শংকর হোড়
২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৬তম বর্ষপূর্তি। যা সারা দেশে ‘শান্তি চুক্তি’ নামে সমাদৃত। ১৯৯৭ সালে এদিন বাংলাদেশ সরকারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির চুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তির পর দীর্ঘদিনের অবরুদ্ধ পার্বত্যাঞ্চল বিশ্ববাসীর কাছে মুক্ত হয়। শান্তির বার্তা নিয়ে এই চুক্তি বাস্তবায়ন করা হয়। প্রাথমিকভাবে শান্তিবাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। সরকারও তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। সাময়িকভাবে পাহাড়ে রক্তের খেলা, অস্ত্রের ঝনঝনানি বন্ধ হয়। কিন্তু বছর যেতে না যেতে প্রতিষ্ঠা হয় চুক্তিবিরোধী সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (্ইউপিডিএফ)। এরপর শুরু পাহাড়ে দুই আঞ্চলিক দলের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। থেমে থেমে চলে দুই সংগঠনের হত্যা পাল্টা হত্যা। পরে ২০০৭ সালে জনসংহতি সমিতি থেকে বের হয়ে ২০১০ সালে আরেক আঞ্চলিক সংগঠন জনসংহতি সমিতি(এমএন লারমা) সৃষ্টি হয়। ২০১৭ সালে এসে ইউপিডিএফ থেকে বের হয়ে আরেকটি সংগঠনের জন্ম হয়। যেটা ইউপিডিএফ(গণতান্ত্রিক) নামে পরিচিত। এরপর বিভিন্ন সময় চার পক্ষের কর্মী, সমর্থক হত্যার মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চলে। সন্তু লারমা নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজিব চাকমা বলেছেন, চুক্তির পর এই পর্যন্ত তাদের তিন শতাধিক নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া তাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা রয়েছে। অন্যদিকে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডি) এর মুখপাত্র অংগ্য মারমা জানান, চুক্তির পর তাদের সাড়ে তিনশ নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পাঁচ শতাধিক মামলা রয়েছে বলে তিনি জানান। এছাড়া জনসংহতি সমিতি(এনএন লারমা) নেতৃবৃন্দ জানায়, সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই পর্যন্ত তাদের দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে।
কিন্তু চুক্তির এতো বছর পর এসেও চুক্তি বাস্তবায়ন না করার জন্য জনসংহতি সমিতি সরকারকে দোষারোপ করতে দেখা যায়। ধারা বাস্তবায়ন নিয়ে চলছে দুই পক্ষের তর্কযুদ্ধ। এই ২৬ বছর জনসংহতি সমিতি চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনে রাজপথে বেশিরভাগ সময় সক্রিয় ছিলো, পক্ষান্তরে ইউপিডিএফ সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ, পার্বত্যাঞ্চলে স্বায়ত্ত¡শাসনের দাবিতে আন্দোলন করে গেছে। অন্যদিকে জনসংহতি সমিতিও(এমএন লারমা) চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনে লিপ্ত রয়েছে। তবে চুক্তি নিয়ে তেমন কোনও কথা এখনো ইউপিডিএফ(গণতান্ত্রিক) এর তরফ থেকে শোনা যায়নি।
আপাত দৃষ্টিতে চার পক্ষের কর্মী, সমর্থকদের হত্যা চললেও এসময় পাহাড়ে ১৯৯৭ সালের পূর্বের চাইতে অনেকটা শান্তি স্থাপন হয়। পাহাড়ে অর্থনৈতিক ¯্রােত বৃদ্ধি পায়। বিশ্ববাসীর কাছে পার্বত্যাঞ্চলের পর্যটনও ব্যাপক সুনাম অর্জন করে। এসময়ে পাহাড়ে যোগাযোগ অবকাঠামো ছাড়াও শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব সেক্টরেই ব্যাপক উন্নতি হয়।
এদিকে গত ২৬ বছরে রাঙ্গামাটিতে প্রচুর উন্নয়ন কর্মকান্ড হয়েছে। জেলার আরো তিনটি বেসরকারি কলেজকে সরকারিকরণ করা হয়েছে। পাশাপাশি মেডিকেল কলেজ ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। চুক্তির পূর্বে পাহাড়ে দুর্গমাঞ্চলে কমিউনিটি কিèনিকের কার্যক্রম তেমন একটা না থাকলেও বর্তমানে পুরো জেলায় শতাধিক কমিউনিটি ক্লিনিক চালু রয়েছে। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে জেলায় শতাধিক কমিউনিটি ক্লিনিক চালু রয়েছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, চুক্তির পূর্বে জেলায় ১২ হাজার পরিবার বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় থাকলেও বর্তমানে অর্ধ লক্ষাধিক পরিবার বিদ্যুতের সুবিধা গ্রহণ করছে। দুর্গম বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়িতে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সীমান্তবর্তী এলাকায় মাইলের পর মাইল সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। সাজেকে পর্যটন স্পট স্থাপনের মাধ্যমে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক পাহাড়ে আসছে। যেখানে বিদ্যুতের লাইন যেতে পারছে না, সেখানে সোলারের মাধ্যমে রাতের অন্ধকার দূর করা হয়েছে।
জেলা সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ চাকমা বলেন, চুক্তির পর চারটি সড়কে ৫০০ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ হয়েছে। এছাড়া নানিয়ারচরে চেঙ্গী নদীর ওপর ৫০০ মিটার দীর্ঘ সেতুসহ তিনটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে আরো সাতটি সেতু নির্মাণাধীন রয়েছে। এছাড়া সেনাবাহিনীর তত্ত¡াবধানে সড়ক ও জনপথ বিভাগের আওতাধীন রাঙামাটিতে ১৩০ কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে।
এদিকে এলজিইডি’র অধীনে রাঙ্গামাটি জেলায় চুক্তির পর প্রায় হাজার কোটি টাকার সড়ক, কালভার্ট, সেতু নির্মিত হয়েছে। এলজিইডি’র অফিস সূত্রে এই তথ্য জানা যায়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাঙ্গামাটি অঞ্চলের আঞ্চলিক কর্মকর্তা তপন কুমার পাল বলেন, চুক্তির ফলে যেহেতু এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রচুর উন্নয়ন হয়েছে, সেক্ষেত্রে দুর্গম অঞ্চলের কৃষিপণ্য সহজেই পরিবহন করা সম্ভব হচ্ছে এবং ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি সহজ হচ্ছে । তিনি বলেন, চুক্তির ফলে কৃষিজ উৎপাদন কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার বলেন, শান্তি চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ায় শান্তিকামী মানুষ হিসেবে আমাদেরও কষ্ট আছে। কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়নের কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে, যা দূর করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, চুক্তি বাস্তবায়নের পথে যে বিষয়টি অন্তরায় তা হচ্ছে জনসংহতি সমিতি আওয়ামীলীগের সাথে চুক্তি করলেও যারা চুক্তি বিরোধিতা করেছিল, সেই বিএনপির সাথে তারা আঁতাত করেছে। তিনি বলেন, কাঁঠালের আমসত্ত¡ হয় না, আমসত্ত¡ হয় আমের। তেমনি যারা চুক্তির বিরোধিতা করেছিল, তাদের সাথে আঁতাত করে চুক্তির পক্ষের মানুষদের নিশ্চিহ্ন করার যে প্রক্রিয়া সেই কারণে চুক্তি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে দেয়া-নেয়ার যে সমঝোতা, সেটা যদি করতে না পারি তবে ২৬ বছর পরও চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে প্রতিবন্ধকতা থেকে যাবেই।
তিনি বলেন, তারপরও সরকারের ধারাবাহিকতার কারণে চুক্তির বেশিরভাগ ধারা বাস্তবায়ন হয়েছে। এতে পাহাড়ে শান্তির সুবাতাস বইছে। স্কুল, কলেজ জাতীয়করণ করা হয়েছে। মাইলের পর মাইল রাস্তা করা হয়েছে। উপজেলাগুলোতে ১০ শয্যার হাসপাতাল ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। মেডিকেল কলেজ হয়েছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। সব খাতেই উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে।
সাবেক সংসদ সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি ঊষাতন তালুকদার বলেন, চুক্তি বাস্তবায়নের সদিচ্ছা থাকলে কোনও কিছুই প্রতিবন্ধকতা নয়। আওয়ামীলীগ ১৫ বছর ধরে সরকারে আছে, তাদের সদিচ্ছা ইচ্ছা থাকলে সবকিছুই সম্ভব। এখানে জনসংহতি সমিতির কিছুই করার নেই। তিনি আরো বলেন, ভ‚মি নিষ্পত্তি কমিশন হয়েছে, কিন্তু এখনো বিধিমালা হয়নি। তাহলে তাদের যে সদিচ্ছা আছে, আমরা সেটা কিভাবে বুঝবো। আমরা বলছি না, সব একসাথে হবে, তবে সদিচ্ছা থাকলে ধারাবাহিকভাবে চুক্তি বাস্তবায়ন সম্ভব। চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হলে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি ফিরে আসবে। আশা করছি, সামনে আওয়ামীলীগ আবারো সরকার গঠন করলে এবার অন্তত চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে সদিচ্ছা দেখাবে।