শুভ্র মিশু ॥
বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টি হলেও, হ্রদে উৎপাদিত মাছের ওপর নির্ভর করে বর্তমানে রাঙামাটির একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী জীবিকা নির্বাহ করছে। কিন্তু কাপ্তাই হ্রদ হতে মৎস্য আহরণের পরিমাণ প্রতিবছরই কমছে যার কারণে এই পেশাকে ঘিরে জীবিকা নির্বাহ করা সকলের মধ্যে যেমন চিন্তার ভাজ দেখা দিয়েছে, তেমনি সরকার হারাছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্রগুলো পলি জমে নষ্ট হওয়া এবং হ্রদে পর্যাপ্ত পানি না হওয়ায় অবতরণ ঘাটে মৎস্য অবতরণ কমার পিছনে কারণ হিসেবে মনে করছেন বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি)।
ষাটের দশকে প্রমত্তা কর্ণফুলী নদীতে রাঙামাটির আট ও খাগড়াছড়ির দুই উপজেলায় বিস্তৃত প্রায় ৭২৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের জায়গা নিয়ে, জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যনিয়ে তৈরি করা হয় কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদ। কাপ্তাই হ্রদে ছোট-বড় মোট ৪৪ প্রজাতির মাছ আহরণের তথ্য রয়েছে বিএফডিসির কাছে। যার মধ্যে ২৭ প্রজাতির বড় মাছ ও ১৭ প্রজাতির ছোট মাছ রয়েছে। বড় মাছগুলো বিশেষ কিছু প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্রে ডিম ছাড়ে এবং বিএফডিসির নিজস্ব জলাশয়ে পোনা মাছ উৎপাদন করেও লেকে ছাড়া হয়। আর ছোট মাছগুলো হ্রদের তলদেশে কাঁদা মাটিতে বংশ বিস্তার করে থাকে। কিন্তু কাপ্তাই হ্রদের গভীরতা কমার কারণে হ্রদে পানি ধারণ ক্ষমতা যেমন কমছে তেমনি ভাবে সঠিক সময়ে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় হ্রদে পরিমাণ মত পানি হচ্ছে না বর্ষা মৌসুমে। এতে গত কয়েক বছর ধরে শুষ্ক মৌসুমের মাঝামাঝিতেই কাপ্তাই হ্রদের পানি তলদেশে চলে যাচ্ছে। যার কারণে ছোট মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্রগুলোও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
আর কাপ্তাই হ্রদে বড় মাছের প্রাকৃতিক প্রজননের প্রধান চ্যানেল বরকল, কাচালং, সুবলং, রীংক্ষ্যং, যার প্রায় সবগুলোই পলি জমে নষ্ট হয়ে গিয়েছে, এতে বড় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন তেমন একটা হচ্ছে না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সঠিক সময়ে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এবং হ্রদে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় বড় প্রজাতির মাছ জেলেদের জালে ধরা পড়ে যাওয়া, মাছের অভয় আশ্রম থাকলেও সেগুলো চিহ্নিত করণে কোন সাইনবোর্ড কিংবা বিশেষ চিহ্ন না থাকায় হ্রদে আশঙ্কাজনক ভাবে যেমন বড় মাছ কমছে, তেমনি ভাবে হ্রদে পানি কম থাকার প্রভাব পড়ছে ছোট মাছের উপরও।
বিএফডিসির বার্ষিক মৎস্য অবতরণ ও শুল্ক আদায়ের হিসাব হতে দেখা যায়, রাঙামাটি প্রধান বিপণনকেন্দ্র, কাপ্তাই, মহালছড়ি ও মারিশ্যা- এই চার অবতরণকেন্দ্রে মৎস্য অবতরণ হয়েছে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮ হাজার ১০৪ মেট্রিকটন, রাজস্ব আদায় হয় ১৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬ হাজার ৪৫৫ মেট্রিকটন, রাজস্ব আদায় হয় ১২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬ হাজার ১৫৪ মেট্রিকটন, রাজস্ব আদায় হয় ১১ কোটি৫০ লাখ টাকা।
সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫৫০০ মেট্রিক টন মাছ ঘাটে অবতণ হয়েছে, যার থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে ১১কোটি টাকা। এতে বড় প্রজাতির মাছ ছিল ৪৫০মেট্রিকটন বাকি ৫০৫০মেট্রিকটন ছিল ছোট প্রজাতির মাছ। যা বিগত কয়েকবছরের ইতিহাসে সর্বনি¤œ মৎস্য অবতরণ ও রাজস্ব আদায়ে। আর এতে আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে বড় প্রজাতির মাছের হার।
আর প্রতিবছরই মৎস্য আহরণ কমার কারণে কাপ্তাই হ্রদের মৎস্য শিল্পের সাথে জড়িত মৎস্য আহরণ,পরিবহণ ও বিপনন পেশায় কাজ করা ব্যক্তিরা পড়েছেন বিপাকে। তাদের মতে কাপ্তাই হ্রদে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্রগুলো পলি জমে নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং আগের মতো বৃষ্টি না হওয়ায় হ্রদে পর্যাপ্ত পানি না হওয়া। মাছের অভয় আশ্রম থাকলেও সেগুলো চিহ্নিত করণে কোন সাইনবোর্ড কিংবা বিশেষ চিহ্ন না থাকায় দিন দিন মৎস্য উৎপাদনে প্রভাব পড়ছে। হ্রদে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো খনন ও অভয় আশ্রম বৃদ্ধি এবং জালের দৈর্ঘ্য কমিয়ে আনার মাধ্যমে মাছের প্রাকৃতিক প্রজননের ব্যবস্থা করা হলে আগের মতো মাছের উৎপাদন ও আহরণ সম্ভব বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। এতে এই পেশার সাথে জড়িত প্রায় পঁচিশ হাজার জেলে পরিবার, মৎস্য ব্যবসায়ী ও শ্রমিক, বোট চালক, বরফকল মালিক শ্রমিক, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মৎস্য পরিবহনে নিয়োজিত ট্রাক মিনি ট্রাক মালিক শ্রমিকরা যেমন উপকৃত হবে তেমনি ভাবে সরকারের রাজস্ব বাড়বে বলেও মত তাদের।
রাঙামাটি মৎস্য ব্যবসায়ী শিমুল দাশ জানান, কাপ্তাই হ্রদে পানি কম থাকায় এই বছর আমরা হ্রদে মাছ আহরণ শুরুর পর কয়েকমাস মাছ পেয়েছি। তারপর থেকে খুব কম মাছই জালে এসেছে। আর শেষের দিকে জালে তেমন মাছ ধরা পড়েনি বললেই চলে। এতে শেষের দিকে খরচ না উঠায় আমরা সব জাল হ্রদে নামাতাম না। যার কারণে অনেক জেলে শ্রমিক হ্রদে মাছ আহরণ বন্ধ হওয়ার অনেক আগে থেকেই বেকার হয়ে পড়েছিল। তখন আমরা পালা করে তাদের কাজে নিয়োজিত করতাম। মৎস্য পেশায় নিয়োজিতদের বাঁচিয়ে রাখতে হ্রদে যাতে পর্যান্ত পানি রাখার দাবি জানান তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে।
রাঙামাটি মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক উদয়ন বড়–য়া জানান, কাপ্তাই হ্রদে গভীরতা কমে যাওয়ায় ও স্বাভাবিক বৃষ্টি না হওয়ায় হ্রদে পর্যাপ্ত পানি হচ্ছে না। যার কারণে হ্রদে মৎস্য আহরণ খোলার পর পরই জেলের জালে পোনা মাছ ধরা পড়ে যাচ্ছে। এতে সরকার যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে, আমরাও তেমনি কোন ভাবেই লাভোবান হতে পারছি না। হ্রদের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো খনন আমাদের দীর্ঘ দিনের দাবি। হ্রদে অভয় আশ্রমগুলো চিহ্নিত করণের ব্যবস্থা যাতে জেলেরা বুঝতে পারে অভয় আশ্রম কোনগুলো এবং অভয় আশ্রম বৃদ্ধি করা। পাশাপাশি হ্রদে ৩-৪হাজার ফুটের জাল দিয়ে মাছ ধরা হয়। হ্রদে যেহেতু মাছ কম, জালের পরিধি ১হাজার থেকে ১৭শত ফুটের মধ্যে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা। আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে এই ব্যবস্থাগুলো নেয়া হলে হ্রদে মাছের উৎপাদন ও বৃদ্ধি স্বাভাবিক করা সম্ভব।
রাঙামাটি বিএফডিসি ব্যবস্থাপক কমান্ডার মো. আশরাফুল আলম ভূঁইয়া জানান, গত বছরের তুলনায় এই বছর আমাদের অবতরণ ঘাটগুলোতে মাছের অবতরণ কম হয়েছে। যার কারণে রাজস্ব আদায়ও কমেছে। এর কারণ হিসেবে আমি নতুন আসায় বিশদভাবে না জানলেও যতটুকু জেনেছি তার মধ্যে থেকে বুঝতে পরেছি বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় হ্রদে পানি কম হয়েছে এতে প্রথম দিকে বেশির ভাগ মাছ ধরা পড়ে গেছে। কাপ্তাই হ্রদে মাছের প্রাকৃতিক প্রজননের চ্যানালগুলো খননের মাধ্যমে মাছের প্রাকৃতিক প্রজ্জননের পরিমাণ বাড়াতে মন্ত্রণালয়ে একটি প্রকল্প রয়েছে।
রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, কাপ্তাই হ্রদ খননের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে একটি প্রজেক্ট নিয়েছে এবং ডিপিপি প্রণয়নের কাজ চলছে।
প্রসঙ্গত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃত্রিম জলাধার রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ। এটি বাংলাদেশের পুকুরসমূহের মোট জলাশয়ের প্রায় ৩২ শতাংশ এবং অভ্যন্তরীণ মোট জলাশয়ের প্রায় ১৯ শতাংশ। এই হ্রদ স্থানীয় জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখার পাশাপাশি প্রায়২৫ হাজার জেলে মৎস্য আহরণের মধ্য দিয়ে জীবিকানির্বাহ করে আসছে।