শংকর হোড় ॥
কার্প জাতীয় মাছের বংশবৃদ্ধি এবং অবমুক্ত করা পোনার স্বাভাবিক বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিবছর কাপ্তাই হ্রদে তিন মাস মৎস্য আহরণ, বিপনন ও বাজারজাতকরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় স্থানীয় প্রশাসন। হ্রদে বৃষ্টি কম হলে এই নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ অনেক সময় বৃদ্ধি করা হয়। আগস্ট কিংবা সেপ্টেম্বরে মাছ আহরণে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর প্রথম দুই থেকে তিন মাস হ্রদ থেকে মাছ ভালো আহরণ হলেও শীতের মৌসুম আসতেই হ্রদে মাছের পরিমাণ কমে যায়। এছাড়া এসময় ছোট মাছগুলোতে ডিম আসে। ডিমওয়ালা মা মাছ সংরক্ষণের জন্য কাপ্তাই হ্রদে মে থেকে জুলাইয়ে মাছ আহরণ বন্ধের পাশাপাশি নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসেও ৪৫-৬০দিন মাছ আহরণ বন্ধ রাখার দাবি জানিয়েছেন খোদ মৎস্য ব্যবসায়ীরা। বৃহস্পতিবার বিএফডিসি ঘাটে মাছের পোনা অবমুক্তকরণ ও জেলেদের মাঝে ভিডিএফ চাল বিতরণকালে রাঙামাটি মৎস্য ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক উদয়ন বড়–য়া উপস্থিত নেতৃবৃন্দের কাছে এই দাবি জানান।
বিএফডিসি রাঙামাটি কার্যালয়ের আয়োজনে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাহিদ রশীদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন খাদ্য মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি দীপংকর তালুকদার এমপি। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএফডিসি’র চেয়ারম্যান কাজী আশরাফ উদ্দিন, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, বিএফডিসি রাঙামাটি অঞ্চলের ব্যবস্থাপক কমান্ডার আশরাফুল আলম ভূঁইয়া, নৌ পুলিশ চট্টগ্রাম অঞ্চলের পুলিশ সুপার আ.ফ.ম নাহিদ উদ্দিন. অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহ নেওয়াজ রাজু।
আরো দুই মাস মৎস্য আহরণ বন্ধের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাঙামাটি মৎস্য ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক উদয়ন বড়–য়া বলেন, নভেম্বর, ডিসেম্বর মাসে কাপ্তাই হ্রদে ছোট মাছ যেমন-বাটা, ছোট চিংড়ি, চাপিলা, কেচকি, মলা, ঢেলা, কালো টেংরাসহ ছোট ছোট আরো বিভিন্ন মাছের ডিম আসে। এসময় জেলেরা মাছ আহরণ করে ড্রামে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। ফিসারি ঘাটে পল্টনে এসব ডিমওয়ালা মাছ দেখার পর বিএফডিসি কর্র্তৃপক্ষ এগুলো আমাদের বিক্রি করতে দেয় না। যার ফলে মাছগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এতে আমাদের সকলেরই ক্ষতি। এই ক্ষতি থেকে বাঁচতে আমরা এমন সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছি। পাঁচ মাস হ্রদে মাছ আহরণ বন্ধ থাকলেও সঠিকভাবে মা মাছের বংশবৃদ্ধি করা গেলে বাকি সাত মাস আমরা খুব ভালোভাবে ব্যবসা করতে পারবো।
তিনি আরো বলেন, যত্রতত্র অভয়াশ্রম করা হয়েছে। কিন্তু সীমানা নির্ধারণ না থাকায় যারা নতুন জেলে তারা অভয়াশ্রমে মাছ শিকার করছে। এজন্য অভয়াশ্রমে সীমানা চিহ্নিত করে এর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি।
এছাড়া অনুষ্ঠানে তিনি আরো বলেন, কাপ্তাই হ্রদে চলমান কাচকি জালগুলোর দৈর্ঘ্যে ১৫০০ ফুট এর মধ্যে নির্ধারণ করে এই বছর থেকে কার্যকরের আবেদন জানান। এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে ৭০-৮০ ফুট জাল দিয়ে কাচকি মাছ ধরা হত। কিন্তু বর্তমানে কিছু ব্যবসায়ী প্রায় ৪-৫হাজার ফুট কাচকি জালও দিয়ে মাছ ধরছে। এতে মা জাতীয় মাছ ও কার্প জাতীয় মাছ ধরা পড়ছে। ফলে মৌসুমের প্রথম দিকে কয়েকমাস ভালো মাছ পাওয়া গেলেও বাকি সময়ে বসে থাকতে হচ্ছে। আমরা এটা সর্বোচ্চ ১৫০০ফুট করার দাবি জানিয়েছি। এটা শীঘ্রই নির্ধারণ করা না গেলে হ্রদ অচিরেই মাছশূন্য হয়ে পড়বে।
বন্ধকালীন নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে মৌসুম শুরুর প্রথম দিকে প্রক্রিয়াগত ও বাজারজাতগত কারণে অনেক মাছ অপচয় হয় এবং বাধ্য হয়ে অনেক মাছই ফেলে দিতে হয়। এই অপচয় কাটানোর জন্য মৌসুমের শুরুতে মাছ আহরণের সময় নির্ধারণ করে দিলে মাছ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না বলে তিনি জানান। ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে পল্টনে মাছ প্রক্রিয়ার জন্য পর্যাপ্ত প্যাকিং শেড বৃদ্ধি করা হয় নাই। তাছাড়া বিদ্যমান প্যাকিং শেডটি পুরোনো হওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণভাবে ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা কাজ করছে। তাই বর্তমান শেডটি ভেঙ্গে নতুন করে আরো বড় পরিসরে শেড তৈরির আবেদন জানানো হয়। কাপ্তাই হ্রদে মৎস্য পোনা অবমুক্তকরণ ও বন্ধকালীন জেলেদের ভিডিএফ কার্ডের মাধ্যমে খাদ্যশস্য বিতরণ কমিটিতে জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীদের অন্তর্ভূক্ত করার দাবি জানানো হয়। হ্রদে কারেন্ট জাল ও ঠুইট্যা জালের অবৈধ ব্যবহারে বিএফডিসির আরো কঠোর হওয়ার আহ্বান জানান ব্যবসায়িক নেতারা। এছাড়া প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মাছের ওপর আরোপিত অসহনীয় রয়েলটি(রাজস্ব) পুনর্বিবেচনা করে সহনীয় পর্যায়ে নির্ধারণেরও দাবি জানান ব্যবসায়ীরা।
মৎস্যব্যবসায়ীদের দাবি-দাওয়ার বিষয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দীপংকর তালুকদার এমপি বলেন, জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীদের দাবিগুলো যথাযথভাবে পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যাতে উদ্যোগ নেয়, সে আহ্বান থাকবে। কাপ্তাই হ্রদ বিশাল মৎস্যভান্ডার। এই মৎস্যভান্ডার আমাদের সকলের সহযোগিতায় রক্ষা করা সম্ভব। কাচকি জাল ব্যবহারে এবং হ্রদে বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ মাছের পোনা অবমুক্ত করার জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দেন।
বিএফডিসি সূত্র জানায়, মাছ আহরণ বন্ধ মৌসুমে কাপ্তাই হ্রদে ৭০মেট্রিকটন কার্প জাতীয় মাছের পোনা অবমুক্ত করা হবে এবং ২৬,৪৫৯ জেলের মাঝে ২০ কেজি করে তিন মাসের ভিজিএফের চাল বিতরণ করা হবে।