কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টির ৬০ বছর পর এক নানিয়ারচর সেতুতেই স্বপ্ন বুনছে রাঙামাটি জেলার দুর্গম তিন উপজেলার মানুষ। চেঙ্গি নদীর ওপর ৫০০ মিটার দীর্ঘ এই সেতু দিয়ে শুধু নানিয়ারচর উপজেলায় নয়, সহজেই যাওয়া যাবে লংগদু ও বাঘাইছড়ি উপজেলায়। অথচ এক সময় নানিয়ারচর উপজেলা সদরে যাওয়ার মতো সরাসরি কোনও সড়ক ছিল না। নৌ পথে যেতে দুই ঘণ্টা সময় লাগতো, এখন এক ঘণ্টারও কম সময়ে নানিয়ারচর সদরে সড়ক পথে যাওয়া যাচ্ছে। একই সাথে বাঘাইছড়ি ও লংগদু উপজেলায় সড়ক পথে যাওয়ার জন্য রাঙামাটি থেকে খাগড়াছড়ি হয়ে যেতে হতো। কিন্তু পার্বত্যাঞ্চলের সবচে দীর্ঘ এই সেতু নির্মাণ হওয়ায় তিন উপজেলার মানুষ সহজেই জেলা সদরের সাথে যাতায়াতের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই একটি সেতুতেই দুর্গমতা ঘুচছে তিন উপজেলার। পাশাপাশি খুব সহজেই সাজেকে চলে যাওয়া সম্ভব হবে। তবে নানিয়ারচর থেকে লংগদু ১৮ কিলোমিটারের সড়কটি এখনো না নির্মাণ হওয়ায় লংগদু ও বাঘাইছড়িবাসী সেতু উদ্বোধনের দিন থেকে এর সুবিধা পাচ্ছে না।
সরাসরি রাঙামাটি-নানিয়ারচর-লংগদু-বাঘাইছড়ি সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ১৯৯৩ সালে নানিয়ারচর অংশে চেঙ্গি নদীর ওপর সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। অবশেষে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নানিয়ারচরের চেঙ্গি নদীর ওপর সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। মন্ত্রীর ঘোষণার দুই বছর পর ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে শুরু হয় সেতু নির্মাণের কাজ। এটি বাস্তবায়নে কাজ করছে সেনাবাহিনীর ১৯ ইঞ্জিনিয়ারিং কন্সট্রাকশন ব্যাটেলিয়ান (ইসিবি)।
রাঙামাটি থেকে বর্তমানে বাঘাইছড়িতে সড়ক পথে যেতে পাড়ি দিতে হয় প্রায় ১৫০ কিলোমিটার পথ। সময় লাগে প্রায় ৬-৭ ঘণ্টা। তাছাড়া সরাসরি বাস সার্ভিস চালু না থাকায় এই সময় আরো বেশি লাগে। তাই কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টির পর নৌ-পথেই উপজেলাবাসীকে জেলায় যাতায়াত করতে হতো। তাতেও সময় লাগতো প্রায় ৬-৭ ঘণ্টা। একইভাবে রাঙামাটি থেকে সড়ক পথে লংগদু যেতেও প্রায় ১৪০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। সময়টাও লাগে ৫-৬ ঘণ্টা। এই উপজেলার সাথেও রাঙামাটি সদরের কোনও বাস সার্ভিস চালু নেই। নৌ-পথেই একমাত্র ভরসা। কিন্তু নানিয়ারচরের চেঙ্গি সেতুর মাধ্যমে সেই দুর্গমতা অনেকাংশে ঘুচিয়ে যাচ্ছে। রাঙামাটি থেকে নানিয়ারচরের দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। নানিয়ারচর থেকে লংগদু সদরে দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার এবং বাঘাইছড়ির দূরত্ব ৩০ কিলোমিটারের মতো। এতে ঘণ্টা বা দেড় ঘণ্টার মধ্যে সরাসরি লংগদু বা বাঘাইছড়ি যাওয়া সম্ভব হবে।
নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান প্রগতি চাকমা বলেন, এই এক সেতুর মাধ্যমে আমাদের অনেক দিনের স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। আমরা এখন খুব সহজেই জেলা সদরে যাতায়াত করতে পারবো। তাছাড়া এলাকার উৎপাদিত কৃষি পণ্যের পরিবহন ও বাজারজাত সহজ হবে। একই সাথে বাকী দুই উপজেলা লংগদু, বাঘাইছড়ি হয়ে আমরা সাজেকেও চলে যেতে পারবো।
বাঘাইছড়ি উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দীন বলেন, আমাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল বাঘাইছড়ির সাথে রাঙামাটির সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপন হোক। আমাদের এখন খাগড়াছড়ি হয়ে রাঙামাটিতে আসা-যাওয়া করতে হয় যা সময়সাপেক্ষ। কিন্তু চেঙ্গি সেতুর মাধ্যমে আমাদের এতোদিনের যে সমস্যা সেটা দূর হচ্ছে। আমরা ঘণ্টা-দেড় ঘণ্টার মধ্যে রাঙামাটি পৌঁছতে পারবো। তবে নানিয়ারচর সেতুর কাজ শেষ হলেও বাঘাইছড়ি থেকে লংগদু যেতে যে সড়কটির কাজ চলছে, সেটা নিয়ে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, উপজেলাবাসী প্রহর গুনছে কখন এই সড়কটি দিয়ে যাওয়া আসা করবে কিন্তু সড়কটি কাজ এখনো অসমাপ্ত রয়েছে, কিছু সেতুর কাজও অসমাপ্ত রয়েছে। পাশাপাশি রাস্তার কাজও নিম্নমানের বলে তিনি অভিযোগ করেন।
লংগদু উপজেলার স্থানীয় সাংবাদিক আরমান খান বলেন, এক সেতুতেই আমাদের তিন উপজেলার ভাগ্য পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। কিন্তু লংগদু থেকে নানিয়ারচর রাস্তার কাজটি এখনো না হওয়ায় সেতু হওয়ার পরও আমরা সেতু দিয়ে চলাচল করতে পারবো না। তিনি বলেন, সরকারের এতো উন্নয়ন কাজ হচ্ছে, কিন্তু কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টির ৬০ বছর পর আমরা সরাসরি রাঙামাটির সাথে সরাসরি সড়ক পথে যোগাযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনার পরও ১৮ কিলোমিটারের একটি সড়কের জন্য এখন আরো অপেক্ষার প্রহর কাটাতে হবে।
সেতু নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের তথ্য মতে, ৫০০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১০.২ মিটার প্রস্থের এই সেতু নির্মাণে প্রায় ১২০ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে এবং ২ কিলোমিটার সড়ক সংযোগের জন্য ১০০ কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৪৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ব্যয় করা হয়। ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
সেতু নির্মাণকারী সংস্থা মনিকো লিমিটেডের প্রজেক্ট ম্যানেজার প্রকৌশলী প্রদীপ কুমার পাল জানিয়েছেন, প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ। সহসাই সেতুটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে।