পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে বরাবরই অপরাজনীতির চেষ্টা হচ্ছে অভিযোগ করে নবনির্বাচিত সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার বলেছেন, এখানকার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবো এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগলিক অখন্ডতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা রাখাই হচ্ছে আমার প্রথম কাজ। জাতীয় রাজনীতিকে প্রতিহত করে এখানে যেভাবে ভিন্ন রাজনৈতিক ধারা বাস্তবায়নের অপচেষ্টা চলছে তাও প্রতিহত করা হবে। এটার জন্য অবৈধ অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি, খুন-খারাবি, বিভাজন নীতি ও নেতিবাচক রাজনীতি বন্ধ করতে কাজ করে যাবো। সরকার শান্তি চুক্তি নিয়ে আন্তরিক, তিনি বেক্সিটের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, বেক্সিট বিষয়ে সিদ্ধান্ত হওয়ার আড়াই বছর পর এখনো তারা সিদ্ধান্তই নিতে পারেনি, তারা কোথা থেকে শুরু করবে। সে জায়গায় শান্তি চুক্তি বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহ করা উচিত নয়। পজিটিভ চিন্তাভাবনা নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান সাবেক এই পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী। তিনি নির্বাচনোত্তর দৈনিক পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পাহাড়টোয়েন্টিফোর ডট কম’র সাথে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, আঞ্চলিক সংগঠন জনসংহতি সমিতি দীর্ঘদিন ধরে চাইছে তিন পার্বত্য জেলার সব জাতীয় রাজনৈতিক দল তাদের কথায় চলবে। এক্ষেত্রে তারা বিএনপিকে হাতে নিতে পেরেছে। যার প্রমাণ ২০০১ সালে ও এবারের নির্বাচনেও জনগণ দেখেছে। এবারের নির্বাচনও তাদের আ্যরেঞ্জ নির্বাচন ছিল। তাদের চেষ্টা ছিল একে অন্যকে সাপোর্ট করবে। এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম আওয়ামীলীগ। আওয়ামীলীগ তাদের অন্যায় আবদারের কাছে মাথা নত করেনি। তাদের সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার সাথে যুক্ত থাকেনি। আর এজন্য তাদের টার্গেট ছিল আওয়ামীলীগ। এখানে শুধুমাত্র দীপংকর তালুকদারই তাদের একমাত্র টার্গেট নয়। আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরাই তাদের মূল টার্গেট। তাদের হত্যার মাধ্যমে দলটি পাহাড় থেকে আওয়ামীলীগকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়। তাইতো এবার সাধারণ জনগণ তাদের এই চাওয়াকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নৌকাকে বিশাল ব্যবধানে বিজয়ী করেছে। এখানে জাতীয় রাজনীতির চর্চা থাকবে নাকি স্থানীয় স্রোতের কাছে জাতীয় দল আত্মসমর্পণ করবে এমন প্রশ্ন সামনে চলে আসায় সাধারণ জনগণ নৌকাকেই বেছে নিয়েছে।
অবৈধ অস্ত্র ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুধুমাত্র নির্বাচনকেন্দ্রিক ছিলো না। এটি এখনো চলমান থাকবে। যতক্ষণ পাহাড় থেকে অবৈধ অস্ত্র ও চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ হবে না, ততদিন এই আন্দোলন চলবে। এই আন্দোলন সার্বজনীন। সাধারণ মানুষের স্বাধীনভাবে চলাচল, মুক্তভাবে বাঁচার যে অধিকার সে অধিকার প্রতিষ্ঠাই এই আন্দোলন। আন্দোলনের ফলে এখন ভিকটিমরা মামলার করার সাহস পাচ্ছে। আগে যেখানে পিতাকে মারলে পুত্র মামলা করতো না, এখন তারা সাহস করে এসে মামলা করছে। আন্দোলনের এটাই ইতিবাচক দিক……দীপংকর তালুকদার
ছয় বার নির্বাচনে অংশ নিয়ে চারবার সাংসদ হওয়া দীপংকর বলেন, জনসংহতি সমিতি দীপংকর তালুকদারকে নয় সার্বিকভাবে তারা আওয়ামীলীগকে হারানোর চেষ্টা করছে। ২০১৪ সালে নির্বাচনে তারা জয়ী হওয়ার পর তারা অনেক কিছুরই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। পানি কমাবে, ইলেকট্রিসিটি বাড়াবে, রাস্তাঘাট করবে। কিন্তু এসব উন্নয়ন কাজে তারাই প্রধান বাধা ছিলো। মেডিকেল কলেজ ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় চায় না বলে তারা রক্ত ঝরাল, এদিকে রাস্তাঘাট করতে দিবে না, ঐদিকে অমুক প্রতিষ্ঠান হবে না এমন ভাবেই চলছে তাদের রাজনীতি। একটা নেতিবাচক বৃত্তের মধ্যে আটকা রয়েছে তাদের রাজনীতি। নেতিবাচক বৃত্ত থেকে বের হয়ে ইতিবাচক রাজনীতিতে আসার আহ্বান জানিয়ে দীপংকর তালুকদার বলেন, গতবার হারানোর পর তাদের মনে হলো পরেরবার তারা নৌকা নিয়ে নির্বাচন করতে পারবে। গতবার যেহেতু নৌকা হেরে গেছে, তাই এবার নৌকা নিয়ে নির্বাচন করার তাদের অনেক ইচ্ছে ছিল। তবে তাদের সে আশা পূরণ হয়নি। এবার যদি আমরা হারতাম, তাহলে নৌকা তারা নিয়ে যেতো। কিন্তু এবারের জয়ে আর নৌকাকে কেউ নিয়ে যেতে পারবে না।
তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। তাই তো কে মন্ত্রীত্ব পেলো আর কে মন্ত্রীত্ব পায়নি, এটা বড় বিষয় নয়। সারা দেশে সমহারে উন্নয়ন হবে। তবে গতবার জনসংহতি সমিতির নেগেটিভ আচরণের কারণে হয়তো এই এলাকায় সার্বিক উন্নয়ন হয়নি। কিন্তু এবার সেটা হবে না। উন্নয়নে পিছিয়ে থাকবে না কোনও জেলা।
দীপংকর তালুকদার বলেন, গত নির্বাচনে হারার পর পাঁচটি বছর খুবই অস্বস্তিতে ছিলাম। সাধারণ জনগণের এসময় যে প্রত্যাশা সেটা পূরণ করতে না পারা, জনসংহতি সমিতির সাবেক বলে বলে চিৎকার চেঁচামেচি ছিল। কিন্তু এই নির্বাচনের মাধ্যমে এই অস্বস্তির কাটা উপড়ে ফেলতে পারলাম। তিনি বলেন, রাজনীতিবিদরা সাবেকদের মূল্য দেয় না। রাজনীতিতে সাবেকের কোনও মূল্য নেই। অন্যান্য সরকারি চাকরিতে সাবেকদের যে মূল্য থাকে, এখানে সেটা থাকে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে যতজন সাংসদ আছে, তার তুলনায় প্রাক্তন সাংসদ আরো বেশি আছে। তখন যে তারা সাবেক বলে বলে আমাকে হেনস্তা করার চেষ্টা করতো, তাহলে এখন ঊষাতন তালুকদার তো সাবেক হয়েছেন? এখন উনি কী করবেন?
দীপংকর তালুকদার বলেন, সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য ফিরিয়ে আনার জন্য কর্মসৃজন করা হবে। রাস্তাঘাট, ইলেকট্রিসিটি উন্নয়ন, পর্যটন, আত্মকর্মসংস্থানমূলক বিভিন্ন কর্মকান্ড হাতে নেওয়া হবে। জেলা পরিষদের পর্যটন নিয়ে প্রকল্প সে বিষয়টি নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে আছে।
সংরক্ষিত মহিলা সাংসদ বিষয়ে দীপংকর তালুকদার বলেন, তদবিরে যারা বিশ্বাসী তাদের কথা ভিন্ন, আমি তদবিরে বিশ্বাসী নই। তফসিল ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে জানতে চাইলে তখন মতামত দিবো। তিনি ২০০৮ সালের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, সেবার চিনু চেষ্টা করেছিল এমপি হওয়ার জন্য। আমি বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী কাছে উত্থাপনের পূর্বে দিলীপ বড়–য়া একজনের বিষয়ে তদবির করতে গেলে প্রধানমন্ত্রী জানান এটা ফাইনাল হয়ে গেছে। চিনু তখন মাইন্ড করেছিল। মনে করলো আমি কিছুই করেনি। পরেরবার প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে জিজ্ঞেস করা হলে চিনুর নাম প্রস্তাব করা হয়। তিনি বলেন, তিন পার্বত্য জেলা থেকে এ পর্যন্ত চারজন এমপি হয়েছে। যেটা বান্দরবান ও রাঙামাটিতে থেকে হয়েছে। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে জায়গা থেকে মন্ত্রী করা হয়নি, এবার সে জায়গা থেকে মন্ত্রী করা হয়েছে। তাই লেডি এমপি নির্বাচনের ক্ষেত্রে চান্স এবার খাগড়াছড়ির বেশি। তবে তা নিশ্চিত নয়। দীপংকর বলেন, হয়তো কোন বাঙালি মহিলাকে ওখান থেকে দিতে পারে। আবার বাঙালি কাউকে দিলে জনসংহতি সমিতি চিৎকার শুরু করবে। সেক্ষেত্রে আমার মনে হচ্ছে সমতল থেকে সাঁওতাল, ওঁরা এদের থেকে কাউকে দেবার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার পাহাড় থেকেও সেটা হতে পারে। আর জেলা পরিষদ পুনর্গঠনের বিষয়টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের পর চিন্তাভাবনা হবে।
দীপংকর তালুকদার বলেন, এবার জয় কোন ম্যাজিক না। নেতাকর্মীদের জয়ের যে ক্ষুধা, তার বহিঃপ্রকাশ। অতি বিশ্বাসের কারণে গত নির্বাচনে আমাদের হার ছিলো। দলের কেউ জনসংহতি সমিতিকে আমলে নেয়নি। আর যেহেতু আমি নিজেও মন্ত্রী ছিলাম, তাই সকলের ধারণা ছিলো আমি আবার জিতে গেছি। ভোটের ক্ষুধা নিয়ে তখন কেউ ঝাঁপিয়ে পড়েনি। কিন্তু এবার কারো মান-অভিমান ছিলো না, মানুষ বুঝতে পেরেছে উন্নয়নবঞ্চিত হচ্ছে। তাই তো কাংখিত জয় এসেছে।
নির্বাচনে পরাজয়ে জন্য নিজের দলের কারো বিরোধিতা ছিলো কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে দীপংকর তালুকদার বলেন, যারা বিয়ে করে নাই, তাদের একটা প্রবলেম হলো তারা চায় অন্য কারো বিয়ে না হোক। তাই তো মেয়ে বা ছেলের অভিভাবক যখন বিয়ে নিয়ে আলোচনা করে তখন ঐ ব্যক্তি বিয়ে ভেঙ্গে দেওয়ার চেষ্টা করেন। সমাজে নানা ধরনের মানুষ ফিসফিসানি করে। এটা তেমন কিছু না। সব কাজেই এরকম থাকবে। ঢেউ উঠেছে সব শেষ। সকলেই স্রোতে ভেসে গেছে।
যারা বিয়ে করে নাই, তাদের একটা প্রবলেম হলো তারা চায় অন্য কারো বিয়ে না হোক। তাই তো মেয়ে বা ছেলের অভিভাবক যখন বিয়ে নিয়ে আলোচনা করে তখন ঐ ব্যক্তি বিয়ে ভেঙ্গে দেওয়ার চেষ্টা করেন। সমাজে নানা ধরনের মানুষ ফিসফিসানি করে। এটা তেমন কিছু না। সব কাজেই এরকম থাকবে। ঢেউ উঠেছে সব শেষ। সকলেই স্রোতে ভেসে গেছে।
মেডিকেল কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসের বিষয়টি যেন ঝুলে না থাকে সে বিষয়টি দেখা হবে তিনি বলেন, জনসংহতি সমিতির বাধার কারণে হয়তো সিভিল কন্ট্রাক্টর দিয়ে কাজ করা কঠিন হবে, সেক্ষেত্রে বিকল্প উপায়ে কাজ করার চিন্তাভাবনা চলছে।
নিজের জয়ের জন্য তিনি সকলের কাছে কৃতজ্ঞ জানিয়ে বলেন, সাধারণ জনগণ যেভাবে নৌকার জয়ে মাঠে নেমেছে তা অবিশ্বাস্য। যা আগে কখনো দেখা যায়নি। এভাবে নির্বাচন হলে কেউ অবৈধ শক্তি দিয়ে ক্ষমতায় যেতে পারবে না।