আরমান খান ॥
দেশের তরুণরা যখন পড়ালেখা শেষ করে চাকুরির মতো সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে থাকেন বছরের পর বছর। ঠিক সে সময়ে ব্যাতিক্রমী উদ্যোগ নিয়ে সবার নজর কেড়েছেন পাহাড়ি জেলা রাঙামাটির তিন তরুণ। গড়ে তুলেছেন চিপস তৈরির কারখানা।
অপার সম্ভবনাময় পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে মৌসুমে ফল উৎপাদন হয়ে থাকে। বিশেষ করে কাঁঠাল, কলা ও আনারসের কদর বেশি। জেলার চাহিদা মিটিয়ে নিয়ে সরবরাহ করা হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তেও। অপার সম্ভাবনা থাকার পরও অবহেলায় প্রতি মৌসুমে নষ্ট হয় দেশীয় ফলগুলোর উৎপাদনের বড় একটি অংশ। তবে এবারে সেসব বিপুল পরিমাণ উৎপাদিত ফলগুলো সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে কাঁঠাল ও কলা প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে পাহাড়ি জেলা রাঙামাটিতে তৈরি হচ্ছে কাঁঠাল ও কলার চিপস।
রাঙামাটি জেলা শহরের আসামবস্তি এলাকায় তিন তরুণ উদ্যোক্তা সুবিমল চাকমা, প্রমথ চাকমা ও শান্তু চাকমা বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে গড়ে তুলতেছে ছোট এক চিপস তৈরির প্রতিষ্ঠান। যার শুরু থেকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ডাচ্ বাংলা ব্যাংক সহযোগিতা করে যাচ্ছে।
উদ্যোক্তরা জানান, ২০২২ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ থেকে প্রশিক্ষণ নেয় সুবিমল, প্রমথ ও শান্তু চাকমারা। তারা এই চলতি বছরের মে মাসে থেকে ছোট পরিসরে প্রায় ২ হতে ৩ লাখ টাকার ব্যয় বাঁশের বেড়ায় তৈরি ছোট্ট এক ঘরে এই কাঁঠাল ও কলার চিপস তৈরির প্রতিষ্ঠানটির কাজ শুরু করা হয়। ইতিমধ্যে বিভিন্ন ই-কমার্স প্লাটফর্মের মাধ্যমে তাদের উৎপাদিত পণ্যগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিপণন ও প্রচার করা হচ্ছে। প্রতিটি চিপসের প্যাকেটের দাম ধরা হয়েছে ৩০ টাকা করে।
রবিবার বিকালে শহরের আসামবস্তি এলাকায় অবস্থিত চিপস প্রস্তুততকারক প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা যায় উদ্যোক্তা প্রমথ চাকমাসহ বেশ কয়েক জন সহযোগী মিলে মেশিনের মাধ্যমে কাঁঠাল ও কলার তৈরি চিপস প্রক্রিয়াজাত করে প্রস্তুত করতেছে। কাঁঠাল কলা তৈরি চিপস দেখতে গিয়েছেনও বেশ কয়েকজন।
দর্শনার্থী মোহর চাকমা বলেন, বেশ কয়েক মাস ধরে এখানে আমাদের বন্ধুরা কাঁঠাল ও কলার চিপস তৈরির কাজ করতেছে। আজকে আমি নিজেই এসে তাদের চিপসগুলো খেয়ে দেখলাম, আসলে অনেক সুস্বাদু। যেহেতু আমাদের পাহাড়ি ফল কাঁঠাল, কলা সেক্ষেত্রে স্বাদটাও অনেক ভালো। এখনো অনেকে তাদের এই চিপসের সম্পর্কে জানে না এবং খায় নাই তারা হয়তো না খেলে বুঝতে পারবে না যে এই স্বাদটা কেমন। বন্ধুরা যে উদ্যোগটা নিয়েছে এটা খুব ভালো উদ্যোগ।
বৈচিত্র্য ডটকম ই-কমার্সের প্রতিষ্ঠাতা পল্লব চাকমা বলেন, আমরা তাদের সাথে যুক্ত হয়ে তাদের উৎপাদিত চিপসগুলো সারাদেশে বিতরণ, বিপণন ও প্রচার করতেছি অনলাইনের মাধ্যমে। আমরা তাদের চিপসগুলো নিয়ে অনলাইনে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি।
কারখানার ব্যবস্থাপক দীপ্ত দে বলেন, রাঙামাটি শহরে যে সমস্ত স্থানীয় মেলা, অনুষ্ঠানগুলো হয় তাদের চাহিদা অনুযায়ী আমরা পণ্যগুলো তৈরি করে থাকি। এছাড়াও প্রতিদিন প্রায় ২০০ প্যাকেটের মতো গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন করে থাকি।
উদ্যোক্তা প্রমথ চাকমা বলেন, আমাদের এই প্রতিষ্ঠানের তৈরি চিপসের কাঁঠাল ও কলাগুলো স্থানীয় চাষিদের থেকে আমরা সংগ্রহ করে থাকি। আমরা দেখেছি পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক ফলমূল বিশেষ করে কলা, কাঁঠাল পচে নষ্ট হয়ে যায়। চাষীরাও ক্ষতির মুখে পড়ে। সেকারণে আমরা এই ফলগুলো প্রক্রিয়াজাত করে অন্য জিনিসে রূপান্তর করে চিপস তৈরি করার উদ্যোগটা নিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, আমরা প্রথমে ক্ষুদ্র পরিসরে ৩ জন বন্ধু মিলে শুরু করেছি এই উদ্যোক্তা। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে আমাদের একটা চিপস তৈরি মেশিন দেওয়া হয়েছে এবং আমাদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে ডাচ্ বাংলা ব্যাংক। যদিও স্বল্প পরিসরে আমরা এটা শুরু করলেও আস্তে আস্তে গ্রাহকের সাড়া পাচ্ছি। আমরা আপাতত আমাদের এই পণ্যটা এখানকার স্থানীয় বাজার, মেলাও পর্যটন জায়গায় গুলোতে সরবরাহ করতে চাচ্ছি। পরবর্তীতে বৃহত্তর পরিসরে প্রতিষ্ঠানটি বাড়াতে পারলে আমরা জেলা বাইরেও সরবরাহ করবো।
উদ্যোক্তা সুবিমল চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রতিবছর অনেক মৌসুমি ফল নষ্ট হয়ে যায় অবহেলা ও চাষীরা পর্যাপ্ত দাম না পাওয়ার কারণে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে তিন বন্ধু প্রশিক্ষণ নিয়ে এই কাঁঠাল ও কলার চিপস তৈরির উদ্যোগটা আমরা নিয়েছি। আমরা কাঁঠালের উপর বেশি জোর দিয়েছি। যেহেতু কাঁঠাল এক মৌসুমে পাওয়া যায় শুধু। যদি এই কাঁঠালকে আমরা প্রক্রিয়াজাত করে অন্য জিনিসে রুপান্তর করতে পারি তাহলে সারা বছর কাঁঠালের স্বাদটা নিতে পারবো। সবে মাত্র আমরা যাত্রা শুরু করেছি। আমাদের সাথে বিভিন্ন ই-কমার্স অনলাইন প্লাটফর্ম গুলো যুক্ত রয়েছে। মোটামুটি ভালো গ্রাহকের চাহিদার সাড়া পাচ্ছি। বিভিন্ন স্থানীয় উদ্যোক্তা মেলা গুলোতে আমাদের থেকে কাঁঠাল, কলার চিপস সরবরাহ করে।
তিনি আরও বলেন, যদি আমরা এখন ক্ষুদ্র পরিসরে চিপস দিয়ে শুরু করেছি। ভবিষ্যৎতে আমাদের বৃহৎ আকারে করার পরিকল্পনা রয়েছে। তখন আমরা চিপসের পাশাপাশি জুস, জেলি সহ অন্যান্য উপাদান খাদ্য দ্রবগুলোও করবো, সেই সাথে বিদেশেও বেচা কেনা করার চেষ্টা করবো। এখন যদিও কাঁঠালের তেমন মূল্য নেই। আমরা যদি প্রতিনিয়ত এটাকে প্রক্রিয়াজাত করে বাজারজাত করতে পারি তাহলে কাঁঠালের মূল্যটা বাড়তে চাষীরাও লাভবান হবে এবং সেই সাথে আমাদের প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে এই এলাকার একটা কর্মসংস্থান গড়ে উঠবে।
রাঙামাটি চেম্বার অব কর্মাস এন্ড ইন্ডাস্ট্রি’র সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, এটা খ্বুই ভালো উদ্যোগ। এধরনের উদ্যোক্তারা যদি আমাদের সাথে যোগাযোগ করে তাহলে আমরা তাদেরকে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ পেতে সহায়তা সহ বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকি।