নানা কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের কাছে আলোচিত-সমালোচিত ওয়াদুদ ভূঁইয়া। আওয়ামীলীগের দীর্ঘশাসনামলে মামলা,জেলসহ নানা কারণে নিপিড়িত,নির্যাতিত এই নেতা আবারো প্রাদপ্রদীপের আলোয়,নিজের রাজনীতি নিয়ে। জেলা উপজেলায় নানান কর্মসূচী নিয়ে সক্রিয় হয়েছেন আবারো। ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তির ২৭ তম বর্ষপূর্তির দিন ফেসবুকে দেয়া দীর্ঘ এক স্ট্যাটাসে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি নিয়ে নিজের অবস্থান জানিয়েছেন তিনি। পাঠকের আগ্রহের কথা বিবেচনায় নিয়ে ফেসবুকে দেয়া তার স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
প্রিয় পার্বত্যবাসী,
‘শান্তি’, বড়ই প্রশান্তিময় একটি শব্দ। বিগত ১৬ বছর ধরে দেখে আসছি, মহা সমারোহে প্রতি বছরের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামে পালিত হয়ে আসছিলো পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ওরফে তথাকথিত শান্তি চুক্তির বর্ষপূর্তির জমকালো আয়োজন।এবারের প্রেক্ষাপট অবশ্য ভিন্ন। আমার কাছে এতোসব আয়োজন নিছক নটাঘট কিংবা আদিখ্যেতা বলেই মনে হয়েছে।
আজ থেকে ঠিক ২৭ বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি-সম্প্রীতি স্থাপনে সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও অস্ত্রবাজী অবসানের ওয়াদা দিয়ে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তৎকালীন স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে তখনকার একমাত্র গেরিলা সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির যে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিলো তাতে কী পার্বত্য জনপদে আসলেই শান্তির পথ সুগম হয়েছে? পার্বত্য চট্টগ্রামে কী প্রকৃতপক্ষেই স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়েছে? না কী সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, হত্যা, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, উন্নয়ন কাজে বাঁধা প্রদান, বেপরোয়া চাঁদাবাজী ও নাশকতামূলক তৎপরতা আরও প্রকট হয়েছে?
আমরা তো এখনও পাহাড়ে স্পষ্ট শুনতে পাই অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি। এখনও প্রায়শই বারুদের গন্ধ লাগে নাকে। মাঝে মাঝেই তো শোনা যায় ধর্ষিতা বোনের আত্মচিৎকার। এখনোতো দূর হলোনা পাহাড়ি-বাঙালি বিদ্বেষ, বৈষম্য। ওই চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ি এবং বাঙালির বৈষম্য আরও অনেক বেশী সুদৃঢ় করেছে স্বৈরাচারী হাসিনা। আমরা তখন থেকেই এই চুক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম। আমাদের দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ওই চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করে লংমার্চ করেছিলেন। ইতিহাস ঘাটলে সবই জানতে পারবে এই প্রজন্মের তরুণরা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে বিকৃত রূপান্তর করে “শান্তি চুক্তি” হিসেবে পরিচয় করিয়েছে মুজিব কন্যা হাসিনা। সে চেয়েছিলো এই চুক্তির মাধ্যমে শান্তিতে নোবেল নেবে। তার সেই দূরাশা পূরণ হয়নি। বিপরীতে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি এবং বাঙালিদের সাথে বছরের পর বছর ধরে প্রতারণা করে আসছিলো অভিনেত্রী হাসিনা।
তথাকথিত শান্তি চুক্তির তিন মাস পর, ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারিতে হাসিনার নির্দেশে আয়োজন করা হলো অস্ত্র সমর্পণের। ভাঙাচোরা অস্ত্র নিয়ে লোক দেখানো অনুষ্ঠান সম্পন্ন করলেন শেখ হাসিনা, সন্তু লারমা এবং ১ হাজার সাতশত গেরিলা। এরপর কী হলো?? পরের গল্প সকলেরই জানা।
বছর বছর শান্তিচুক্তির জমকালো আয়োজন করলাম। নতুন অস্ত্রের এতোসব সংযোজন তবে হলো কীভাবে। ভাঙ্গা রাইফেল জমা দেওয়া বিদ্রোহীরা এখনো বহাল তবিয়তে ব্যবহার করছে একে ফোরটি সেভেনসহ ভারী ভারী অস্ত্র এবং স্নাইপার। এসব নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে আমাদের।
ভাবতে হবে, শান্তি এলো কোথায়? এখনোতো বীরদর্পে চলছে ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের রক্তক্ষয়ী সংঘাত। দিনমজুর থেকে শুরু করে চাকুরীজীবি, ব্যবসায়ী কেউই তো চাঁদাবাজদের কবল থেকে মুক্ত নন। আর এতোকিছুর নামই যদি শান্তি হয়, তবে জানতে চাই অশান্তি কাকে বলে?
আপাতত আমি এই বিতর্ক তুলছিনা যে, তুলনামূলকভাবে কোন সম্প্রদায় বেশী নির্যাতিত। আমার বলার কথা হলো, পাহাড়ি-বাঙালি কোনো সম্প্রদায়ই আমরা ততোটা ভালো নেই। আমরা কেউই আসলে স্বস্তিতে নেই, শান্তিতে নেই। নানা কারণে পাহাড়ি-বাঙালি সম্প্রদায়ের অসন্তোষের পাশাপাশি পাহাড়ি-পাহাড়ি দ্বন্দ্ব-সংঘাতের চিত্রও ক্রমেই পুষ্ট হচ্ছে। আর সবকিছু মিলিয়ে পাহাড়ি জনপদের শক্তি সন্ধানী মানুষদের মনে দিন দিন শঙ্কার দানা পোক্ত হয়ে উঠছে।
হাসিনার করা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে পুলিশ বিভাগসহ তিন পার্বত্য জেলার সাধারণ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশসহ মৌলিক আরও বেশকিছু বিষয় ছিলো। সেনাবাহিনীকে পাহাড়ে সংকুচিত করার চূড়ান্ত বন্দোবস্ত করেছিলো। বিদেশী রাষ্ট্রের মদদে শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূ-খণ্ড অন্য দেশের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলো। এখনো হাসিনার সেই চক্রান্ত অব্যাহত রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে খাগড়াছড়ি এবং রাঙ্গামাটিতে ঘটে যাওয়া সহিংস ঘটনার ভয়াবহ স্মৃতি এখনও পার্বত্যবাসীকে শিহরিত করছে। অজানা শঙ্কায়, আতঙ্কে দিন-রাত পার করছি আমরা।যখন ওই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিলো তখন পার্বত্য রাজনীতির চেহারাটাও পুনর্বার প্রকাশিত হয়েছিলো।
বিদ্যমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে প্রতীয়মান যে, পার্বত্য এলাকায় ছয়টি আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন সক্রিয় থাকলেও উপদল রয়েছে আরও অনেক। আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব ও মতানৈক্য ক্রমেই বাড়ছে। আস্থা সংকটের পাশাপাশি বিদ্যমান পরিস্থিতি পাহাড়ের জনগণের দীর্ঘদিনের সংঘাতময় জীবনকে আরও বিপন্ন করে তুলছে। একাধিক আঞ্চলিক সংগঠন কোনো সমস্যা নয়, সমস্যা হলো সশস্ত্র সংঘাত। এ সংঘাতের ফলে অকালে ঝরে যাচ্ছে অনেক তাজা প্রাণ, আর তা পার্বত্যবাসীকে ক্রমেই ঠেলে দিচ্ছে অনিশ্চয়তার দিকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত যে একটি রাজনৈতিক সমস্যা, এ ব্যাপারে দ্বিমত প্রকাশের কোনো অবকাশ নেই।
স্থায়ীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ও কালক্ষেপণ বড় ধরনের অশুভ লক্ষণ। একইসাথে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি শান্তির পথে বড় অন্তরায়।
তাই অস্ত্র বহনকারীদের এই বাস্তবতা উপলব্ধি করে সুস্থ্য ধারায় ফিরে আসতে হবে। অধিকার আদায়ের সবচেয়ে প্রশস্ত পথ হলো বহুপক্ষীয় আলোচনা এবং যোগাযোগ সক্রিয় করা। রাজনৈতিকভাবেই মিমাংসার পথ খুঁজতে হবে। আর যারা পার্বত্য অঞ্চলে অশান্তি জিইয়ে রাখতে ইন্ধন জোগাচ্ছে তাদের চিহ্নিতকরণেও সরকারের জোরদার পদক্ষেপ দরকার।
– আপনাদের ওয়াদুদ ভূঁইয়া