নভেল করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) প্রভাবে কার্যত লকডাউনে বিপাকে পড়েছে গোটা দেশ। বিশেষত স্থানীয় বাজার-হাটবাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লোকসানের মুখে দেশের কৃষিখাতও। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি জেলায় করোনাভাইরাসের প্রভাবে স্থানীয়ভাবে মৌসুমী ফলের ভালো ফলন হওয়া সত্বেও পাইকারী ক্রেতা ও স্থানীয় বাজারে দাম কমে যাওয়ায় লোকসানের মুখে পড়েছেন ফলচাষিরা। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত করোনা প্রভাবে বিগত দুই সপ্তাহ ধরে স্থানীয় বাজারে পাইকারী ক্রেতারা আসছেন না। অন্যদিকে স্থানীয় ক্রেতারা ঘরবন্দি থাকায় স্থানীয় বাজারেও তেমন বিক্রি নেই মৌসুমী ফলের।
মৌসুমী ফলচাষিরা জানিয়েছেন, অন্যান্য বছরের মত এবারও রাঙামাটিতে আগাম আনারসের ফলন ভালো হয়েছে। তবে বাজারে পাইকার না থাকায় বিক্রি করতেন পারছেন না চাষিরা। অন্যদিকে রাঙামাটিতে তরমুজের ফলনও ভালো হয়েছে। তবে পঁচনশীল এই ফলটির ক্রেতা না থাকায় ক্ষেতে পঁচেই ক্ষতিরমুখে পড়বে চাষিরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর রাঙামাটির বিভিন্ন উপজেলায় তুলনামূলকভাবে ব্যাপক মৌসুমী ফলের চাষাবাদ হয়েছে। পুরো জেলায় ২৩০ হেক্টর জমিতে তরমুজ ও ২১২৫ হেক্টর জমিতে আনারস চাষাবাদ হয়েছে। এ বছর তরমুজ ও আনারসের আগাম ফলনে খুশি চাষিরা। তবে করোনা প্রভাবে যদি চাষিরা মৌসুমী ফল বিক্রয় করতে না পারেন তবে ভালো ফলন হওয়া সত্বেও লোকসানের মুখে পড়বে তারা। বিগত গত ১০ দিন চাষিরা ক্রেতা ও ব্যবসায়ীদর অভাবে এ সমস্যায় পড়েছেন।
বুধবার সকালে জেলা শহরের সমতাঘাটে স্থানীয় বাজার পরিদর্শন করে দেখা গেছে, সকাল ১১টার দিকে জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে আনারস চাষিরা ঘাটে ইঞ্জিনচালিতনৌকাভর্তি আনারস এনে বসে আছেন পাইকারী ক্রেতার অপেক্ষায়। তবে যারা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকারী ফল মৌসুমী ক্রয় করে থাকেন তাদের কাউকে দেখা যায়নি। এতে করে আনারস বিক্রয় করতে না পেরে অলস হয়ে বসে আছেন বিভিন্ন দুর্গম এলাকা থেকে আগত এসব ফল চাষিরা।
রাঙামাটি জেলা সদরের বন্দুকভাঙ্গা ইউনিয়নের আনারস বাগানের মালিক নীতিময় চাকমা জানিয়েছেন, আমি প্রায় ২ হাজার পিস আনারস বাজারে বিক্রয়ের জন্য এনেছি। কিন্তু আজ দাম অনেক কম। করোনাভাইরাসের প্রভাবে বেশিরভাগ পাইকার ব্যবসায়ী রাঙামাটির বাইরে থেকে আসতে পারেননি। তাই স্থানীয়রা কিছু নিলেও ভালো দাম দিয়ে বিক্রয় করা যায়নি। তিনি আরও জানান, বাগানের অগ্রিম আসা আনারসগুলো বাগানেই পঁচে যাবে, যদি সময়মত বিক্রি করতে না পারি। আমি গত সপ্তাহেও বাইরে থেকে আসা পাইকারী ক্রেতার কাছে প্রতিটি জোড়া আনারস বিক্রয় করেছি ৩০-৪০ টাকা দরে। আর এখন প্রতি জোড়া আনারস মাত্র ১০-১৫ টাকায় বিক্রয় করতে হচ্ছে। অন্যান্য বছরেও অগ্রিম আনারস কমপক্ষে বিক্রয় করা যেতো ২৫-৩০ টাকা পর্যন্ত।
দেশের আনারসের রাজধানীখ্যাত জেলার নানিয়ারচর উপজেলা থেকেও সুমন চাকমা নামে এক চাষি আনারস বিক্রয়ের জন্য এসেছেন। সুমন চাকমা বলেন, আমি এ বছর ৫০ হাজার টাকা ব্যয় করে প্রায় দুই একর জমিতে আনারস চাষ করেছি। প্রথমধাপে বাজারে এনে কিছু আনারস বিক্রয় করতে পেরেছি। তবে এখন দাম অনেক কমে গেছে। এমন চলতে থাকলে আমরা লোকসানে পড়ব।
এদিকে জেলা সদর উপজেলার লেমুছড়ি এলাকার তরমুজ চাষি মো. ফজলু মিয়া তাঁর চার বিঘা জমিতে তরমুজ ও বাঙ্গি চাষ করেছেন। ইতোমধ্যে ৩০ হাজারটি বাঙ্গি বিক্রয় করেছেন তিনি। তবে এখনো তরমুজ বিক্রয় করতে পারেননি। ফলচাষিরা ফজলু মিয়া জানান, আমি ক্ষেতের তরমুজ বিক্রয় করতে চট্টগ্রামের অনেক ফল ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু তারা আমাকে বলেছিলো, রাঙামাটিতে ফল কিনতে আসেননি। এখন স্থানীয় বাজারে স্বল্প তরমুজ বিক্রয় করতে পারলেও লোকসানে বিক্রয় করতে হবে।
জেলা শহরের বনরূপা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, স্থানীয় কয়েকজন খুচরা ব্যবসায়ী তরমুজ নিয়ে বসে আছেন। বাজারে মানুষের সমাগম কমে যাওয়া বেচাকেনা একদম নেই বললেই চলে। আবার কয়েকজন তরমুজ ক্রেতা জানিয়েছেন, বাজারে খুচরা তরমুজের দাম বেশি। তাই বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ক্রয় করছেন না অনেকেই।
তরমুজ ব্যবসায়ী বিল্লাল হোসেন জানান, সকাল থেকে তরমুজ বসে আছি। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মাত্র দুইটি তরমুজ বিক্রয় করেছি। খুচরা ক্রেতা সৈকত রঞ্জন চৌধুরী জানান, আমি মাঝারি আকারের একটি তরমুজ নিয়েছে তাও ১৫০ টাকা দিয়ে। হয়তবা বেচাকেনা কম থাকায় খুচরা বিক্রেতারা বেশি দাম চাইছেন।
স্থানীয় পাইকার ফল ব্যবসায়ী মো. বেলাল হোসেন বলেন, আমি সাধারণত পাহাড়ি ফল সংগ্রহ করি এবং গুদামে মজুদ করি। তবে এখন কয়েক সপ্তাহ ধরে করছিনা। কারণ রাঙামাটিতে করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা বড় পাইকাররা আসছেন না।
এ প্রসঙ্গে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক পবন কুমার চাকমা জানান, এটি সত্য যে করোনাভাইরাসের প্রভাবে বহু ফলচাষি বিপাকে পড়েছেন। পঁচনশীল এসব মৌসুমী ফল সময়মত বিক্রয় করতে না পারলে তারা অনেক টাকা ক্ষতির মুখে পড়বেন। আমরা কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে পাইকারী ব্যবসায়ীদের রাঙামাটিতে ফল কিনতে আসতে উৎসাহ দিচ্ছি। তবে তারা আসছেন না।’