শুভ্র জ্যোতি চাকমা
আমরা সকলে জানি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি বিগত পঞ্চাশ বা ষাট বৎসর পূর্বেও ছিল এক দুর্গম জনপদ। শ্বাপদসংকুল এই অঞ্চলটিতে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই অনুন্নত। তেমনি পশ্চাৎপদ ছিল এখানকার বসবাসকারী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগুলোর শিক্ষাব্যবস্থা। বিগত শতকের পঞ্চাশ দশক পর্যন্ত পাহাড়িদের মধ্য থেকে মাত্র হাতেগোনা কিছু মানুষ উচ্চ শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়েছিলেন।
এই দুর্গম শ্বাপদসংকুল পশ্চাৎপদ অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন নিভৃতচারী,প্রতিভাবান চিত্রশিল্পী চুনীলাল দেওয়ান। চাকমা মুলিমা গোজার ধাবানা গোষ্ঠীরএক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ৩ ফেব্রুয়ারি বর্তমান দীঘিনালা উপজেলায় তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম শশী কুমার দেওয়ান। মাতার নাম নয়নতারা দেওয়ান। তাঁদের আদিনিবাস বর্তমান রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার বড়াদম গ্রামে। পিতার পুলিশ বিভাগে চাকরি করার সুবাদে চুনীলাল দেওয়ান-এর জন্ম হয় দীঘিলানায়।অবশ্য পরে তাঁরা বর্তমান নান্যাচর উপজেলায় স্থায়ীনিবাস গড়ে তোলেন। চুনীলাল দেওয়ান পূর্ববর্তী চাকমা রাজা শের দৌলত খাঁ এর ১০ম বংশধর।
চুনীলাল দেওয়ান তখনো চিত্রশিল্পী হয়ে ওঠেননি। নান্যাচর এমই স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষার পর তিনি রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করে পাড়ি জমান সুদূর কলকাতায়। ভর্তি হয় কলকাতা সরকারি আর্ট কলেজে-প্রাচ্যকলা বিভাগে। দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল থেকে সেই সময়ে কলকাতায় গিয়ে পড়াশুনা করতে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সেখানে পড়াশুনা করে তিনি ডিপ্লোমা অর্জন করে রাঙামাটি ফিরে আসেন। পিতার ইচ্ছাতেই বিয়ে করেন চারুবালা দেওয়ানকে। দুই পুত্র সন্তান রনজিত কুমার দেওয়ান ও তড়িৎ কান্তি দেওয়ান-এর জন্মের পর চারুবালা দেওয়ান ইহলোক ত্যাগ করলে তিনি ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে বসুন্ধরা দেওয়ানকে বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে দেবী প্রসাদ দেওয়ান,সত্য প্রসাদ দেওয়ান, নীতি প্রসাদ দেওয়ান ও গৌরিকা দেওয়ান নামে তাদের চার সন্তান রয়েছে।
চুনীলাল দেওয়ান ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ড্রইং শিক্ষক পদে যোগদান করেন। মাত্র বছর দুই বৎসর চাকরি করার পর চাকরি ছেড়ে দেন। ৬১ নং মাইচছড়ি ও ৬০ নং ছয়কুড়িবিল মৌজার হেডম্যান তাঁরই ভ্রাতুষ্পত্র প্রণব দেওয়ান স্বেচ্ছায় ভারতে চলে গেলে স্থানীয় প্রশাসন চিত্রশিল্পী চুনীলাল দেওয়ানকে ছয়কুড়ি বিল মৌজার হেডম্যান ও নান্যাচর বাজারের বাজার চৌধুরী পদে নিযুক্ত করে। আমৃত্য তিনি ঐ পদে আসীন ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী বসুন্ধরা দেওয়ান হেডম্যান ও বাজার চৌধুরী’র দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পালন করেন।
চুনীলাল দেওয়ান শুধুমাত্র চিত্রশিল্পী বা প্রথাগত মৌজার হেডম্যান ছিলেন না। তিনি ছিলেন বহুগুণে গুণান্বিত এক প্রতিভাবান মানুষ। ছাত্রাবস্থা থেকে তিনি সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন থাকতেন। প্রাপ্ত তথ্য মতে, তিনি মাত্র ১৪ বৎসর বয়সে অর্থাৎ ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। এই সময় তিনি বিশেষত গান রচনা করতেন। নিজে সুরারোপ করে নিজেই গাইতেন। প্রথমদিকে তাঁর সাহিত্য চর্চা ছিল বাংলাভাষায়। পরে তিনি চাকমা ভাষায়ও সাহিত্য চর্চা করেন। মনে করা হয় যে, তাঁর ‘ঘর দুয়ারত’ নামক কবিতাটিই প্রথম আধুনিক চাকমা কবিতা। চাকমা কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগুলোর মধ্যে তিনিই প্রথম আধুনিক কবিতা রচনা করেন। তাঁকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আধুনিক কবিতার জনক বলা যায়। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি সাহিত্যচর্চা করেন। ধারণা করা হয় যে, সংরক্ষণের অভাবে তাঁর অনেক মূল্যবান সাহিত্যকর্ম হারিয়ে গেছে।
চিত্রশিল্পী চুনীলাল দেওয়ান ছিলেন নিভৃতচারী মানুষ। ছাত্রাবস্থায় তাঁর কোনো ছেলেমানুষী বা চপলতা ছিল না। তিনি সাধারণের সাথে অতি সাধারণ বিষয়ে নিজেকে জড়াতেন না। তিনি ছিলেন মিতব্যয়ী ও অত্যন্ত সংযমি প্রকৃতির। এমনকি সংসার জীবনেও ছিলেন অত্যন্ত শান্ত। সাহিত্য চর্চা কিংবা গান গেয়ে বা ছবি এঁকে সময় কাটাতেন। কলকাতায় অধ্যয়নকালীন সময় পেলে মহাবোধি সোসাইটিতে ভিক্ষু উত্তমের কাছে যেতেন। ধর্মের প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা ছিল। সঙ্গীতযন্ত্র বাজাতে জানাতাঁর প্রতিভার মধ্যে অন্যতম। তিনি এসরাজ, হারমোনিয়াম, পিয়ানো, বাঁশী, সেতার বাজাতে পারতেন।
চিত্রশিল্পী হিসেবে তৎকালীন পাকিস্তানে চুনীলাল দেওয়ান-এর নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। বিভিন্ন প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করে প্রশংসা কুঁড়িয়েছিলেন। কালগত হওয়ার আগে তিনি শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিন-এর উদ্যোগে আয়োজিত লোকশিল্প প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ঐ প্রদর্শনীতে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপকরণ সংগ্রহ করে প্রদর্শন করেন। প্রদর্শনী থেকে ফিরে তিনি আর বেশিদিন বাঁচেননি। নিকট আত্মীয় পিতাম্বর খীসার শ্রাদ্ধক্রিয়ায় খাবার খাওয়ার পর ফুড পয়জনিং-এ আক্রান্ত হয়ে ৮ ডিসেম্বর ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর অকাল মৃত্যুতে চাকমা জাতি হারিয়েছে এক প্রতিভাবান মানুষকে যিনি বেঁচে থাকলে চাকমা তথা পার্বত্য অঞ্চলের সাহিত্য আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারত। তাঁর অকাল মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একজন নিরলস নিবৃতচারী ঋত্বিকের গৌরবান্বিত অধ্যায়ের অবসান হয়ে।
গত ৩ ফেব্রুয়ারি ছিল এই মহান গুণি ব্যক্তির ১১৩ তম জন্মবার্ষিকী। এই শুভদিনে তাঁকে আমি প্রাণভরে স্মরণ করছি। স্মরণ করছি তাঁর সৃষ্টিকর্মকে।
লেখক: শুভ্র জ্যোতি চাকমা, রিসার্চ অফিসার, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, রাঙামাটি।