অদিতি আফ্রোদিতি
‘সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ না থাকা’ ও ‘একদলীয় অগনতান্ত্রিক নির্বাচন বর্জনের’ অংশ হিসেবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করা পাহাড়ের আঞ্চলিক দলগুলো এবার অংশ নিচ্ছে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে। ফলে দৃশ্যত একতরফা জাতীয় নির্বাচনের ম্যারম্যারে পরিস্থিতি পাল্টে গিয়ে পাঁচ মাস পরেই যেনো ফিরে আসছে প্রকৃত ভোটযুদ্ধ,যেখানে সেয়ানে সেয়ানে লড়াইয়ের আভাসই মিলছে !
বরাবরই পার্বত্য তিন জেলায় শক্তিশালী সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক থাকা পাহাড়ের আঞ্চলিক তিন দল সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস), পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএনলারমা), প্রসীত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এবং ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ-গনতান্ত্রিক)। এর বাহিরে কুকিচীন বা মগ পার্টি হিসেবে পরিচিত দুই সশস্ত্র আঞ্চলিক দলের নির্বাচনে সরাসরি অংশগ্রহণের ইতিহাস নেই। সঙ্গত কারণেই নির্বাচনের রেসে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে আঞ্চলিক চার দল।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র মুখপাত্রদের কাউকেই এখন আর কথা বলার জন্য পাওয়া যায়না। সঙ্গতকারণেই জানার জন্য যোগাযোগ করা হয় সংগঠটির একজন প্রভাবশালী নেতার কাছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, হ্যাঁ, আমরা উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছি,বেশ কয়েকটি উপজেলায় আমরা নির্বাচন করব এবং আমাদের সমর্থিত প্রার্থীরা স্বতন্ত্র পরিচয়ে নির্বাচন করবেন। তিনি বলেন, নির্বাচন যদি সরকার তার প্রতিশ্রুতিমত সুষ্ঠু ও অবাধ করেন,তবে আমরা বেশ কয়েকটি উপজেলায় নির্বাচত হব নিশ্চিত।
অন্যদিকে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)’র মুখপাত্র অংগ্য মারমা বলছেন, একটি গনতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে সব নির্বাচনেই তো আমাদের অংশ নেয়ার কথা এবং আমরা নিতেও চাই। কিন্তু সরকার নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে বলেই আমরা বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিইনি। এবার স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এই নির্বাচনে আমরা অংশ নিব। বর্তমানে আমাদের সমর্থিত ৫-৭ জন উপজেলা চেয়ারম্যান আছেন, আশা করছি এটা এবার বাড়বে,যদি নির্বাচন সুষ্ঠু ও চাপমুক্ত পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি( এমএনলারমা)’র কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সাধারন সম্পাদক ও দলটির মুখপাত্র সুদর্শন চাকমা বলছেন, আমরা বরাবরই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়ে আসছি, এবারও অংশ নিব। ইতোমধ্যেই নির্বাচনের বিষয়ে আমাদের বেশ কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে। রাঙামাটির বাঘাইছড়ি ও খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে নিশ্চিত আমরা নির্বাচন করব। দীঘিনালা এবং নানিয়ারচরের বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত নিইনি আমরা।
অন্যদিকে ইউপিডিএফ(গনতান্ত্রিক) এর প্রধান জলোয়া চাকমা জানাচ্ছেন,অবশ্যই নির্বাচনে আমরা অংশ নিবো। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে। কোথাও সরাসরি আমাদের প্রার্থী থাকবে,কোথাও কোথাও আমরা নীরবে সমর্থন করব এবং ভূমিকা রাখব। রাঙামাটির নানিয়ারচর এবং বিলাইছড়ি উপজেলায় নিজেদের সরাসরি সমর্থিত প্রার্থীর নির্বাচন করার সম্ভাবনার কথাও জানালেন সংগঠনটির প্রধান।
আঞ্চলিক চারটি দলের মধ্যে জনসংহতি সমিতি(এমএনলারমা) এবং ইউপিডিএফ (গনতান্ত্রিক) সরকারঘনিষ্ঠ দল হিসেবেই পরিচিত। তাদের নির্বাচন সরকারি দলকে খুব একটা বেকায়দায় না ফেললেও সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি ও প্রসীত খীসার ইউপিডিএফ এর এই নির্বাচন অংশগ্রহণ করা,বিপাকে ফেলতে পারে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগকে। যদি এই দুটি দল নির্বাচনে অংশ নেয় তবে বর্তমানে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বেশ কয়েকজন নেতার বিজয়ী হওয়া বেশ কঠিনই হবে,কারণ প্রতীক ছাড়া নির্বাচন হওয়ায় প্রায় প্রতিটি উপজেলাতেই আওয়ামীলীগের একাধিক প্রার্থী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
আঞ্চলিক চারদলের প্রভাব মূলত যার যার প্রভাবাধীন এলাকাতে হলেও অন্য উপজেলাগুলোর নির্বাচনেও কোন না কোনভাবে প্রভাব ফেলার ক্ষমতা রাখে অন্তত তিনটি দল। প্রধানত আঞ্চলিক দলগুলো বাঘাইছড়ি ছাড়া অন্য কোন উপজেলাতে নিজেদের মধ্যে লড়াই করার ইতিহাস বিরল,এবারও তার ব্যত্যয় হবে বলে মনে হয়না। তবে রাঙামাটির প্রায় প্রতিটি উপজেলাতেই কমবেশি প্রভাব আছে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির,যেভাবে খাগড়াছড়ির প্রতিটি উপজেলাতেই প্রভাব আছে ইউপিডিএফ’র।
আঞ্চলিক দলগুলোর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাকে কিভাবে নিচ্ছে আওয়ামীলীগ, এমন প্রশ্নের জবাবে রাঙামাটি জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক হাজী মোঃ মুছা মাতব্বর জানিয়েছেন, আঞ্চলিক দলগুলোর নির্বাচনে অংশগ্রহণকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে তাদের আসা না আসা নির্বাচনে কোন প্রভাব ফেলবে না। যদি তারা অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করতে না পারে,তবে জনগণ বিপুল ভোটে আমাদের দলের নেতাদেরই বিজয়ী করবেন। কারণ গত ১৫ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশে যে বিপুল উন্নয়ন কর্মকান্ড হয়েছে তার পুরষ্কার জনগণ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো উপজেলা নির্বাচনেও দেবে বলে আমার বিশ^াস।’
রাঙামাটিতে সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচনে রাঙামাটির ১০ টি উপজেলার মধ্যে ৫ টিতে বিজয়ী হয় আওয়ামীলীগ। আর অন্য ৫ টি তে জয় ভাগাভাগি করে নেয় দুই জনসংহতি সমিতি। আওয়ামীলীগের চেয়ারম্যান যেসব উপজেলায় বিজয়ী হয় সেগুলো হলো-রাঙামাটি সদর,লংগদু,কাপ্তাই,কাউখালী,রাজস্থলী উপজেলায়, জনসংহতি সমিতি ( জেএসএস-সন্তু) বিজয়ী হয় বিলাইছড়ি-বরকল-জুরাছড়ি উপজেলায়, এবং জনসংহতি সমিতি( এমএনলারমা) বিজয়ী হয় বাঘাইছড়ি,নানিয়ারচর উপজেলায়।
সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সমর্থনে নির্বাচিত রাঙামাটির বরকল উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান বিধান চাকমা বলছেন, দল থেকে এখনো কিছু বলে নাই। তবে আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত। যদি সার্বিক পরিস্থিতি,ভোটের পরিবেশ অনুকূল থাকে এবং অন্যান্য সব দল নির্বাচনে আসে তবে নিশ্চয়ই নির্বাচন আমরাও অংশ নিবো।
সর্বশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জনসংহতি সমিতি(এমএনলারমা)র সমর্থনে নির্বাচন করা নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান প্রগতি চাকমা বলছেন,‘ আমি এবার জনগণের সমর্থনেই নির্বাচন করব। কোন দলের সমর্থনে নয়।’ জনসংহতি সমিতি (এমএনলারমা) বা ইউপিডিএফ (গনতান্ত্রিক) কারো সমর্থন নিবেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাব কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, আমি জনগণের প্রার্থী,জনগণের সমর্থনে,জনগণের ভোটেই আবার নির্বাচিত হওয়ার আশা রাখছি।’
তবে যোগাযোগ করা হলেও ফোন ধরেননি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের মনোনয়নে নির্বাচিত চেয়ারম্যান প্রার্থী রাঙামাটি সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শহীদুজ্জামান মহসিন রোমান এবং কাউখালী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সামসুদ্দোহা চৌধুরী।
তবে একই দল থেকে নির্বাচিত আরেকজন রাজস্থলী উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি উবাচ মারমা বলেন, দল থেকে এখনো কিছু বলেনি, আমিও চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত নিইনি। দেখা যাক কি হয়। পরে জানাব আপনাদের।’
সবশেষ ভোটে সবচে বড় সহিংসতা
২০১৯ সালে ১৮ মার্চ রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলা নিবার্চনের দিন একটি নির্মম হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে। উপজেলার কংলাক এলাকার কেন্দ্র থেকে ব্যালট পেপার বহনকারী গাড়ি নিয়ে প্রিজাইডিং অফিসার আব্দুল হান্নান আরবের নেতৃত্বে আনসার-ভিডিপি সদস্যরা বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ে ফিরছিলেন। পথিমধ্যে নয় কিলো এলাকায় একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী নির্বাচনকর্মীদের বহনকারি গাড়ীবহর লক্ষ্য করে এলোপাথারি ব্রাশফায়ার করলে ঘটনাস্থলেই প্রিজাইডিং অফিসারসহ ৮ জন নিহত হন।
নিহতরা হলেন প্রিজাইডিং অফিসার মো. আব্দুল হান্নান আরব, বাঘাইছড়ি কিশালয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সহকারি প্রিজাইডিং অফিসার মো. আমির হোসেন (৪০), ভিডিপি সদস্য মো. আল আমিন (১৭), বিলকিস আক্তার (৩০), মিহির কান্তি দত্ত (৩৫), জাহানারা বেগম (৩৭) ও মন্টু চাকমা (৩৫)। আহত হয় ৩৩জন। ঘটনার পর পুলিশ বাদী হয়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের নাম উল্লেখ্য করে মামলা করে। এই ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত করা হয় বাঘাইছড়ি উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতা বড়ঋষি চাকমাকে।
দুই দফার ভোটে যেসব উপজেলা
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিলে প্রথম দফায় আগামী ৮ মে পার্বত্য চট্টগ্রামের ১২টি উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। উপজেলাগুলো হলো রাঙামাটি জেলার সদর উপজেলা, কাউখালী, জুরাছড়ি ও বরকল। খাগড়াছড়ি জেলার মনিকছড়ি, লক্ষীছড়ি, রামগড় ও মাটিরাঙ্গা। বান্দরবান জেলার সদর উপজেলা, রোয়াংছড়ি, থানছি ও আলীকদম উপজেলা।
২১ মার্চ নির্বাচন কমিশনের স্মারক নং-১৭.০০.০০০০.০৭৯.৪০.০০৪.২৪-১২৫ মূলে জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালা ২০১৩ এর বিধি অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন এতদ্বারা সংযোজিত তফসিলে বর্ণিত উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে জারিকৃত প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানানো হয়, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমার শেষ সময় ১৫ এপ্রিল, বাছাই ১৭ এপ্রিল, প্রত্যাহারের শেষ সময় ২২ এপ্রিল। প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হবে ২৩ এপ্রিল এবং ভোটগ্রহণ হবে ৮ মে।
দ্বিতীয় দফায় ঘোষিত তফশিলে খাগড়াছড়ি জেলার সদর, দীঘিনালা ও পানছড়ি; রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই, বিলাইছড়ি ও রাজস্থলী এবং বান্দরবান জেলার রুমা, লামা ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাচনের তফশিল দেয়া হয়েছে।