আরমান খান, লংগদু ॥
বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। বিশাল এই জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রুপান্তর করতে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদেরও সমান গুরুত্ব রয়েছে। নারীর শিক্ষা, সম্পদ, নেতৃত্ব, ক্ষমতায়ন ও অধিকার বাস্তবায়নে সচেতনতার বিকল্প নেই। উন্নয়নের স্বার্থে নারীকে এগিয়ে নেয়া সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। সরকার নারীদের সচেতন করতে ২০১৬ সাল থেকে শুরু করেছে ‘তথ্য আপা’ নামের প্রকল্প। প্রকল্পটি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে মহিলাদের ক্ষমতায়ন প্রকল্প (২য় পর্যায়) হিসেবে কাজ শুরু করেছে দেশের প্রতিটি উপজেলায়।
জাতীয় মহিলা সংস্থা, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি উপজেলায় তথ্যসেবা কার্যালয় খোলা হয়েছে। এ সেবা কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন নানা বিষয়ে তথ্য জানেন এবং সেবা নেন নারীরা। পাশাপাশি প্রতিটি গ্রামে নারীদের নিয়ে উঠান বৈঠক করেন তথ্য আপা। এসব উঠান বৈঠকে প্রশাসনের কর্মকর্তা, নারী জনপ্রতিনিধি, সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দরা উপস্থিত থেকে মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে নারীদের সচেতন করার কাজ করছেন।
এমনই একটি উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় মাইনীমূখ মডেল হাই স্কুলে অধ্যায়নরত নবম ও দশম ছাত্রীদের নিয়ে। বৃহস্পতিবার (৩১ আগস্ট) সকালে স্কুল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ছাত্রীদের নানা বিষয়ে সচেতন করার পাশাপাশি বাল্য বিবাহকে ‘না’ বলার শপথ করান উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও)। এ সময় বৈঠকে উপস্থিত নবম ও দশম শ্রেণি পড়–য়া বিদ্যালয়ের শতাধিক ছাত্রী হাত তুলে বাল্য বিবাহকে ‘না’ বলার শপথ করে। কোনো মেয়ে শিশু বাল্য বিয়ের সম্মূখীন হলে স্থানীয় ইউপি সদস্য, বিদ্যালয়ের শিক্ষক অথবা ইউএনওকে জানানোর পরামর্শ দেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সাইফুল ইসলাম’র সভাপতিত্বে উঠান বৈঠকে বক্তব্য রাখেন, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মীর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ারা বেগম, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রফিকুন্নেছা রুজি প্রমূখ।
বক্তারা বলেন, “বাল্যবিবাহ একটি সামাজিক ব্যাধি, এটা নারী ও শিশু নির্যাতনের সামিল। শিশু বয়সে মেয়েদেরকে বিয়ের মতো কঠিন পরিস্থিতির সম্মূখীন করে তাদেরকে শারীরিক ও মানসিকভাবে পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে। এর দ্বায় আমরা কেউ এড়াতে পারি না। আমাদের সকলের দায়িত্ব নিয়ে এই সামাজিক ব্যাধির প্রতিকার করতে হবে। মেয়ে শিশুদের শিক্ষা গ্রহনের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরী করা যাবে না। মেয়েদেরও আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখতে হবে। পড়ালেখা করে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে যেতে হবে। নারীরা শিক্ষিত ও সচেতন না হলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে।”
বক্তারা আরো বলেন, “পারিবারিক ও নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে শিশুদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে পরিবারের নারীদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সামাজিক নানা কুসংস্কার থেকে নিজেদের মুক্ত করে সচেতন ও সাবলম্বী হতে হবে নারীদের। নারী মুক্তির জন্য সচেতনতার বিকল্প নাই।”
প্রকল্পের লংগদু উপজেলা কার্যালয় থেকে জানা যায়, উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে প্রতি মাসে ২টি করে এমন উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও মাসে অন্তত তিন শতাধিক নারীকে তাদের বাড়িতে গিয়ে ‘ডোর টু ডোর’ সেবা দেন এ প্রকল্পের কর্মীরা। পাশাপাশি ফোনের মাধ্যমেও গ্রামীন মহিলাদের জীবন ও জীবিকা সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে যেমন স্বাস্থ্যগত সমস্যা, বাল্যবিবাহ, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, চাকরি সংক্রান্ত তথ্য এবং আইনগত সমস্যায় সহযোগীতা নেন নারীরা। এছাড়াও তথ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে ব্লাড পেশার পরীক্ষা, ওজন পরিমাপ ও ডায়াবেটিস পরীক্ষার মতো প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছেন গ্রামীণ নারীরা।
এ বিষয়ে তথ্য আপা সূচিরা চাকমা বলেন, গ্রামীন নারীদের কল্যাণে কাজ করাই তথ্য আপার মূল দায়িত্ব। আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করছি নারীদের সচেতন করার পাশাপাশি স্বাবলম্বী করতে। নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে ‘মিনা গ্রুপ’ নামে একটি প্লাটফর্ম তৈরি করেছি। এখানে নারীরা বিউটিফিকেশন, হস্তশিল্প ও সেলাইয়ের কাজ করে স্বাবলম্বী হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, নারীদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বাল্যবিবাহের মতো অভিযোগই আমাদের কাছে বেশি আসে। আমরা প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করি।
তথ্য আপার মাধ্যমে নারীদের সচেতন করার বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাইফুল ইসলাম বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দেশ উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলছে। আর উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন। এরই অংশ হিসেবে জাতীয় মহিলা সংস্থার আয়োজনে সারা দেশব্যাপী যে উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে তা থেকে নারীদের সচেতন ও স্বাবলম্বী করার পরামর্শই দেয়া হয়। নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নকে অগ্রগামী করার লক্ষে লংগদু উপজেলায়ও নিয়মিত উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক মুক্তিসহ অন্যান্য সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করা হয়।”