শংকর হোড়
তিন পার্বত্য জেলার পর্যটনে বাঁকবদল হাওয়া লেগেছে। রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতু, বান্দরবানের নীলগিরি কিংবা খাগড়াছড়ির আলুটিলার মধ্যে পর্যটনের আকর্ষণ সীমাবদ্ধ না রেখে, পুরাতন ধ্যান-ধারণার বাইরে এসে নতুনত্বের দিকে ধাবিত হচ্ছে পার্বত্য জেলার পর্যটন। বাঁকবদলের এই হাওয়ায় পর্যটকরাও লুফে নিচ্ছে নতুন স্বাদের পর্যটনের এই আবাহন। রাঙামাটিতে হাউজবোট-দ্বীপভিত্তিক ট্যুরিজম, বান্দরবানে কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম এবং খাগড়াছড়িতে সাজেক ভ্যালি ও নার্সারিকেন্দ্রিক ট্যুরিজমে আকৃষ্ট হচ্ছে পর্যটকরা।
রাঙামাটি: রাঙামাটি জেলাকে ঘিরে রয়েছে ১১ হাজার বর্গকিলোমিটারের সুবিশাল কাপ্তাই হ্রদ। ১৯৬০ সালে কর্ণফুলি নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণের ফলে এই কৃত্রিম জলাধারের সৃষ্টি হয়। হ্রদের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে ছোট বড় অসংখ্য দ্বীপ। সেই দ্বীপগুলোকে ঘিরেই তৈরি হচ্ছে নতুন ট্যুরিজম স্পট।
শহরের অদূরেই কাপ্তাই হ্রদের মাঝে গড়ে উঠেছে মায়াবী দ্বীপ নামের একটি মনোমুগ্ধকর স্থাপনা। রাঙ্গামাটি এসএসসি ব্যাচ ১৯৯৪ এর বন্ধুরা মিলে গড়ে তুলেছেন দ্বীপভিত্তিক ট্যুারিজম। কাপ্তাই হ্রদের বিশালতা উপভোগ করার জন্য এই দ্বীপের জুড়ি মেলা ভার। দ্বীপের শেষ প্রান্তে দাঁড়ালে হ্রদের নীল জলরাশি, দূরের পাহাড় আর হ্রদের বুকে চলাচলকারী নৌযান সব মিলিয়ে চোখ জুড়িয়ে যায়। দ্বীপে আরো রয়েছে মুক্তমঞ্চ, সূর্যমুখী ও সরিষা বাগান, ক্যাফেসহ পর্যটকদের আকৃষ্ট করার নানান আয়োজন। তৈরি করা হচ্ছে হ্রদের তীর ঘেঁষে রিসোর্ট। শহরের অনেকেই ক্লান্তি জুড়াতে দুদন্ড শান্তি কিংবা নীরবতার প্রত্যাশায় ভিড় করেন এই দ্বীপে। পর্যটকদের কাছেও দিনদিন সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে এই দ্বীপের। রাঙামাটিতে বেড়াতে আসা পর্যটকরা ক্ষণিকের জন্য হলেও দেখে আসতে চান মায়াবী দ্বীপকে। শুধু মায়াবী দ্বীপই নয়; এই ধরনের ট্যুরিজমে যুক্ত হয়েছে রাঙ্গা দ্বীপ, ডিভাইন লেক আইল্যান্ড, রাইন্যা টুগুনসহ আরো ১০-১২টি দ্বীপ। পাশাপাশি রাঙ্গামাটিতে জনপ্রিয়তা পেয়েছে হাউজবোটেরও। বিশাল কাপ্তাই হ্রদে আরাম আয়েশে শুয়ে, বসে পরিবারসহ ঘুরে বেড়াতে পারেন পর্যটকরা। ইতোমধ্যে জনপ্রিয়তা পাওয়ায় রয়েল অ্যাডভেঞ্চার, প্রমোদিনী-১, প্রমোদিনী-২, মাওরুম, স্বপ্নতরী, স্বপ্নডিঙি, রাঙাতরি, ময়ুরাক্ষীসহ অন্তত ১৫টির মতো হাউজবোট ঘুরে বেড়াচ্ছে কাপ্তাইয়ের সবুজাভ নীল জলরাশিতে।
মায়াবী দ্বীপের ম্যানেজিং পার্টনার ফজলে এলাহী বলেন, আমরা শহরের এবং শহরের বাইরের পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে দ্বীপকে ধীরে ধীরে তৈরি করছি। যারা শহরের যান্ত্রিক কোলাহলকে পেছনে ফেলে একটু নিরিবিলিতে সময় কাটাতে চান তারা অবশ্যই আসতে পারেন মায়াবী দ্বীপে। আমাদের রিসোর্ট তৈরির কাজ চলমান আছে। আগামী দিনগুলোতে মায়াবী দ্বীপ রাঙামাটির পর্যটন শিল্পে একটি মাইলফলক হয়ে উঠবে বলে আমি বিশ^াস করি। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে রাঙামাটির পর্যটনে নতুন মাত্রা নিয়ে এসেছে দ্বীপভিত্তিক এই ট্যুরিজম এবং পর্যটকদেরও যথেচ্ছা সাড়া মিলছে এই কনসেপ্টে।
খাগড়াছড়ি: খাগড়াছড়ির পর্যটন বলতে সাজেককেন্দ্রিক পর্যটকদেরই সাধারণত বুঝানো হয়। ভৌগোলিক কারণে সাজেকের অবস্থান রাঙামাটি জেলায় হলেও সাজেক ভ্যালিতে যেতে হয় খাগড়াছড়ি সড়ক হয়ে। আর এতে পর্যটকের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠেছে এই জেলাটিও। সাজেকে যেতে হলে খাগড়াছড়ি সদর থেকে চাঁন্দের গাড়ি করে প্রায় তিন ঘণ্টার পথ। পাহাড়ের বুক চিরে আঁকাবাকা পিচঢালা পথ, সেই পথের বাঁকে বাঁকে আদিবাসীদের বাড়ি কখনো কখনো উঁকি দিয়ে উঠে। পাহাড়ের টিলা থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে সবুজে মোড়া প্রকৃতি ও নীল আকাশ। পাহাড় ও মেঘের অপূর্ব মিলনের জন্যই সাজেককে বলা হয় মেঘের রাজ্য। খাগড়াছড়ি শহর থেকে প্রায় ৬৭ কিলোমিটার দূরে দুর্গম পাহাড়ের চূড়ায় সাজেকের অবস্থান।
সাজেক ভ্যালির সর্বোচ্চ চুড়ায় রুইলুই পাড়ার অবস্থান। যেদিকে তাকানো যায় মেঘ আর পাহাড়ের মিলনমেলা। আর অদূরে মিজোরাম রাজ্যের পাহাড়। এ যেনো প্রকৃতির এক অপার সৌন্দর্য। সাজেক দুইটা পাড়া রয়েছে, রুইলুই এবং কংলাক। রুইলুই থেকে কংলাক পাহাড়ের দূরত্ব মাত্র ৩ কিলোমিটার। রুইলুয়ে কটেজে ওঠা অনেক পর্যটকই একবার ঘুরে আসে কংলাক পাহাড় থেকে।
সাজেকে ইকোট্যুরিজমের আদলে পর্যটন গ্রাম করা হয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে কংলাক রুইলুইপাড়ায় ১১০টি কটেজ করা হয়েছে। সেখানে বর্তমানে কিছু ভবন রয়েছে বটে, তবে স্থানীয় সামাজিক ঐতিহ্য ও পরিবেশের সঙ্গে মানানসই অধিকাংশ কটেজ নির্মাণ করা হয়েছে। এ কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে নন্দিত পর্যটনকেন্দ্রগুলোর মধ্যে সাজেক অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ হয়ে উঠেছে। প্রতিবছর লক্ষাধিক পর্যটক সেখানে ভ্রমণ করেন।
এদিকে সাজেকগামী পর্যটকদেরও খাগড়াছড়িতে বিনোদন দিতে গড়ে উঠেছে ভিন্নধর্মী কনসেপ্ট। নানান রঙের ফুলে সাজানো বাগান। সেখানে এক কাপ চা, কফি কিংবা পছন্দের খাবার খেতে খেতে আশপাশ দেখে চোখ জুড়িয়ে নিতে পারেন। মৃদু মৃদু আলোয় প্রিয়মানুষটির সাথে গল্প করতে করতে কখন যে সময় গড়িয়ে যায়, সে হিসাবও রাখা দায়। এমনই গতানুগতিক চিন্তার বাইরে এসে খাগড়াছড়িতে এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে নার্সারিকেন্দ্রিক ট্যুরিজম। খাগড়াছড়ি শহরে স্বপ্নচ‚ড়া, ম্যাগনেট ক্যাফে, স্বপ্নবিলাস, সিস্টেম-টু, স্বপ্ন বিলাস ফ্লাওয়ার ভিলেজ নামে জেলায় অন্তত ৩০টি কৃষিভিত্তিক ট্যুরিজম নার্সারি ও রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে।
স্বপ্নবিলাস ফ্লাওয়ার ভিলেজ’র উদ্যোক্তা খালেদ মাসুদ সাগর বলেন, চাকরির পেছনে না ছুটে নিজে কিছু করার তাগিদ থেকে আমি এটি চালু করেছি। আমি ভিলেজ নিয়ে পর্যটকসহ স্থানীয়দের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। পাহাড়ে কৃষি পর্যটন নিয়ে কাজ করার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। তরুণরাও যদি এমন এগ্রো ট্যুরিজম গড়ে তুলতে পারে, তাহলে নিজে যেমন স্বাবলম্বি হতে পারবে তেমনি পর্যটনখাতও সমৃদ্ধ হবে।
বান্দরবান: বান্দরবানের কথা আসলেই প্রথমে আসবে নীলগিরি, নীলাচল কিংবা স্বর্ণ মন্দিরের সৌন্দর্য। কিন্তু এর বাইরেও ধীরলয়ে কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজমের দিকে ঝুঁকে পড়ছে এই জেলার পর্যটন শিল্প। ইতোমধ্যে ক্ষুদ্র পরিসরে রুমার বগা লেক, কেওক্রাডং পাহাড়ের দার্জিলিংপাড়া, রোয়াংছড়িতে লিরাগাঁইপাড়া, থানচিতে তিন্দু ও রেমাক্রিতে কমিউনিটি ট্যুরিজম গড়ে উঠেছে। মূলত পার্বত্য শান্তিচুক্তির পরে স্থানীয় অধিবাসীরা এটি গড়ে তুলেছেন। সেখানে অনেকে নিজেদের পরিবারিক পরিমণ্ডলে পর্যটকদের আবাসনের ব্যবস্থা করেন। কেউ কেউ কটেজ করেছেন। রুমায় ১ হাজার ৭৩ ফুট উঁচু পাহাড়চূড়ায় বগা লেকে বম জনগোষ্ঠীর বসবাস। সেখানকার সিয়াম কটেজের মালিক সিয়াম বম ১০ বছর ধরে পর্যটনের সঙ্গে জড়িত। তিনি বম জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যে খুঁটির ওপর মাচানের কটেজে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা করেছেন। তিনি বলেন, ‘সেবা দেবেন টাকা নেবেন’ এটিই পর্যটনের মূল কথা। পাড়ায় ৩২টি পরিবারের লোকজন যাঁদের পর্যটক রাখার সক্ষমতা নেই, তাঁরা দোকানে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে কোমরতাঁতের কাপড় বিক্রি করেন, খাবারের হোটেল চালান এবং অনেকে ট্যুরিস্ট গাইডের কাজ করে থাকেন। এভাবে প্রত্যেকটা পরিবার পর্যটকদের সেবা প্রদানের মাধ্যমে আয়ের ব্যবস্থা করেছে।
টুরিজম বোর্ডের (বিটিবি) পর্যটন মহাপরিকল্পনার চলমান গবেষণায় এ পর্যন্ত তিন পার্বত্য জেলায় ৮৫টি পর্যটন-আকর্ষণ স্থান শনাক্ত করা হয়েছে-রাঙামাটিতে ২৯টি, বান্দরবানে ৪১টি ও খাগড়াছড়িতে ১৫টি। শনাক্ত করা স্থানগুলোতে আট ধরনের পর্যটনের সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। ৮৫টি স্থানের মধ্যে ৬০টি স্থানে সম্ভাবনা ইকো ও কমিউনিটি পর্যটন গড়ে তোলা সম্ভব।