অপু দত্ত, খাগড়াছড়ি
এমনিতে পাহাড়ি এলাকা। স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের যানবাহন পেতে কষ্ট হয়। ভাড়া কম পাবে দেখে শিক্ষার্থীদের গাড়িতে তুলতেও খুব আগ্রহী নয় চালকরা। তবে এসবে ব্যতিক্রম সুখময় চাকমা।
সুখময় চাকমা পেশায় একজন সিএনজি চালক। খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা, সাজেকসহ বিভিন্ন সড়কে সিএনজি চালিয়ে সংসার চালান। তবে যাত্রা পথে কোন শিক্ষার্থীকে দেখলে বিনা ভাড়ায় তাদের গন্তব্যে পৌছে দেন। কখন স্কুলে যেতে কখনোবা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে। শুধু শিক্ষার্থী নয় যাদের অর্থ নেই তাদেরকেও পরিবহন করেন। এমনকি বিশেষ দিনে বিনামূল্য যাত্রী পরিবহন করেন সুসময়।
এদিকে নিয়মিত শিক্ষার্থী পরিবহন নয়, তাদের মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া শেখার পাশাপাশি আদর্শ মানুষ হওয়ার পরামর্শ দেন। ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল সুখময় চাকমা নেটিজেনদের প্রশংসায় ভাসছেন।
সম্প্রতি খাগড়াছড়ির কোর্ট চত্বর এলাকায় সুখময় চাকমার কথা হয়। তিনি জানান, পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় শিক্ষার্থীরা কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে হেঁটে পাহাড়, ছড়া পেরিয়ে মূল সড়কে আসে। তারপর গাড়ির জন্য অনেকক্ষন অপেক্ষা করতে হয়। আর সব গাড়ি শিক্ষার্থীদের নিতে চায় না। এসব দেখে আমার অনেক মায়া হয়। তাই গাড়ি চালানোর সময় সড়কের পাশে স্কুল ড্রেস পরা শিক্ষার্থী দেখলে আমি বিনা ভাড়ায় তাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেই।
স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সুসময়ের সংসার। বড় ছেলে সৌম্মক ৭ম শ্রেণিতে পড়ে এবং ছোট মেয়ে ইয়ানা’র বয়স চার বছর।
স্নাতক সম্পন্ন করা সুসময় চাকমা ঢাকার একটি স্বনামধন্য গার্মেন্টস ফ্যাকটরিতে সহকারি ব্যবস্থাপক পদে চাকরি করতেন। পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকতেন।
২০২১ সালে বাবা ভুবন মোহন চাকমার মৃত্যুর পর মা নোনাভি চাকমা একা হয়ে যান। সবশেষ ২০২২সালে মায়ের জন্য ৭০হাজার টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে স্ত্রী সন্তান নিয়ে খাগড়াছড়িতে স্থায়ী হন।
সুসময় চাকমা বলেন, মা একা হয়ে যাওয়ায় চাকরি ছেড়ে খাগড়াছড়ি এসে গার্মেন্টস’র কাপড় বিক্রির পরিকল্পনা করি। কিন্তু পর্যাপ্ত পুঁজি না থাকায় অর্থের অভাবে আর এগুতে পারিনি। তাই মাহেন্দ্র(থ্রি হুইলার) কিনে সংসারের হাল ধরি। এখন গাড়ি চালিয়ে দৈনিক গড়ে ১৫০০টাকা থেকে ৪০০০টাকা পর্যন্ত আয় করি। ২০২৩ সালে ঘরে চুরি হয়ে যাওয়ায় প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা চুরি হয়। নিজ ঘরের অর্ধেক কাজ করে সমাপ্ত করতে পারিনি। এখন ভাড়া বাসায় থাকি।
বিনা ভাড়ায় শুধু শিক্ষার্থী নয়; পর্যটকসহ সব পেশার মানুষ এই সুবিধা পেয়েছেন। প্রতি বছর বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন বিনা ভাড়ায় সারাদিন গাড়ি চালিয়ে থাকেন। অর্থাৎ, সে দিন সুসময়ের গাড়িতে যে সকল যাত্রী পরিবহন করেন কারো কাছ থেকেই তিনি ভাড়া নেন না।
তবে প্রত্যন্ত এলাকার শিশুদের জন্য রয়েছে বিশেষ মায়া। তাইতো চলতি পথে যেখানেই যান না কেন স্কুল ড্রেস পরা শিক্ষার্থী দেখলে বিনা ভাড়ায় পরিবহন করে শান্তি পান সুসময়।
সুসময় চাকমা বলেন, আমাদের পাহাড়ের ছেলেমেয়েরা অনেক সংগ্রাম করে পড়াশুনা করে। ভালো খাবার খেতে পারে না। ভালো পোশাক নেই। শিক্ষায় একমাত্র তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারবে। তাই আমার গাগিতে যখন শিক্ষার্থীরা ওঠে তাদের পড়াশুনায় মনোযোগী হয়ে আদর্শ মানুষ হতে বলি। গাড়ি ভাড়ার টাকা দিয়ে তাদের কিছু কিনে খেতে বলি। তাদের পরিবহন করে আমিও আনন্দ পাই। আমি চাই অন্যরাও সাধ্যমত পাহাড়ের শিক্ষার্থীদের পাশে থাকুক।