—ঞ্যোহ্লা মং
বাবা দিবসে দুটি বন্ধু গ্রুপে লিখেছিলাম,”আমরাও এখন বাবা। বন্ধু বাবাদেরকে শুভেচ্ছা ও
অভিনন্দন ! এসো বন্ধুরা, বাকি জীবনে টুকটাক কিছু সৃষ্টিশীল কাজ করি। যে কাজের জন্য আমাদের সন্তানরা দশ জনের সামনে গর্ব করতে পারে, বলতে পারে। আমরা ছেলেমেয়েদের জন্য নানা সম্পত্তি সংগ্রহ করে থাকি। সে সম্পত্তি দিয়ে সন্তানরা গর্ব করার বদলে মারামারিই করে। কোন সন্তান সম্পত্তি রেখে যাওয়া বাবাকে প্রশংসা করে না, করতে দেখা যায় না”। প্রতিউত্তরে, দুই একজন কিছু করার অভিপ্রায় জানালো, আরো দুই একজন ফিঙ্গার মেরে সমর্থন করলো, এই শেষ।
আমরা মা দিবস, বাবা দিবসে ফেসবুকে ছবি প্রকাশ করে উদযাপন করি। মা-বাবাকে সবাই বলি ভালোবাসি। অনেকে বিহারে গিয়ে প্রদীপ জ্বালায়। পয়সা খরচ করে লোক ডেকে খাওয়ান। বাবারা বেঁচে থাকতে ছেলেমেয়েদের কথা চিন্তা করে, সারা জীবন ত্যাগ করে গেলেও, আমরা সন্তানরা এইটুকুই করতে পারি।
আমাদের বাবারা ‘ছোট কিংবা বড়’,—খুব কম সন্তানকে বাবাকে নিয়ে সময় ব্যয় করতে দেখা যায়। ফেসবুকে স্ট্যাটাস লিখতে গিয়েও কৃপণতা চোখে পড়ে। দুই-তিন-পাঁচ লাইনেই শেষ। বাবাকে নিয়ে এক পাতায় একটি লেখা তৈরিতে আমাদের সময় হয় খুব কম লোকের। অপরদিকে স্ত্রী- ছেলেমেয়েদেরকে দৈনিক খোঁজ খবর নিতে মোবাইলেই অনেকটা সময় ব্যয় করি। বাবাকে নিয়ে লিখতে বললে বলি, “লেখার অভ্যাস নেই”, কিন্তু আমরা ঠিকই পৃষ্ঠাকে পৃষ্ঠা প্রেম পত্র,কবিতা লিখতে পারি।
অন্য সমাজে কেমন জানি না। মারমা সমাজে অনেক শিক্ষিত তরুণ পাওয়া যাবে, যারা তার প্রপিতামহ-প্রপিতামহীর নামও বলতে পারবে না। [নাম ঠিকানা বলতে না পারার হার ৯০ শতাংশ হবে বলে আমি আমার একটি লেখায় দাবি করেছি, দেখুন: ঞ্যোহ্লা মং, ‘শরদিন্দু চাকমা স্যারের বাড়িতে একদিন’, পৃষ্ঠা ২৪৮, শরদিন্দু শেখর চাকমা: জীবন ও কর্ম,২০১৮] আত্নীয়তার বন্ধন খুব হালকা। ভাই-বোনের সন্তানদের মধ্যেও যোগাযোগ সম্পর্ক খুব একটা দেখা যায় না। ভাইবোনের সন্তানদের বুদ্ধি পরামর্শ দিতে গিয়ে দুই এক কথা বাড়তি বললে, তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়। সে যাই হোক। আমি বাবাকে নিয়ে কিছু একটা করতে চাই। অনেক লেখায় উল্লেখ করেছি, বাবা ছিলেন সার্টিফিকেটবিহীন একজন মুক্তিযোদ্ধা। মহালছড়িতে শত্রু পক্ষের লোকের উপস্থিতির তথ্য পেয়ে রাতের অন্ধকারে থানায় গিয়ে খবর দিতে গিয়েছিলেন [দেখুন: ঞ্যোহ্লা মং, ’আমার বাবা: একজন আদর্শ শিক্ষকের প্রতিকৃতি’, ৫মে, ২০১৮, চ্যানেলআই অনলাইন পোর্টাল]। এক সময় উপজেলায় থাকা সম্ভব নয় বুঝতে পেরে, পালাতে বাধ্য হন। ভারতে গিয়ে নিজে স্বশরীরে যুদ্ধে না নামলেও সেখানকার শরণার্থীদের নানাভাবে উপকার করার, সহায়তা করার কথা জানা যায়। বাবার মৃত্যুতে খোলা শোক বইতে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সেই কথাই উল্লেখ করেছেন।
আমার প্রিয় একজন উন্নয়নকর্মী শ্রদ্ধেয় অরুন কান্তি চাকমা, শোকবইতে একটি প্রস্তাব রাখেন, সন্তানরা যেন বাবার স্মৃতি রক্ষার্থে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাবৃত্তির ন্যায় কিছু একটা করেন। তিনি একটি সুন্দর প্রস্তাব রেখেছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে দুইএকজন স্কুল বন্ধুর সাথে কথা বলে পরামর্শ চেয়েছি। তারাও ছাত্রদের বৃত্তি চালুর পক্ষে মত দেন। তবে, আমি ব্যক্তিগতভাবে ছাত্রদের বৃত্তি প্রদানের চেয়ে শিক্ষকদের বেশি উৎসাহিত করার পক্ষে। একজন শিক্ষক যদি দায়িত্ব পালন করেন, পুরো গ্রাম, এলাকা আলোকিত হতে বাধ্য। আমার বাবা শিক্ষকের ন্যায় শিক্ষকতা করেছিলেন বলে ছাত্র, শিক্ষক, এলাকাবাসী নানাভাবে উপকৃত হয়েছিলেন।
শুধু তাই নয় বাবা ইউপি মেম্বার থাকাকালিন সময়েও যা পেতেন সব বিলিয়ে দিতেন বলে এখনো লোকের মুখে মুখে শুনা যায়। বাবার কর্মোদ্যমকে ধরে রাখতে, শিক্ষকদের শিক্ষকতায় ফিরিয়ে আনতে, সমাজের জন্য সময় বিনিয়োগে আগ্রহী করে তোলতে, আমি ব্যক্তি উদ্যোগে বন্ধু, এলাকার মুরব্বিদের সহযোগিতা নিয়ে তিনটি কাজ করতে চাই।
প্রথম কাজটি হবে বাবাকে নিয়ে একটি স্মৃতি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করা। বইটি প্রকাশ করতে চাই বাবার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে। ইতিমধ্যে আমার কিছু লেখা সংগ্রহে এসেছে। বাবার ছাত্র, সহকর্মী, এলাকাবাসীদের লেখা আর শোকবইতে স্বাক্ষরকারীদের মন্তব্যগুলোকে নিয়ে প্রথম স্মারকগ্রন্থ সাজাতে চাই। এই লেখাটির পাঠক মাত্রই, বাবার পরিচিত, ছাত্র, শিক্ষকদের প্রতিও আমায় লেখা পাঠানোর আহবান থাকলো। প্রস্তাবিত বইটিতে লেখা পাঠালে, ছোট পরিসরে লেখকদেরকে দিয়েই বইটির মোড়ক উম্মোচন অনুষ্ঠান করা হবে।
দ্বিতীয় ইচ্ছা হলো, বাবার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী দিনে উপজেলার একজন সেরা শিক্ষককে ”মংসাথোয়াই মাস্টার স্মৃতি পুরস্কার” প্রদানের ঘোষণা করা। আমি আমার সামর্থ দিয়ে প্রতিবছর এই পুরস্কারটি চালিয়ে নিতে চাই। উপজেলা পযার্যে একজন সেরা শিক্ষক নিবার্চনের লক্ষ্যে ৫-৭জনের প্রতিনিধি নিয়ে একটি কমিটি গঠন করতে চাই। কমিটিতে শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে দুইজন আলোকিত শিক্ষক, একজন সাংবাদিক, সমাজের একজন প্রতিনিধি (জনপ্রতিনিধি/হেডম্যান/কারবারি/মুরব্বি), একজন নারী প্রতিনিধি আর পরিবারের পক্ষ থেকে আমি বা আমার প্রতিনিধি থাকবেন। পুরস্কারের একটি নির্দিস্ট অর্থমূল্য থাকবে, একটি ক্রেস্ট থাকবে, একটি সার্টিফিকেট সাথে একটি সুন্দর ফুলের তোড়া রাখা হবে। আমি এলাকার সচেতন নাগরিকদের সহায়তায় এই কাজটি প্রতি বছর চালিয়ে নিয়ে যেতে চাই। আমার অবর্তমানে যাতে প্রক্রিয়াটি চালু থাকে তার জন্যও একটি কাঠামো তৈরি করে দিয়ে যেতে চাই। স্বপ্ন দেখি প্রস্তাবিত ”মাংসাথোয়াই মাস্টার স্মৃতি পুরস্কার” হবে উপজেলা পর্যায়ে একটি অন্যতম সম্মানজনক পুরস্কার। একদিন উপজেলার শিক্ষকগণ এই পুরস্কারটির ঘোষণা শুনতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবেন।
তৃতীয়ত বাবা একজন সার্টিফিকেটবিহীন মুক্তিযোদ্ধা। এলাকায় অন্যতম একজন সেরা শিক্ষক। পরোপকারি, জনপ্রতিনিধির ভূমিকা পালন করতে গিয়েও রেখে গিয়েছেন কিছু ব্যতিক্রমী উদাহারণ। যে স্কুলে গিয়েছেন, সে স্কুলকে সাজাতে চেয়েছেন। আবাসিক স্কুলের বড় বড় গাছগুলো বাবার লাগানো। বেঁচে থাকা সিঙ্গিনালা ঘাটের একমাত্র গাছটি বাবার লাগানো। মহালছড়ি উপজেলায় শিক্ষা বিস্তারের পিছনে বাবার অবদান অনেক। বাবার মৃত্যু দিনে এলাকায় পরিচিত মুরব্বিগণ যারা দেখতে এসেছেন, জিজ্ঞেস করলে বলেছেন, “তোমার বাবার ছাত্র ছিলাম”। বাবার সুযোগ ছিল পয়সা কড়ি বানানোর, কিছু রাখেননি, করেননি। বর্তমানে গ্রামের রাস্তাটি পিচ ঢালাই করা সুন্দর পাকা রাস্তা হয়েছে। বাবার প্রয়োজনে গ্রামটির লাগোয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকলেও একজন নার্স পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। বাবা অবসরে গেলে বাজারবাসীরা যে সম্মান দেখিয়েছিলেন, আমাকে এখনো আনন্দিত,গর্বিত করে। বাবার অবদানগুলোকে ধরে রাখতে গ্রামের ভিতর দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটি বাবার নামে নামকরণে সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা পেতে চাই। রাস্তাটি বাবার নামে নামকরণ করাতে চাই। বন্ধু, বাবার ছাত্র, সহকর্মী, এলাকাবাসীসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা পেলে খুশিতে সহযোগীদের নাম নিয়ে আরো একটি লেখা লিখতে চাই।