হাবীবুল্লাহ মিসবাহ, রাজস্থলী ॥
রাঙামাটির রাজস্থলী উপজেলার ঐতিহ্যবাহী রাজস্থলী তাইতং পাড়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি খুঁড়ে খুুঁড়ে শিক্ষা দিয়ে আসছে প্রত্যন্ত এই এলাকার শিক্ষার্থীদের।
প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে ১১টি পদে শিক্ষক বিভিন্ন বিষয়ে অন্তর্ভূক্ত ছিল। ১৯৮৬ সালে তৎকালীন এরশাদ সরকারের আমলে জাতীয়করণ হওয়ার পর বিদ্যালয়ের শিক্ষক কয়েকজন অবসরে যাওয়ার পর আর কোন শিক্ষক সেই পদে পদায়ন হয়নি। ফলে দীর্ঘ ৩৬ বছর যাবৎ জোড়াতালি দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
সাড়ে ৫শ শিক্ষার্থীর এই বিদ্যালয়টি খণ্ডকালীন শিক্ষকদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। নিয়ম বর্হিভূতভাবে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাবলিক শিক্ষক রাখার যৌক্তিকতা কতটুকু বলে মনে করেন সচেতন মহল এমন প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন অভিভাবক জানান, আমরা সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিমাসে টাকা দেওয়ার পরও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে কোন হিসাব-নিকাশ দিতে অনীহা প্রকাশ করে। এমনকি বিদ্যালয়ের অতিথি শিক্ষকরা ইচ্ছামাফিক তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালানের অভিযোগও পাওয়া গেছে। পাবলিক পরীক্ষার সময় দায়িত্ব না পাওয়ার পরও অভিভাবকদের পকেট কেটে বড় লোক হচ্ছেন অতিথি শিক্ষকরা। সরকারি নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। যার ফলে অতিথি শিক্ষকের ওপরই ভরসা করছেন অভিভাবক মহল।
এই ব্যাপারে জানতে চাইলে বিদ্যালয় গভর্নিং বডির সভাপতি ও রাজস্থলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার শান্তনু কুমার দাশ বলেন, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাবলিক শিক্ষক দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালানো অযৌক্তিক। অপর দিকে এলাকার বিত্তবানদের অর্থায়নে অতিথি শিক্ষক নিয়োগ করে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হচ্ছে। তবে অতিথি শিক্ষক দিয়ে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করার নিয়ম নেই বলে জানান তিনি।
রাজস্থলী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং আওয়ামীলীগের সভাপতি উবাচ মারমা বলেন, আশির দশকের পশ্চাৎপদ জনপদে অনেকের ত্যাগের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টির তিন যুগেও শিক্ষক শুন্যতা কাটেনি। এলাকাবাসীর অর্থায়নে অতিথি শিক্ষকের ব্যয় বহন করা হচ্ছে। শূন্যপদে শিক্ষক পদায়ন ও নতুন পদ সৃষ্টিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা সচিবের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
সাড়ে ৫ শতাধিক শিক্ষার্থীর জন্য স্বল্প সংখ্যক শিক্ষক দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলছে শ্রেণি কার্যক্রম। শিক্ষক সংকটের ফলে নিয়মিত ক্লাস নিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে শিক্ষকদের। এতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি হতাশ অভিভাবকরাও। উক্ত বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চাহিদা পত্র পাঠানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানা যায়। এই শিক্ষক সংকট নিরসনে দ্রুত পর্যাপ্ত শিক্ষক পদায়নের দাবি জানিয়েছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং এলাকার সুশীল সমাজ। অতিথি শিক্ষক দিয়ে চালাতে হচ্ছে বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম। আর্থিক সংকটের কারণেও তাও সম্ভব হয়ে ওঠছে না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সাড়ে ৫শ শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে শিক্ষকদের। শিক্ষার্থীদের প্রাণ হলো শিক্ষক কিন্তু সেই প্রাণের সংকট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। ফলে শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট ও কোচিংমুখী হচ্ছে। সমস্যা তৈরি হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রমে, তার প্রভাব পড়ছে ফলাফলেও।
উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান উথিনসিন মারমা বলেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যদি একজনও শিক্ষক না থাকে তাহলে শিক্ষার্থীরা ভোগান্তির শিকার হবে এটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া রাঙামাটি জেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক সংকট রয়েছে, উপজেলার সমন্বয় মিটিংগুলোতে বারবার বলছি। এ ব্যাপারে সরকার যদি আন্তরিক হন তাহলে শিক্ষক সংকট নিরসন হবে।
কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, দূর-দূরান্ত থেকে অনেক শিক্ষার্থী এখানে পড়েন। শিক্ষক সংকটের কারণে অনেক বিষয়ের পর্যাপ্ত ক্লাস হয় না। শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা খুব কম। তারা শিক্ষক সংকট নিরসনের দাবি জানান।
মেহেরুন, ও আকলিমা নামে অষ্টম ও দশম শ্রেণির দুই শিক্ষার্থী বলেন, অনেক বিষয়ের একজনও শিক্ষক নেই। এই কারণে প্রায় ছাত্র, ছাত্রীরা ভর্তি হয়ে খুবই বিপদে পড়ছে। তাছাড়া শিক্ষক সংকটের কারণে ক্লাস কম হচ্ছে। ফলাফল তেমন ভালো হচ্ছে না, এভাবে চললে এক সময় বিদ্যালযের শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাবে। দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সানুমা মার্মা জানায়, বিষয়ক ভিত্তিক কোনো শিক্ষক নেই। সেজন্য অনেক বিষয় নিয়ে আমরা বিপাকে।
বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারি শিক্ষক আসলাম হোসেন বলেন, শিক্ষক সংকটের কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শ্রেণি কার্যক্রম। ফলে ক্লাসে শিক্ষার্থী বেশি হওয়ার কারণে ভালো কোন সাপোর্ট শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে না। শূন্যপদ পূরণসহ শিক্ষকদের পদের সংখ্যা বাড়ানোর দাবি জানান তিনি।
এ বিষয়ে রাজস্থলী তাইতং পাড়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তরিৎ কান্তি বড়ুয়া বলেন, শিক্ষক সংকটের কারণে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আমরা শিক্ষকদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য প্রতিবেদন দেওয়া হলেও সুরাহা মিলতেছে না। আমি নিজেও সরাসরি কয়েকবার যোগাযোগ করেছি।
পদ সংখ্যার বিষয়ে তিনি বলেন, পদ সংখ্যা খুব কম। যা আছে তার মধ্যেও অনেক পদ শূন্য রয়েছে। এতে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া আর্থিক সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় শিক্ষক রাখা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক সময় মানসম্মত শিক্ষকও মিলে না। শিক্ষক সংকট নিরসনের জন্য তিনি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।