-ঞ্যোহ্লা মং
রাষ্ট্রদূত শ্রদ্ধেয় শরদিন্দু শেখর চাকমা’র সাথে তৃতীয়বারের মতো দেখা করার, আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হলো। এ সবই সম্ভব হয়েছে, সহপাঠী আমলা বন্ধু সোনা মনি চাকমা’র কল্যাণে। প্রতিবারে আমার বন্ধুটাকে এসএস চাকমা কতটা ভালোবাসেন কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাই। আজ থেকে ঠিক এক বছর আগেও একবার দেখা করার সুযোগ হয়েছিল, সেটিও ছিল সোনা মনি চাকমার সহযোগিতায়। স্যারের দেখা পাওয়া মানে পাহাড়, সমতল নিয়ে হাজারো তথ্য পাওয়া। ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন বলে, ইতিহাসের দিনক্ষণ, সময় উল্লেখ করে কথা বলতে, উদাহরণ টানতে পছন্দ করেন।
রাণী বিনীতা রায়ের পিএস হিসেবে কাজ করাকালীন সময়ে, মানিকছড়ি রাজবাড়িতে বেশ কয়েকবার যাওয়ার সুযোগ পান। রাজা তাঁর মেয়েকে বিয়ে দিতে উপযুক্ত পাত্র দেখতে বললে, তিনি তাঁর চেয়ে দুই বছরের সিনিয়র উহ্লা মংকে ঠিক করে দিয়েছিলেন। প্রায় ঠিকও নাকি হয়ে গিয়েছিল। উহ্লামং রাজবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে টানা ৪মাসও নাকি ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উহ্লামংকে না দিয়ে চাকমা রাজ পরিবারের এক সদস্যের সঙ্গে বিয়ে দেন। তাতে উহ্লা মং কিছুটা লজ্জা আর অপমানবোধ নিয়ে দেশ ছাড়েন। তিনি বার্মায় অভিবাসী হন। অনেক বছর পরে ঢাকায় একবার এসেছিলেন, কিন্তু এসএস চাকমা স্যারের সাথে দেখা করেন নি।
তাঁর মতে, “উহ্লামং এর সাথে রাজকন্যার বিবাহ হলে, আজকে রাজ পরিবারের ইতিহাসও অন্যরকম হতে পারতো। হয়তো, সবাই উচ্চ শিক্ষিত হতেন।“ এ প্রসংঙ্গে তিনি আরো বলেন, “এক সময় আমি রাজার নাতি-নাতনিদেরও ঢাকায় নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। বলেছিলাম, আপনার নাতি-নাতনিদের আমাকে দিয়ে দেন, আমি ঢাকায় পড়ালেখা করাবো। দেননি। দিলে তারা আজ সকলে উচ্চ শিক্ষিত হতেন।“
চাকরিজীবনের স্মৃতিচারণ করে বলেন,“মানিকছড়ি রাজবাড়িতে গেলে সকালের খাবার টেবিলে ছাগল, হরিণের মাংস থাকলে, সন্ধ্যায় তা আর রাখা হতো না। আরো নতুন নতুন পদের নানা খাবার চলে আসতো। রাজা পড়ালেখায় খুব একটা উৎসাহ দিতেন না। এক মারমা হেডম্যানের ছেলে মংসাথোয়াই চৌধুরী’র উচ্চতর পড়ালেখার প্রয়োজনে রাজা সার্টিফিকেট নিতে এলে বুদ্ধকে প্রণাম করার ন্যায় করেননি বলে, সার্টিফিকেটও দেননি।“ রাজা নাকি স্যারকে বলেছিলেন, “তার আচরণ ঠিক নেই, আইএসসি পড়ার দরকার আছে কী?”
রাষ্ট্রদূত সর্বমোট ৪৫টি বই প্রকাশ করেছেন। তাঁর নিজের লেখা বইগুলোর মধ্যে ‘চাকমা জাতির ইতিহাস’ বিশেষ পছন্দের। তিনি বলেন, “অনেক বই লিখেছি, কিন্তু চাকমারা খুব কমই তাঁর বইগুলো পড়েছেন।“ তিনি অনেককে তাঁর বই বিক্রি করতে দিয়েছেন, যাদের খুব কমই বইগুলো বিক্রি করতে পারলেন কী পারলেন না, খবরও দেননি বলে আক্ষেপ করেন। তিনি আরো বলেন, সারা জীবন অনেক জনকে চাকরি আর পড়ালেখায় সহায়তা করেছি, তাদের খুব কমই এসে দেখা করেছেন, খবর নিয়েছেন কিংবা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন। বরং অনেকের কথা বইতে উল্লেখ করেছেন বলে তাঁর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করেছেন, রাগ দেখিয়েছেন, কেউ কেউ মামলা ও করতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেন, “আমরা একটা অকৃতজ্ঞ জাতি।“
তিনি মনে করেন, “পাহাড়ের সমস্যা সমাধানে বৃহৎ বাঙালী জনগোষ্ঠীর সাথে নানাভাবে যোগাযোগ বাড়ানো উচিত। ক্ষমতা তাদের হাতে, তাদের সদিচ্ছা ছাড়া কোনকিছুই অর্জন সম্ভব নয়। তারা আমাদের দিবেন, এই আশায় থাকতে পারি না। পাহাড়ে গেলে ছোট-বড় সকল অফিসারদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করতাম। এতে তাদের সাথে আমার একটা সুন্দর যোগাযোগ হয়। সুখ-দুঃখের গল্প করতে পারি। অনেককে নানাভাবে উপকার করতে পেরেছি।“ তাঁর মতে, “পাহাড়ি অফিসারসহ অন্যান্যরা তেমন উপকার করতে পারেন না, তাদের নিজেদের যোগাযোগের সীমাবদ্ধতার কারণে। আমাদের অনেকে নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকি। আত্নকেন্দ্রিকতায় অন্যের স্থান থাকে না।“
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে একদিন সাক্ষাৎ হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডে চেয়ারম্যান হওয়ার প্রস্তাব পেয়েছিলেন বলে জানান। তখন তিনি নাকি বলেছিলেন, “আমি উন্নয়ন বোর্ডে চেয়ারম্যান হয়ে খুব বেশি কিছু করতে পারবো না। বরং আমি পাহাড়ের সমস্যা সমাধানে ভূমিকা পালন করতে চাই। তাই তিনি আমাকে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানে গঠিত জাতীয় কমিটিতে সদস্য হিসেবে রেখেছিলেন।“
সে সময়ে ভূমিকার কারণে তিনি রাষ্ট্রদূত হন বলে মনে করেন। তিনি রাষ্ট্রদূত হয়ে কাছে-পিছে এশিয়া মহাদেশের দেশ চীন, জাপান, কোরিয়া, থাইল্যান্ড কিংবা বার্মায় যেতে চেয়েছিলেন। কাছের দেশ সে সময়ে শুধুমাত্র ভুটানই খালি থাকার কথা জানানোতে অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও দায়িত্ব পালনে রাজি হন। রাষ্ট্রদূত হওয়ার প্রস্তাব পেয়ে তিনি নাকি অনুরোধ করেছিলেন, তাকে যেন দূরের দেশ ইউরোপে পাঠানো না হয়।
বর্তমানে ৯৩ বছরে পা রেখেছেন। তিনি এখনো দৈনিক পত্রিকার জন্য অপেক্ষায় থাকেন। রুটিন মেনে চলেন। প্রতিদিন সকালে বিকালে দু’বেলা দুধ পান করেন। সাথে দু’চামচ মধুও নিয়ে থাকেন। তিনি নিয়মিত হাঁটতে পছন্দ করেন। তাই তাঁর কোন ডায়বেটিস নেই বলে জানান। যদিও এখন আর আগের মতো বাইরে গিয়ে হাঁটতে পারেন না। বাড়ির ছাদে গিয়েও হাঁটাচলা করেন না। শুধু বাড়ির ভিতরে হাঁটা চলা করেন। প্রতিদিন নিয়ম করে বই পড়েন। লিখেন। প্রফেসর আনন্দ বিকাশ চাকমা’র লেখা “কার্পাসমহল থেকে শান্তি চুক্তি” বইটি তাঁকে খুশি করতে পারেনি বলে জানান। তাঁর মতে, বইটি খুশি করতেই লেখা হয়েছে। তাঁর মতে, পাহাড়ের বাস্তবতা বইটিতে অনুপস্থিত। বইটি চুক্তির পর পরই প্রকাশিত হলে মানা যায়। কিন্তু চুক্তির এত বছর পরে প্রকাশিত হওয়ায় এর কোনো গুরুত্ব বহন করে না বলে মনে করেন।
সাবেক রাষ্টদূত, মানুষকে ভালো কি মন্দ বিচার করেন, তাঁর কিছু মানদন্ড দিয়ে। যেমন লোকটি আত্নীয়-স্বজন, স্বজাতির লোকজনকে উপকার করেন কি, করেন না, তা দেখেন। যিনি উপকার করেন, উপকার করতে চেষ্টা করেন, তিনি ভালো মানুষ, সুন্দর মনের মানুষ বলে মনে করেন।
তাঁর সাথে সেদিন আলাপ-চারিতা থেকে লিখলাম। এছাড়াও লম্বা সময় নিয়ে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়ে, জীবনে প্রথমবারের মতো, কারোর সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার নেওয়ার চেষ্টা করেছি। সাক্ষাৎকারে তিনি কখন থেকে লেখালেখি শুরু করলেন, কেন লিখতে শুরু করলেন, আরো কিছু লেখার বাকি আছে কিনা, বিসিএস এ পাহাড়ি কোটা নিয়ে তাঁর ভাবনা, পাহাড়ের কোনো জায়গায় বেড়ানোর ইচ্ছা আছে কিনা, তাঁর প্রিয় বই, তাঁর পড়া সেরা বই, লেখালেখির অনুপ্রেরণাকারী ছাড়াও অবসর সময়গুলো জানার চেষ্টা করেছি। আমার নেওয়া সাক্ষাৎকারটি আগামীতে প্রকাশের ইচ্ছা থাকলো।
পাহাড় সম্পর্কে জানতে, তাদের দেখা পৃথিবীকে ধরতে, মানুষগুলোকে চিনতে-বুঝতে, তাদের অর্জিত অভিজ্ঞতাগুলোকে লিপিবদ্ধ করতে, হাতে সময় থাকলে চলে যেতে পারেন। তাঁর সঙ্গে অনেকে অনেক ধান্দা নিয়েও দেখা করতে যান, যা তিনি বুঝতে পারেন বলেও মজা করলেন। তেমনি দু’তিনটি গল্পও শুনিয়েছেন। তিনি সকলকে সময় দেন। তবে, স্বজাতির কাউকে ধান্দাবাজি করতে দেখলে কষ্ট পান। তিনি পাহাড়ের নানা সমস্যা সমাধানে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগের সীমাবদ্ধতাগুলোকে একটি অন্যতম প্রতিবন্ধতা বলে মনে করেন। তিনি বলেন, আমরা আগ বাড়িয়ে নিজ থেকে কোনো কিছুই করতে চাই না। তিনি একাই কোটা নিয়ে অনেক কাজ করার উদাহরণ টেনে বলেন, কোটা সমস্যা নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ এ্যাক্টরদের সাথে দলবেঁধে দেখা করার সুযোগ না মিললেও, অনেকে স্ব স্ব অবস্থান থেকে এগিয়ে গিয়ে বাস্তবতা ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে কোটা সুবিধা বহালের সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন।
ঞ্যোহ্লা মং : তরুন লেখক ও গবেষক।
( ‘খোলা জানালা’ বিভাগে প্রকাশিত সকল লেখার মতামত একান্তই লেখকের ব্যক্তিগত মতামত। এর সাথে পাহাড়টোয়েন্টিফোর ডট কম এর সম্পাদকীয় নীতিমালার কোন সম্পর্ক নেই।)