মো: জয়নাল আবেদীন, কাউখালী
কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা শান্তিমনি চাকমা। পারিবারিক অসচ্ছলতা মধ্যে থেকেও খেলাধুলায় মগ্ন থাকতেন তিনি। বিভিন্ন প্রতিক‚লতায় নিজের ফুটবল ক্যারিয়ার বেশিদুর এগিয়ে নিয়ে যেতে না পাড়লেও পাহাড়ের আনাচে কানাকে লুকিয়ে থাকা প্রতিভাবান নারী ফুটবল খেলোয়ারদের ক্যারিয়ার গড়তে, জাতীয় নারী দলের ফুটবলার তৈরীতে বিশেষ ভুমিকা রাখছে ফুটবল কোচ শান্তি মনি চাকমা। নাম মাত্র সম্মানিতে কোচিং করালেও, সে সম্মানিও মেলেনা প্রতি মাসে! তাতে আক্ষেপও নেই তার।
নিজের ক্যারিয়ার, কোচিং শুরুর সময় ও বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথা হয় জাতীয় নারী দলের ৫ তারকা ফুটবলার ঋতুপর্ণা, আনাই, আনু, রূপনা, মনিকাদের প্রথম গুরু প্রতিভাবান এই কোচের সাথে। এই প্রতিবেদকের সাথে শেয়ার করেন সুখ, দুঃখ, আক্ষেপ ও স্বপ্নের কথা।
শান্তিমনি চাকমার পারিবারীক জীবন:
শান্তিমনি চাকমা। পরিবার নিয়ে বসবাস করেন উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের দেওয়া পাড়া এলাকায়। এক ছেলে ও এক মেয়ে সন্তানের জনক ছিলেন তিনি। বছর ২ আগে কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় বড় মেয়ে নৃত্য শিল্পী শিল্পা চাকমা। ছোট ছেলে কাপ্তাই নৌবাহিনী স্কুল এন্ড কলেজ এর দশম শ্রেণীর ছাত্র। শান্তিমনি চাকমার মূল পেশা ব্যবসা হলেও দিনের বড় একটা সময় ব্যয় করেন ক্ষুদে ফুটবলারদের সাথে মাঠেই। মাঠের সময়টা খুব উপভোগও করেন তিনি।
যেভাবে শুরু হয় ফুটবল কোচিং:
ক্রীড়া প্রেমি শান্তি মনি চাকমা বিভিন্ন প্রতিক‚লতার কারণে ফুটবলে নিজের ক্যাারিয়ার গড়তে না পাড়লেও ২০১১ সালে এলাকার ক্রীড়া প্রেমি প্রতিভাবান ফুটবলারদের স্বপ্নপূরণ ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব প্রাথমিক গোল্ড কাপ টুর্নামেন্টকে সামনে রেখে শুরু করেন ফুটবল কোচিং। ১৫ জন প্রাইমারি লেভেরের শিক্ষার্থীদের নিয়ে শুরু করেন ফুটবল কোচিং। শুরু সময়টা শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের থেকে বিভিন্ন বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। প্রশ্ন তুলতো মেয়েরা কিভাবে ফুটবল খেলবে। দুই এক বছর যাওয়ার পর থেকে এমন বাঁধার মুখে আর পড়তে হয়নি। ২০১১ থেকে ২০২৪। এই এক যুগের ফুটবল কোচিং ক্যারিয়ারের ছিলো নানা প্রতিবন্ধকতা, অভাব, দুঃখের সময়। সুখের স্মৃতি, সুখের কারণও আছে শতশত।
সফলতা:
কোচিং শুরুর বছরেই সফলতা আসে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব প্রাথমিক গোল্ডকাপ টুর্নামেন্ট দিয়ে। তার তত্ত¡াবধানে থাকা প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ২০১১ সালে হয় জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন। ২০১২ সালে একই টুর্নামেন্টে জাতীয় পর্যায়ে রানারআপ হয় স্কুলটি। ২০১৩ সাল থেকে ১৫ সাল পর্যন্ত গ্রীষ্মকালীন স্কুল ভিত্তিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতায় ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয় টানা ৩ বার জাতীয় পর্যায়ে রানার আপ হয়। ২০১৬ সালে হয় চ্যাম্পিয়ন। একই ধরনের প্রতিযোগীতায় ২০১৭ থেকে ২০২১ এবং ২০২৩ সালে জাতীয় পর্যায়ে রানার আপ হয় তার কোচিংয়ে থাকা ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয় নারী দল। বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলে সুযোগ পেয়েছে ঋতুপর্ণা, মনিকা, রূপনা, আনাই ও আনু মগিনী। বিভিন্ন লীগে খেলছেন ডজনেরও বেশি নারী খেলোয়াড়।
আনন্দের সময়:
বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল যখন সাব চ্যাম্পিয়ন হয় তখন তার ৫ শিষ্য দারুন ফর্মে ছিলো। ঋতুপর্ণা, মনিকা, রূপনা, আনাই ও আনু মগিনী সহ এদের তৈরীতে যাদের অবদান ছিলো তাদের রাজকীয় সংবর্ধনা দেয় রাঙামাটি জেলা প্রশাসক, জেলা পরিষদ, রাঙামাটির সাংসদ সহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষজন। এটি তার জীবনের একটি বিশেষ সুখকর সময়।
আক্ষেপ:
২০১৬ সালে গ্রীষ্মকালীন স্কুল ভিত্তিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতার সময় আর্থিক ভাবে খুবই সংকটে পড়েছিলেন। খেলোয়াড়দের বুটজুতা সেলাই করে করে মাঠে অনুশীলন করিয়েছেন। একজন ফুটবল খেলোয়াড়ের যা যা প্রয়োজন তা সব ছিলোনা খেলোয়াড়দের। ভালো খেলা উপহার দিতে হলে শারীরিক ভাবে ফিট থাকা জরুরী। খেলায়ারদের জন্য প্রয়োজন প্রয়োজনীয় পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার। অনুশীলনের পরে এক বেলা নাস্তাও খাওয়াতে না পাড়ার আক্ষেপের কথা জানালেন তিনি। জানালের ২০২৩ সালে অনুর্ধ ১৭ বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টে ভালো ভালো খেলোয়াড় থাকার পরও কাউখালী উপজেলা টিম কোন খেলোয়াড় না নেওয়ার আক্ষেপ। বিষয়টি খুব কষ্ট লেগেছে এই কোচের।
উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সম্পৃক্ততা:
শান্তিমনি চাকমা কাউখালী উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার একজন সদস্য জানিয়ে তিনি জানান, ওভাবে উপজেলা ক্রীড়া সংস্থা থেকে কোন খোঁজ খবর নেওয়া হয়নাই। তবে উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে গত বছর উপজেলা চেয়ারম্যান সামশুদোহা চৌধুরী খেলোয়াড়দের বুটজুতা ও খেলার সামগ্রী দিয়েছেন।
স্বপ্ন: পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যার কারণে নিজের ফুটবল ক্যারিয়ার গড়ে না পড়ালেও ফুটবল প্রেমি প্রতিভাবানদের নিয়ে জাতীয় পর্যায়ের খোলোয়ার তৈরী করা। স্বপ্ন দেখেন ভবিষ্যতে মেয়েদের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দায়িত্ব নিবেন জেলা, উপজেলা প্রশাসন বা বৃত্তবান কেউ।