শংকর হোড় ॥
রাঙামাটি সদরের সাপছড়ি ইউনিয়নের দুর্গম নারাইছড়ি গ্রাম। সাপছড়ি এলাকার রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সড়ক থেকে প্রায় ঘণ্টাখানেক পাহাড়ি পথে হেঁটে এই গ্রামে যেতে হয়। উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ হওয়ায় কোনও গাড়ি যেতে পারে না। গ্রামে প্রায় পাঁচশ মানুষের বসবাস। আর এই গ্রামে একটি ছড়ার ওপর গ্রামের প্রায় ১১৩টি পরিবার নির্ভরশীল। কিন্তু শুকনো মৌসুমে ছড়াটি শুকিয়ে যায়। এতে খাবার পানিসহ ব্যবহার্য পানির তীব্র কষ্টে ভুগে এই গ্রামের মানুষ। নারাইছড়ি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, গ্রামের সবকয়টি পরিবার কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কৃষিকাজে পানি ব্যবহার করা হয় পাশের ছড়া থেকে। কিন্তু ছড়া শুকিয়ে যাওয়ায় অনেক জমি ফাঁকা পড়ে রয়েছে। গ্রামের মহিলারা দূর-দূরান্ত থেকে এসে একটি কুয়া থেকে প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করছে। এই পানি দিয়ে চলে পান করা থেকে ঘরের রান্না-বান্না ও ব্যবহারের কাজে। বর্ষা মৌসুমে ছড়ায় পানি থাকলেও শুকনো মৌসুমে ছড়া শুকিয়ে যাওয়ায় দুর্ভোগে পড়তে হয় বেশি এমনটাই জানালেন গ্রামবাসী।
তবে এই চিত্র শুধুই নারাইছড়ি গ্রামের নয়। পুরো রাঙামাটির বেশিরভাগ পাহাড়ি অঞ্চলেই এই কষ্টে ভুগছে মানুষ। প্রাকৃতিক উৎস ধ্বংসের কারণে শুকনো মৌসুমে পানির জন্য কষ্ট পেতে হচ্ছে জানালেন গ্রামের মানুষ। পাহাড়ে বসবাসের কারণে সারাবছর এসব গ্রামবাসীকে স্থানীয় ঝিরি-ঝর্নার পানির ওপর নির্ভর হয়ে জীবনধারণ করতে হয়। ঘরের সব কাজসহ পানি পানের জন্য এ ঝিরি-ঝর্নার পানি ব্যবহার করা হয়। সাধারণত বর্ষার সময় থেকে শীত মৌসুম পর্যন্ত ঝিরি-ঝর্না থেকে পানি সংগ্রহ করা গেলেও মাঘ-ফাল্গুন থেকে পাহাড়ে সুপেয় পানির সঙ্কট দেখা দেয়। সরকারের উদ্যোগে দুর্গম কিছু কিছু পাহাড়ি গ্রামে রিংওয়েল ও টিউবওয়েল স্থাপন করা হলেও শুকনো মৌসুমে এসব থেকে পানি পাওয়া যায় না। গ্রামবাসী আশপাশের নিচু জায়গায় কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করলেও শুকনো মৌসুমেও এসব কুয়া শুকিয়ে যায়। গ্রীষ্মের এই দাবদাহে আধ ঘণ্টা হেঁটে পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে অনেকে কাপ্তাই হ্রদ থেকে পানি সংগ্রহ করে আবার অনেকেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে পাশের গ্রাম কিংবা হ্রদ থেকে পানি সংগ্রহ করছে। এই যেন এক কলসির ঘামের দামে এক কলসি পানি সংগ্রহ-এমনই অবস্থা পাহাড়ি গ্রামে বসবাস করা এসব মানুষের। হ্রদের পানি ফুটিয়ে পান করতে পারলেও শুকনো মৌসুমের কারণে হ্রদের পানিও একেবারে কমে গেছে। তবে সরকারি হিসেবে, জেলায় ৫৮ ভাগ মানুষ সুপেয় পানির আওতায় এসেছে বলে দাবি করা হয়েছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বছরের অর্ধেক সময় বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে জেলার ৭০ ভাগ মানুষ পানির অভাবে ধুকছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, রাঙামাটি ১০ জেলার মধ্যে বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ির প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের পানির সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। এসব এলাকার মানুষ বেশিরভাগই পাহাড়ের ওপরই বসবাসের কারণে গভীর নলকূপও স্থাপন করা সম্ভব হয় না। কিছুটা নিচু জায়গায় পানির স্তর পাওয়া গেলেও সেখান থেকেও পানি সংগ্রহ করতে কষ্ট হয় এসব মানুষের। তারপরও শুকনো মৌসুমে ঝিরি-ঝর্না শুকিয়ে যাওয়ার কারণে পানির স্তরও পাওয়া যায় না। একসময় সারাবছরই এইসব গ্রামের মানুষ পার্শ্ববর্তী ঝিরি-ঝর্নার পানির ওপর নির্ভরশীল থাকলেও নির্বিচারে বন উজাড়, সেগুন গাছের আধিপত্যসহ আরো নানান কারণে শুধুমাত্র বর্ষা মৌসুমেই ঝিরি-ঝর্নাগুলোতে পানি পাওয়া যায়। তাই তো শুকনো মৌসুম শুরু হলে এসব গ্রামের মানুষের কাছে এক কলসি পানি যেন সোনার হরিণ। আর সেটা যদি সুপেয় পানি হয় তাহলে তো কথায় থাকে না। বিশেষজ্ঞরাও জানিয়েছেন, মূলত সমতলের পদ্ধতি ব্যবহার করে পাহাড়ে সুপেয় পানির সংকট নিরসন করা সম্ভব না। পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ও পাথুরে এলাকা হওয়ায় ভুগর্ভস্থ পানির স্তর সঠিক মতো পাওয়া যায় না। যার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে গভীর ও অগভীর নলকূপ স্থাপনের মধ্য দিয়েও পুরোপুরি পানি সঙ্কট সমাধান সম্ভব নয়। এজন্য গবেষণার প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।
নারাইছড়ি গ্রামের বাসিন্দা সুমিতা চাকমা বলেন, শীতের পর থেকে গ্রামে পানির কষ্ট বেড়ে যায়। পাশের ঝিরি থেকে অন্যান্য সময় পানি পাওয়া গেলেও শুকনো মৌসুমে সেটাও থাকে না। ছড়া শুকিয়ে সড়কের মত হয়ে যায়। তাই তো ঘণ্টাখানেক পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে পাশের গ্রাম থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়। প্রতিদিনের ¯œানও হয় না বলে জানান তিনি।
এদিকে কাপ্তাই হ্রদেও পানি সঙ্কটের কারণে সুপেয় পানির সমস্যা আরো তীব্র হয়েছে। হ্রদ থেকে পরিষ্কার পানি নিয়ে ফুটিয়ে পান করার জন্যও বেগ পেতে হচ্ছে। শুকনো মৌসুম হওয়ায় পানির স্তর একেবারে নি¤œস্তরে রয়েছে। এজন্য অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে হ্রদের পানি দেখা মিলছে। কাপ্তাই হ্রদের রুলকার্ভ অনুসারে পানির স্তর বর্তমানে থাকার কথা ৮১ এমএসএল(মিনস সি লেভেল)। কিন্তু কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে হ্রদে পানির স্তর রয়েছে ৭৬ এমএসএল। অর্থাৎ বর্তমানের সময়ের তুলনায় আরো পাঁচ ফুট পানি কম রয়েছে কাপ্তাই হ্রদে। কাপ্তাই হ্রদে সর্বনি¤œ পানির স্তর ৬৮ এমএসএল।
বরকল উপজেলাধীন সুবলং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তরুণজ্যোতি চাকমা বলেন, পাহাড়ি গ্রামগুলোতে রিংওয়েল, টিউবওয়েল বসিয়ে বছরের অন্যান্য সময় পানি পাওয়া গেলেও শুকনো মৌসুমে পানি নেই বললেই চলে। এসময় দূর-দূরান্তে যেসব ঝর্নায় পানি পাওয়া যায়, সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করে এখানকার মানুষ। তিনি বলেন, এই সঙ্কট কাটাতে পানির উৎসস্থলে বনায়ন ও বাঁশ লাগাতে হবে। না হলে দীর্ঘমেয়াদের এর সমস্যা সমাধান করা যাবে না। এছাড়া বাঁধ দিয়ে পানি ধরে রেখে গ্রামে গ্রামে পানি পৌঁছানোর মাধ্যমেও এর সমাধান করা সম্ভব। তবে ঝিরি-ঝর্নাগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় সেই সম্ভাবনাও কমে আসছে। তাঁর ইউনিয়নের মধ্যে কৈকরকিং মারমা পাড়া, মোনপাড়া, হাজাছড়া, হিলছড়ি এলাকায় পানির কষ্ট সবচে বেশি বলে জানান তিনি।
রাঙামাটি জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী পরাগ বড়–য়া বলেন, দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় এখানে পানির ব্যবস্থা করা সমতলের চাইতে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ। তারপরও আমরা সাধারণ মানুষের কাছে খাবার পানি পৌঁছে দিতে কাজ করে যাচ্ছি। সাজেকে পানির কষ্ট সবচে বেশি। সেখানে পাইপ নেটওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে পাম্প হাউজ, বুস্টার হাউজ স্থাপনের মাধ্যমে পানি সরবরাহের একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিদ্যুৎবিহীন এলাকায় সোলারের মাধ্যমে সাবমারসিবল পাম্পের মাধ্যমে পানি উত্তোলনের চেষ্টা চলছে। জেলায় ৫৭-৫৮ভাগ মানুষ সুপেয় পানির আওতায় এসেছে বলে তিনি জানান।