স্ট্যাটাস দিচ্ছেন রাঙামাটির সাধারণ মানুষজন। কেউ কেউ এটিকে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার ওপর কষাঘাত বলেও আখ্যায়িত করছেন।
মেলা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করে সংবাদকর্মী শংকর হোড় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, “রাঙামাটির জগদ্ধাত্রী পূজা ও মহোৎসব ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে মেলা হয়ে আসছে। মেলাহীন এই শহরে এই মেলাতে পাহাড়ি-বাঙালি, হিন্দু-মুসলিম সকলেই অংশ নিয়ে আসছে। এই মেলাতে অসাম্প্রদায়িকতার আরেক রূপ ফুটে উঠে। কিন্তু এই বছর নানা অজুহাতে মেলা করতে দেয়া হচ্ছে না। মেলা যাতে না বসে সেই বিষয়ে পুলিশের বেশ তৎপরতা চোখে পড়লো। যাক, পুলিশ যে আমাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে এত তৎপর সেটা দেখে বেশ ভালো লাগছে!
আচ্ছা, হাটবাজারে তো জনসমাগম হচ্ছে, সেগুলো কি নিরাপত্তার অজুহাতে বন্ধ করে দিবেন। প্রতি শনি, বুধবার কলেজ গেইট-টিএন্ডটিতে সড়কের পাশে বাজার বসে, যানজট এড়াতে সেগুলোও বন্ধ করে দিবেন? আপনারা চাইলে তো সেগুলো বন্ধ করে দিতে পারেন। আচ্ছা, দুর্গাপূজাতে ইদানিং প্রচুর দর্শনার্থী হচ্ছে, সামনে কি তাহলে নিরাপত্তার কথা ভেবে দুর্গাপূজাতেও দর্শনার্থীদের ঘোরাঘুরি বন্ধ করে দিবেন? হয়তো জগদ্ধাত্রী পূজার মেলা স্থায়ীভাবে বন্ধ করার এটা প্রাথমিক উদ্যোগ।
সব নিরাপত্তার কোপ পূজা, মেলার ওপর গিয়ে কেন পড়ে মহাশয়রা কি একটু বলতে পারবেন। মানুষের উৎসব বন্ধ করে, মানুষের মিলন বন্ধ করে, মানুষের আনন্দ বন্ধ করে এই কেমন নিরাপত্তা দিচ্ছেন আমাদের। অথচ আপনাদের দায়িত্বই ছিল মেলা যাতে নির্বিঘেœ ও সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে পারে সে বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া। ”
আরেক সংবাদকর্মী সাইফুল হাসান লিখেছেন, “রাঙামাটির হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবার কাছে পরিচিত জগদ্বাত্রী বাড়ির মেলা। এমেলায় সকল ধর্ম, বর্ণের মানুষের সমাগম হয়। দীর্ঘ বছর ধরে সুষ্ট ও সুন্দর ভাবে হয়ে আসছে। যা রাঙামাটিবাসীর ঐতিহ্যবাহী একটি মেলায় পরিচিতি লাভ করেছে। কিন্তু এবছর তা হচ্ছে না, যা দেখে প্রচুর রাগ তো হচ্ছে তার পাশাপাশি মনও খারাপ লাগছে। যে সময় উৎসবমুখর থাকার কথা হ্যাপির মোড় এলাকা তা এখন শুনশান নিরবতা। জগদ্বাত্রী বাড়ির মেলা, কঠিন চীবর দানের মেলা রাঙামাটির অন্যতম একটি উৎসব ও ঐতিহ্য বহন করে। যতসব আল্তুফাল্তু মেলা হয় তার চেয়ে এ মেলাগুলো প্রাচীন বাংলার মেলা ঐতিহ্যকে তুলে ধরে। তাই আমার মনে হয় এ মেলাগুলো করতে দেওয়া উচিত।”
রাঙামাটি জেলা বার এসোসিয়েশনের সদস্য আইনজীবী এডভোকেট বিউটি দত্ত তার ওয়ালে লিখেছেন, “ রাঙামাটিতে কোন বিজয় মেলা নেই, বৈশাখী মেলা নেই, এই একটা জগদ্ধাত্রী পুজোর মেলা ছিলো, যেখানে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের সমাগম হতো। প্রতি বছর দূরদূরান্ত থেকে দোকানীরা জগদ্ধাত্রী পুজো আর চীবর দান এইগুলো উপলক্ষে তাদের পসরা নিয়ে আসেন, এবারও এসেছেন কিন্তু গাড়ি থেকে নামাতে দেয়নি প্রশাসন। হঠাৎ ঘোষণা মেলা বসানো যাবেনা। হাট বাজার বসছেনা? মার্কেটে লোকসমাগম হচ্ছেনা? একটা ভালো সিনেমাহল নেই। ছোট এই শহরে বিনোদনের কিছুই নেই এই শহরে। মানুষগুলো যাবে কই”?
এছাড়াও এই বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্তব্য দিয়েছেন রাঙামাটির বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। এসব স্ট্যাটাসের কমেন্টেও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন স্থানীয়রা। হৃদয় নাথ লিখেছেন, “শুনে খুব কষ্ট পেয়েছি। বাংলাদেশের সব জেলাতেই সারা বছর-শীত মেলা, পৌষ মেলা, বৈশাখী মেলা, বাণিজ্য মেলা, আনন্দ মেলা, শিল্পমেলা, আর এই রাঙামাটিতে কোনো কিছু হয়না। সাংস্কৃতিক উৎসাহিত উদ্দিপনা হারিয়ে যেতে বসেছে। মাঝে মধ্যে মেলা হলে মানুষের মন বিকশিত হতো।” মোঃ আজম লিখেছেন, “দুঃখজনক ব্যাপার, প্রশাসনের বিবেচনা করা উচিত”। মোঃ ফরহাদ হোসেন পারভেজ লিখেছেন “ ছোট থেকেই এই মেলার অপেক্ষায় থাকা হয় এই বারও অপেক্ষায় ছিলাম, কিন্তু এমন কি পরিস্থিতি হলো যার কারনে এমন সিদ্ধান্ত? রাঙামাটি তার শান্ত পরিবেশের জন্য পরিচিত হলেও বর্তমানে এখানেই সবচেয়ে বেশি ভেদাভেদমূলক কর্মকান্ড এবং অবহেলা ও অনৈতিক কাজের চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা নিন্দনীয়।”
এই বিষয়ে শ্রীশ্রী জগদ্ধত্রী পূজা ও মহোৎসব উদযাপন পরিষদ-২০২৩ এর সাধারণ সম্পাদক দেবু প্রসাদ চৌধুরী বিপ্লব বলেন, উৎসবকে নিয়েই জগদ্ধাত্রী মেলাটা এবং মেলা নিয়েই আমাদের উৎসবের সাফল্য। জগদ্ধাত্রী মেলাটা রাঙামাটির সকল সম্প্রদায়ের মানুষ খুব আনন্দ নিয়ে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু এই বছর আমরা খুবই মর্মাহত। রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই বছর মেলা বা কোন ধরণের গণজমায়েত না করার জন্য প্রশাসন থেকে আমাদেরকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তাই আমরা আর মেলাটা আয়োজন করিনি।
এই বিষয়ে রাঙামাটি কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আরিফুল আমিন বলেন, আসলে জগদ্ধাত্রী মেলাটা একেবারে মূল সড়কে হয় বলে এবং বর্তমানের দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে এই বছর মেলা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। দেশের পরিস্থিতি ঠিকঠাক থাকলে হয়তো আবারো মেলা অনুষ্ঠিত হবে। কঠিন চীবর দান ও রাস পূজা উপলক্ষে মেলা হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কঠিন চীবর দান উপলক্ষে কোন ভাসমান দোকান বা মেলা আমরা বসতে দিব না। এই জন্য আমরা মাইকিং ও পোস্টারিং করছি। আর রাস পূজার মেলা সম্পর্কে এখনো প্রশাসন কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। সব ধরণের পরিস্থিতি বিবেচনা সাপেক্ষে যা সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
উল্লেখ্য, প্রতিবছর রাঙামাটি শহরের প্রাণকেন্দ্র বনরূপা হ্যাপীর মোড়স্থ শ্রীশ্রী জগদ্ধাত্রী মাতৃ মন্দির প্রাঙ্গণে জগদ্ধাত্রী পূজা ও মহোৎসব উপলক্ষে তিনদিন ব্যাপী অনুষ্ঠান ও মেলার আয়োজন করা হয়। এই মেলাটি শহরের মানুষের কাছে জগদ্ধাত্রী বাড়ির মেলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। রাঙামাটির বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ এই মেলায় অংশগ্রহণ করে বিধায় এটিকে সম্প্রীতির মেলাও বলা হয়ে থাকে।