ডেস্ক রিপোর্ট
গত ১৯-২০ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি, দীঘিনালা ও রাঙামাটিতে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার বিভাগীয় তদন্তসহ তিন দফা সুপারিশ করেছেন সন্তু লারমা নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। ঘটনার প্রায় দুই সপ্তাহ পর সংগঠনটির সহ তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমা গণমাধ্যমে প্রেরিত এক বিবৃতিতে এই তথ্য জানান। বিবৃতিতে তিনি নিহত ও আহত ব্যক্তি এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সরকারের তরফ থেকে যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসা প্রদান করা এবং সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িত ব্যক্তিদেরকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের সুপারিশ করেছেন। দীর্ঘ বিবৃতিতে ঘটনার আদ্যপান্ত কয়েকটি ধাপে বর্ণনা করা হয়েছে।
বিবৃতিতে দাবি করা হয়, রাঙামাটি জেলা সদরে সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আদিবাসী জুম্ম ছাত্র-যুবকের উদ্যোগে ১৯ সেপ্টেম্বরের দীঘিনালা-খাগড়াছড়িতে জুম্মদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি রাঙামাটি জিমনেসিয়াম প্রাঙ্গণ থেকে শুরু হয়ে যখন রাজবাড়ী পেট্রোল পাম্প এলাকায় পৌঁছে, তখন একদল উত্তেজিত মিছিলকারী কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার গাড়ি ভাঙ্গার চেষ্টা করে। মিছিলটি হ্যাপির মোড়ে পৌঁছলে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন বাঙালিকে ধাওয়া করে মিছিলকারীরা। মিছিলটি যখন বনরূপা পেট্রোল পাম্প এলাকায় পৌঁছে, তখন প্রথমে বনরূপা বিলাস বিপনী নামক দোকানের পাশ থেকে এবং পরে দোকানের ছাদ থেকে একজন বাঙালি কর্তৃক পাহাড়ি ছাত্রদের মিছিলে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে থাকে। এতে মিছিলকারীরা উত্তেজিত হয়ে বাঙালিদের উদ্দেশ্যে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে মিছিলকারী ছাত্রদের সাথে বাঙালিদের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়। এরপর বাঙালিরা বনরূপায় জুম্মদের বসতবাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। বাঙালিরা সেভরন ও মেডিনেট ক্লিনিকে, বিজন সরণী এলাকায় জুম্মদের বিভিন্ন দোকানপাটে, জনসংহতি সমিতির রাঙামাটি জেলা কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। অন্যদিকে কাঠালতলীস্থ ঐতিহ্যবাহী মৈত্রী বিহারে হামলা ও ভাঙচুর এবং তবলছড়িস্থ আনন্দ বিহারে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। মৈত্রী বিহারের গেইট ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে বুদ্ধমুর্তি, আসবাবপত্র ও দানবাক্স ভেঙ্গে ফেলে। মৈত্রী বিহার থেকে ৭টি দানবাক্স, মাসিক চাঁদা ৯০ হাজার টাকা, ১০টি বুদ্ধমূর্তি ও ল্যাপটপ লুট করে নিয়ে যায়। আনন্দ বিহারে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে বিহারের জানালার কাঁচ ভেঙ্গে দেয় ও বুদ্ধমুর্তির ওপর আঘাত করে। বাঙালিরা হাসপাতাল এলাকা ও টিএন্ডটি এলাকায় জুম্মদের ঘরবাড়িতে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। রাঙামাটিতে বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ কার্যালয়ে ও বিশ্রামাগারে হামলা চালিয়ে সরকারি সম্পত্তি ক্ষতিসাধন করে। এসময় হামলাকারীরা আঞ্চলিক পরিষদের ১টি পিকআপ, ৫টি পাজেরো, ব্যক্তিগত ২টি গাড়ি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের ১টি পাজেরো ও ১টি পিকআপে অগ্নিসংযোগ করে। এছাড়া আঞ্চলিক পরিষদের বিল্ডিংয়ে অগ্নিসংযোগ করে থাকে। আগুন জ্বলতে থাকার সময় সেনাবাহিনীর একটি দল আঞ্চলিক পরিষদে গেইটে অবস্থান নেয়। এসময় আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি আসলে বাঙালিরা আগুন নেভাতে বাধা দেয়। পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়ার পরই ফায়ার ব্রিগেডকে আগুন নেভাতে অনুমতি দেয়। বনরূপা ও কালিন্দীপুরে হামলায় এক জুম্ম যুবক নিহত এবং প্রায় শতাধিক জুম্ম আহত হয়। তন্মধ্যে হাসপাতালে আহত ২৭ জন জুম্ম, রাজবন বিহার হাসপাতালে ২৫ ও ঘরে ঘরে ২৮ জন জুম্ম চিকিৎসা নিয়েছে বলে জানা গেছে। আহতদের মধ্যে গুরুতর জখম হওয়ায় ২ জনকে চট্টগ্রামে প্রেরণ করা হয়। হামলায় অনিক চাকমা(১৮) নামে এক জুম্ম ছাত্র মারা গেছে। মৈত্রী বিহারে ভাঙচুর ও লুটপাটসহ জুম্মদের ২৪টি ঘরবাড়ি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও দোকানে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। এতে প্রায় ৫ কোটি টাকার সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে জানা যায়।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা নতুন কিছু নয়। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর বিশেষ মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় এবারের সাম্প্রদায়িক হামলাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে ২১টি সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করা এবং সে লক্ষ্যে জুম্মদের অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা, জুম্মদের ভূমি জবরদখল করা, তাদের চিরায়ত জায়গা-জমি থেকে উচ্ছেদ করা, সর্বোপরি জুম্মদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করা। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার প্রকৃত রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের ক্ষেত্রে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্যেই পার্বত্য সমস্যার সমাধানের সূত্র নিহিত রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বৃহত্তর আন্দোলনে সকলকে সামিল হওয়ার আহŸান জানানো হয়।