জাকির হোসেন, দীঘিনালা ॥
সাম্প্রতিক সময়ে অপ্রত্যাশিত বন্যা হচ্ছে পাহাড়ে। স্থানীয়রা বলছেন, আগে বন্যা হলেও এত কম বৃষ্টিতে এরকম বড় ধরনের বন্যা হতোনা। অবশ্য এর জন্য পর্যবেক্ষক, পরিবেশবিদ এবং গবেষকরা দায়ি করছেন অপরিকল্পিত পাহাড়কাটা, সেগুনের বাণিজ্যিক প্রসার এবং বনাঞ্চল উজাড়কে।
পরিবেশ গবেষক বলছেন, পাহাড়ে কখনো নদী খনন হয়নি। আর বন্যা পরিস্থিতির প্রতিকারের জন্য তাঁদের পরামর্শ হলো, বনায়ন সৃষ্টি, ছড়া ও খাল দখলমুক্ত করা, পরিকল্পনা নিয়ে নদী খনন এবং ১০ থেকে ১৫বছর পর পর রক্ষণাবেক্ষণ করা।
খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার বাবুছড়ার বাঘাইছড়ি দু’অর এলাকার অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আনন্দমোহন চাকমা বলেন, আগে বেশি বৃষ্টিতেও বড় বন্যা হতো না এখন কম বৃষ্টিতেও বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে বন্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে আনন্দমোহন বন উজাড়, পাহাড় কাটা এবং অপরিকল্পিত জুমচাষকে দায়ি করে বলেন, পাহাড় কাটার কারণে ছড়া, খাল ও নদী ভরাট হচ্ছে। এছাড়া অপরিকল্পিত জুম চাষের পদ্ধতিও দায়ি। কারণ জুম চাষ করতে গিয়ে পাহাড়ের সমস্ত গাছ এবং জঙ্গল কেটে সেগুলো আগুনে পুড়িয়ে পাহাড়টি ন্যাড়া করা হয়। আগুনো পুড়ানোর ফলে মাটি নরম হয়ে যায়, বৃষ্টি হলে যা দ্রুত গলে ছড়া, খাল ও নদী ভরাট হচ্ছে। নিজস্ব গতিপথ হাড়াচ্ছে ছড়া, খাল। ফলে বৃষ্টির পানি প্রবাহিত হতে পারে না। এছাড়া বনাঞ্চল উজাড়ও অন্যতম কারণ। আনন্দ মোহন চাকমা আরো বলেন, ব্যক্তিগত বনাঞ্চল উজাড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে অসাধু লোকের কারণে সরকারি সংরক্ষিত বনাঞ্চলও দীর্ঘ সময়ে উজাড় হয়েছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চলে গাছ নেই, বাঁশ বাগানে বাঁশও নেই বললেই চলে। এভাবে পরিবেশ বিনষ্টের কারণে প্রকৃতিও হয়েছে রুক্ষ হয়ে গেছে। আগে বর্ষা মৌসুমে ধীরগতিতে দীর্ঘ সময় বৃষ্টি হতো। এখন সে মৌসুমে সৃষ্টি হয় তাপদাহ। আর শেষ সময় হঠাৎ বৃষ্টি হলেও হয় অতি বর্ষন। পরিবেশ সংরক্ষণ এবং নদী খনন জরুরি প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন আনন্দমোহন চাকমা।
খাগড়াছড়ি পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনের সভাপতি সাংবাদিক প্রদীপ চৌধুরী বলেন, এখন অল্প বৃষ্টিতেই বন্যার সৃষ্টি হয়ে দীর্ঘ সময় পানি জমে থাকে যা আগে হতো না। এর জন্য তিনি নির্বিচারে বন উজাড়, জুমচাষ এবং সেগুন কাঠের বাণিজ্যিক প্রসারকে দায়ি করেছেন। তিনি বলেন, মাইনি নদীর আগে প্রশস্ততা কম এবং গভীরতা ছিল বেশি। আর এখন তলদেশ ভরাটের কারণে গভীরতা কমে গেছে বেড়েছে প্রশ্বস্ততা। সেগুন কাঠের বাণিজ্যিক প্রসারকে দায়ী করার কারণ হিসেবে প্রদীপ চৌধুরী বলেন, কম পরিচর্চায় বেড়ে উঠা দামী কাঠের কারণে পাহাড়ে বেড়েছে সেগুনের বাণিজ্যিক চাষ। কিন্তু সেগুন গাছের নিচে অন্য কোন গাছপালা এমনকি লতা, গুল্মও জন্মায় না। এছাড়া প্রতি বছর সেগুন বাগানে ঝড়েপরা পাতা আগুনে পুড়ানো হয়। ফলে বৃষ্টিতে সেগুন বাগানের মাটি দ্রুত ক্ষয় হয়ে ছড়া, নালা, খাল ও নদী ভরাট হচ্ছে। এর উত্তরনের জন্য বনাঞ্চলসহ পরিবেশ সংরক্ষন, সেগুন বাগান সৃজন নিরুৎসাহিত করণ এবং নদী খননের পরামর্শ দেন প্রদীপ চৌধুরী।
নদী নিয়ে কাজ করেছেন পরিবেশ গবেষক সেলিনা সুলতানা। পাহাড়ের নদী নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে গবেষনাও করেছেন তিনি। সেলিনা সুলতানা বলেন, পাহাড়ে কখনো নদী খনন করা হয়নি। সমতলের চেয়ে পাহাড়ের নদীর বৈশিষ্টও আলাদা। ৩০ বছর আগে পাহাড়ের নদীগুলোর যে গভীরতা ছিল তা এখন অনেক কমে গেছে। এছাড়া বনাঞ্চল উজাড়ের কারণে ডালপালা, বনজঙ্গল এবং বাড়ির ময়লা আবর্জনাও পাহাড়ি ঢলের সাথে গিয়ে ছড়া, খাল ও নদীতে পরে ভরাট হয়েছে। এভাবেই বছর বছর নদীর গভীরতা কমছে। ছড়া, নালা, খাল ভরাট করে বেদখলও হয়েছে। এভাবেই বন্ধ হয়েছে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা। এছাড়া মাটি ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পাহাড়ের বড় গাছগুলোও কেটে উজাড় করা হয়েছে। অপরিকল্পিত পাহাড় কাটার কারণে পাহাড় ধস বেড়েছে।
পরিত্রানের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণসহ নদী খননের পরামর্শ সেলিনা সুলতানার। তবে তিনি বলেন, পাহাড়ের নদীর বৈশিষ্ট যেহেতু আলাদা তাই পরিকল্পনা নিয়ে নদী খনন করতে হবে। এবং ১০ থেকে ১৫ বছর পর পর নদীর যেসব স্থানে মাটি জমাট বাঁধে সেসব স্থান খনন করে পানি নিষ্কাশনের পথ সম্পূর্ণ সচল রাখতে হবে।