অরণ্য ইমতিয়াজ
ভারতীয় সীমান্তবর্তী রাঙামাটির উপজেলা ‘বরকল’। পাহাড়ের রাজনীতিতে নানাভাবে এবং নানাকারণেই গুরুত্বপূর্ণ এই উপজেলার রাজনীতিও এই উপজেলার দুর্গমতার কাছে বড় অসহায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির শক্ত এই ঘাঁটিতে কখনো সখনো ঠিকই জিতেছে আওয়ামীলীগ এবং তা পরিচ্ছন্ন ভোটেও। কিন্তু মূলত এবং প্রধানত এখানকার ভোট রাজনীতিতে সবচে বেশি প্রভাব পাহাড়ের প্রভাবশালী আঞ্চলিক দল জনসংহতি সমিতিরই। সর্বশেষ দুই নির্বাচনেও এখান থেকে বিজয়ী উপজেলা চেয়ারম্যান তাই তাদেরই সমর্থিত।
সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বিধান চাকমা,এবারও প্রার্থী হয়েছেন। জনসংহতির সমিতির রাজনীতি ও সমর্থন তার জন্য আশীর্বাদ হলেও ব্যক্তিগত অবস্থান ও জনপ্রিয়তাও তার জন্য বড় পুঁজি। একাধিকবার ভাইস চেয়ারম্যান বা চেয়ারম্যান থাকায় তৃণমূলে তার পরিচিতিও বেশ। আবার চেয়ারম্যান থাকাকালে স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সবকিছুতেই কমবেশি সমন্বয় করে কাজ করায় প্রশাসনও তার উপর বিরক্ত নয়। বিধান চেয়ারম্যান হওয়ার আগে ভাইস চেয়ারম্যানও ছিলেন। টানা দুই দফা দুই দায়িত্ব পালন করা বিধান স্থানীয় প্রশাসনেরও বেশ আস্থাভাজন, আবার বরকল উপজেলায় জনসংহতির সাংগঠনিক ভীতও বেশ শক্ত। ফলে জনসংহতির বিশাল ভোটব্যাংক আর নিজের জনপ্রিয়তায় ভর করে তাকে আবারো উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে দেখাটা অবিশ^াস্য কিছু নয়। তবে ভোটের এবারকার পরিবেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন তিনি। প্রকাশ্যেই জানিয়েছেনও তা।
২০০৯ সালে এই উপজেলাতেই অপহৃত থাকা অবস্থাতেই চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে সবাইকে চমকে দেয়া সন্তোষও ছেড়ে কথা বলবেন না। ১৯৯০ সালে প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন সন্তোষ। এরপর ২০০৯ সালেও। জয়ের পাশাপাশি পরাজিতও হয়েছেন একাধিকবার। কিন্তু বরকলে জনসংহতি সমিতির শক্ত ঘাঁটিতেও মাথা উঁচু করে সাহসের সাথে লড়াইয়ের ক্ষমতা রাখেন তিনিই। কারণ আওয়ামীলীগের ভোটের পাশাপাশি স্থানীয় পাহাড়ীদের একটি উল্লেকযোগ্য অংশের কাছেও আছে তার জনপ্রিয়তা ও অবস্থান। ব্যক্তিগতজীবনেও ভীষণ সাহসী সন্তোষ। এবার জয়ের জন্য মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। মূলত জেলা আওয়ামীলীগের নেতা হলেও তার রাজনীতির ভীত বরকলেরই। ফলে তিনি কখনই বরকলের সাথে বিচ্ছিন্ন থাকেননা। ফলে আওয়ামীলীগের হেভিওয়েট নেতা ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সন্তোষ কুমার চাকমার সাথে বিধান চাকমার ‘ওয়ান টু ওয়ান’ দ্বৈরথ বেশ জমজমাট হবে বলেই ধারণা সবার।
তবে আঞ্চলিক সংগঠন জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে সশস্ত্র তৎপরতার অভিযোগ এনে সন্তোষ কুমার চাকমা বলছেন, তাদেরতো জনভিত্তি নাই,অস্ত্র দিয়ে জনগণকে প্রভাবিত করে ভোটের পরিবেশ নষ্ট করে তারা। বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে তাদের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা মানুষকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে,আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। ভোটের পরিবেশ ঠিক থাকলে জয়ের নিজের শতভাগ আশাবাদের কথা জানালেন এই নেতা।
সন্তোষ বলছেন, আপনারা সবাই জানেন,বরকলের মানুষকে কারা বছরের পর বছর জিম্মি করে রেখেছে অস্ত্রের মুখে। অবৈধ অস্ত্রের দাপটে সাধারন মানুষ নিরাপদে ভোটও দিতে পারেনা। যদি ভোটাররা ভয়হীন পরিবেশে নিজেদের ভোট প্রয়োগ করতে পারে তারা শান্তির পক্ষেই ভোট দিবেন।’
বরকলের বর্তমান অবস্থা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রভাবশালী এই আওয়ামীলীগ নেতা বলেন, আমিও এখানে অসহায় ও নিরাপত্তাহীন। ফলে আমাকেও নিজের নিরাপত্তার জন্য ভোটের শুরুতেই থানায় জিডি করতে হয়েছে।’
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে বর্তমান চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির সমর্থিত প্রার্থী বিধান চাকমা বলছেন,‘ কারা কি করছে বরকলের মানুষ সেটা জানে। ওনারা সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করতে বাহিরে থেকে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ভাড়া করে শান্তিপ্রিয় বরকলে আনার একটি ঘটনা ইতোমধ্যেই ভিডিওতে ভাইরালও হয়ে গেছে। উল্টো ওনি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন,বিষয়টি হাস্যকর। আমি চাই যেকোন মূল্যে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন এবং প্রশাসনের নিরপেক্ষ অবস্থান। শান্তিপূর্ণ ভোটে যদি আমি হেরেও যাই,তবুও আমি সে পরাজয় মেনে নিয়ে বিজয়ীকে ফুলের মালা পড়াব। কিন্তু ভোটের পরিবেশ যারা নষ্ট করছে,তাদের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ চাই আমি।’ ভোটের পরিবেশ নিয়ে নিজের শংকার কথাও জানান তিনি।
ভোটের পরিবেশ ও নিরাপত্তা নিয়ে বরকল থানার অফিসার ইনচার্জ মিনহাজ মাহমুদ ভূঁইয়া বলেন, ‘আমরা আশা করছি আগামী ৮ মে এখানে শান্তিপূর্ণ ও সুন্দর পরিবেশে ভোট অনুষ্ঠিত হবে। কোন সমস্যা হবেনা।’ প্রার্থীদের আশংকা কেনো ও ভয়ের কারণ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি ‘ধন্যবাদ’ জানিয়ে আর বেশি কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
বরকল উপজেলার নির্বাহী অফিসার ফোরকান এলাহি অনুপম বলেন, ‘ গতকাল আমাদের এখানে আইনশৃংখলা কমিটির সভা ছিলো,সেখানে সবাই উপস্থিত ছিলেন। এমনটি প্রার্থীরাও ছিলেন। সেখানে আইনশৃংখলা বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেছেন,নির্বাচন সুষ্ঠু এবং সুন্দরভাবে হবে। উপজেলার প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে আমিতো এখানে কোন সমস্যা দেখছিনা। আশা করছি সবকিছুই সুন্দরভাবে হবে।’
তবে সহকারি রিটার্নিং অফিসার ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা বেলাল হোসেন জানান, আমাদের সবকিছুই ঠিক আছে। আমরা আইনশৃংখলাবাহিনীর সবাইকে নিয়ে সভা করেছি। তারাও নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা মোতাবেক ভোটারদের নিরাপদে ভোট দেয়ার পরিবেশ নিশ্চিতে কাজ করবেন এবং প্রার্থীদের কোন প্রকান উদ্বিগ্ন না হওয়ার কথা বলেছেন। আমরা আশা করছি শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হবে।’