শংকর হোড়
রাঙামাটির বরকল উপজেলার ভূষণছড়া ইউনিয়নের চান্দবী ঘাট গ্রামে গত আড়াই মাসে যে পাঁচজন মারা গিয়েছিলেন তাদের একজন জ্বর, রক্তবমি নিয়ে মারা গেলেও বাকিরা কেউ স্ট্রোক, বুক ব্যাথা, কিডনি রোগে আক্রান্তসহ নানান অসুখে মারা গেছেন বলে জানিয়েছেন মেডিকেল টিমের প্রধান ও বরকল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মং ক্যছিং সাগর।
তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার দুপুরে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আমরা চান্দবী গ্রামে পৌঁছার পর প্রথমে রোগীদের চিকিৎসার কাজে নেমে পড়ি। শুরুতে যারা জ্বর, পেটব্যাথা নিয়ে অসুস্থ ছিল তাদের চিকিৎসা প্রদান করি। তাদের শারীরিক বিভিন্ন নমুনা পরীক্ষা করে আমরা বুঝতে পারলাম এটা সিজনাল জ্বরের যে লক্ষণ, সেটাতে তারা আক্রান্ত হয়েছেন। তবে স্থানীয় কবিরাজ তাদের ভয় দেখানোর কারণে তাদের স্বাভাবিক খাবার বন্ধ করে দেয়। তাদেরকে ভাত আর বেগুন ছাড়া অন্য কোনও খাবার গ্রহণে নিষেধ করে দেয়। এতে রোগীরা আরো দুর্বল হয়ে পড়ে। কবিরাজের নিষেধ ছিল প্রচলিত যে ওষুধ কিংবা চিকিৎসা সেটা দেয়া যাবে না, এতে বর্তমানে যারা আক্রান্ত তারা অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
ডা. মংক্যছিং সাগর আরো বলেন, গত ১৭ মার্চ সোনি চাকমা নামে আট বছর বয়সী যে শিশুটি মারা গিয়েছিল, তার মা’র সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি, সোনি চাকমা জ্বরে আক্রান্ত ছিল। জ্বর সারাতে তারা কবিরাজের শরনাপন্ন হলে কবিরাজ তাদেরকে বিভিন্ন গাছের শেখড়ের রস। অনেকগুলো রস খাওয়ানোর ফলে শিশুটির ঘন ঘন বমি হয়, যা একসময়ে রক্তবমি হতে থাকে। এতে শিশুটি মারা যায়। এছাড়া বিমলেশ্বর চাকমা(৫৫) স্ট্রোক ও ডালিয়া চাকমা বুক ব্যথাসহ অন্যান্য রোগে মৃত্যুবরণ করেন। বাকি দুইজনের একজন প্যারালাইসিসের পাশাপাশি হাত-পা ফুলে যাওয়া ও অন্যজনের কিডনি রোগের সমস্যাসহ আগে থেকে বিভিন্ন রোগ থাকায় তারা মৃত্যুবরণ করেন। তবে জ্বর, পেট ব্যাথা ও রক্তবমির বিষয়ে এই চিকিৎসক বলেন, অনেকেই জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল, তবে সেটা স্বাভাবিক সিজনাল জ্বর ছিল। যারা বর্তমানে জ্বরে আক্রান্ত তাদের শরীরে ২-৩টা তাবিজ, শরীরে হলুদ মাখা দেখা গেছে। কবিরাজের পরামর্শে তারা এসব শরীরে দিয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, গ্রামে পাকুড় গাছ নামে একটি বয়সী বৃক্ষ ছিল। সেটি গত জানুয়ারি মাসে কেটে ফেলা হয়। গাছটির কাটার সপ্তাহখানেক পর বিমলেশ্বর চাকমা মারা যান। মূলত তার মৃত্যুর পর গ্রামে রটিয়ে দেয়া হয় গাছের ভ‚ত মানুষের ওপর ভর করেছে। এজন্য কেউ স্বাভাবিক জ্বরে আক্রান্ত হলেও গ্রামবাসী ভাবতো তাকে ভ‚তে ধরেছে। কবিরাজও একই কথা বলায় মানুষের মধ্যে এই বিশ্বাস গাঢ় হতে থাকে, আর পরবর্তীতে আরো কয়েকজন মারা যাওয়ায় সকলেই কবিরাজের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
মেডিকেল টিমের প্রধান ডা. মং ক্যছিং সাগর গ্রামটির দুর্গমতা প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, আমরা বৃহস্পতিবার সকালবেলা রাঙামাটি থেকে ভোরে স্পিডবোটে প্রথমে বরকল পৌঁছি, সেখান থেকে ছোট নিয়ে বরকলের জগন্নাথ ঘাটে সকাল সাড়ে আটটায় পৌঁছি। এরপর পাহাড়ি সরু ও উঁচু-নিচু পথে মোটরসাইকেলযোগে ছোট্ট একটি গ্রামে যখন পৌঁছি তখন সকাল নয়টা। সেই নয়টায় হাঁটা শুরু করে কয়েকটা পাহাড় পাড়ি দিয়ে আমরা দুপুর তিনটার দিকে চান্দবী গ্রামে গিয়ে পৌঁছি। যেখানে নেই কোনও মোবাইল নেটওয়ার্ক কিংবা বিদ্যুতের সুবিধা। গ্রামে শ’খানেক পরিবার বসবার করে। তাদের যাদের যে সমস্যা ছিল, আমরা সাধ্যমত তাদের চিকিৎসা প্রদান করি।
এই বিষয়ে জেলা সিভিল সার্জন ডা. নিহার রঞ্জন নন্দীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, মূলত কুসংস্কারের কারণে ঘটনাটি এত বড় হয়েছে। যারা মারা গেছে তারা আগে থেকেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ছিল, পাশাপাশি হালকা জ্বর আসার পর মৃত্যুবরণ করলে স্থানীয় বৈদ্য বয়সী বৃক্ষ কেটে ফেলার গল্প রটিয়ে দেয়। তারপরও আমাদের মেডিকেল টিম বর্তমানে যারা জ্বরে আক্রান্ত তাদের চিকিৎসা প্রদান করেছে, যারা আক্রান্ত তাদের জ্বর হালকা বলে জানান সিভিল সার্জন।