শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দাবিতে উত্তাল সারাদেশের প্রতিবাদের ঢেউ এসে পড়েছিলো পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতেও। খুব উল্লেখযোগ্য না হলেও ৫ আগষ্টের আগে বিচ্ছিন্নভাবে একাধিক প্রতিবাদ,প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে এখানকার শিক্ষার্থীরা। এদের মধ্যে এগিয়ে ছিলো কাপ্তাইয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ সুইডেন পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট শিক্ষার্থীরা। সাথে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ,রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাঙামাটি কৃষি গবেষনা ইন্সটিটিউট শিক্ষার্থীরাও কর্মসূচী পালন করে নিজ নিজ ক্যাম্পাসে। রাঙামাটি সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা একাধিক কর্মসূচী পালনের চেষ্টা করে,শিকার হয় ছাত্রলীগের হামলারও। কিন্তু রাঙামাটি শহরের কর্মসূচীগুলো দেশের অন্যান্য জেলার মত ততটা জোরালো ছিলোনা এখানকার নানান বাস্তবতায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোন কমিটিও ৫ আগষ্টের আগে হতে পারেনি এ জেলায়। কিন্তু ৫ আগষ্টের পরেই হঠাৎ অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে উঠে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে একদল শিক্ষার্থী। শহরের নানা ইস্যুতে কর্মসূচী পালন করে আলোচনা তৈরি করে তারা। সকল সামাজিক,রাজনৈতিক ইস্যুতেও তাদের অংশগ্রহণ চোখে পড়তে শুরু করে। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রঘোষিত কোন কমিটিই হয়নি এই জেলায়। কিন্তু নিজেদের উদ্যোগে নানা কর্মসূচী পালন করে সক্রিয় ছিলো একদল শিক্ষার্থী। বিশেষত বন্যার্তদের সহায়তায় তাদের কর্মসূচী ও তারুণ্যের উৎসবে জুলাই প্রদর্শনী ছিলো উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু ৫ আগষ্টের পর যতই সময় গড়িয়েছে,ততই নিজেদের মধ্যকার বিভক্তি স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়েছে তাদের। ৫ আগষ্টের পর নানাভাবে সংগঠনটির সাথে সক্রিয় ও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠা শিক্ষার্থীরা নানান ইস্যুতে নিজেদের মধ্যে অন্তঃকোন্দল,বিরোধ আর স্বার্থের সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। একইসাথে সংগঠনটি রাজনৈতিকভাবে যতই আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করে তখনই একে একে নিজ নিজ সংগঠনে ফিরে যেতে শুরু করে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে থাকারা। বিশেষত ছাত্রদল এবং শিবির কর্মী যারা ছিলেন,পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা নিজ নিজ সংগঠনে ফিরে যায়। ফলে ক্রমশঃ শক্তি হারাতে থাকে প্লাটফর্মটি। সর্বশেষ যে কয়জন অরাজনৈতিক শিক্ষার্থী প্লাটফর্মটি আকড়ে রেখেছিলেন তাদের অন্যতম দুইজন আফিয়া তানসীম ও দ্যুতিমনি তালুকদার। বিগত কিছুদিন ধরে এই দুইজনের নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়ে আসছিলো কার্যক্রম। কিন্তু গত দুইদিনে সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকে বিবৃতি দিয়ে সংগঠন থেকে সড়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন রাঙামাটি সরকারি কলেজের এই দুই ছাত্রী।
৩ মার্চ আফিয়া তাসনীম তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন-আসসালামু আলাইকুম।আমি আফিয়া তাসনিম। রাঙামাটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন প্রতিনিধি। বেশ কিছুদিন ধরে একটা বিষয়ে লিখবো ভাবছিলাম কিন্তু শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা খুব এক্টা ভালো না থাকায় আর লিখা হয়নি। আপনারা অনেকেই জানেন জুলাই আন্দোলনে আমি সরাসরি মাঠ পর্যায়ে আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম এবং সেই থেকে এখন অব্দি সকল সহযোদ্ধাদের প্রচেষ্টায় রাঙামাটিতে নানান কর্মসূচি করার চেষ্টা করেছি আলহামদুলিল্লাহ। তবে যদিও ওভাবে আমার ফেইসবুকে কিছু প্রচার করা হয়নি। যদিও রাঙামাটিতে তেমন বড় পরিসরে কোন আন্দোলন করার সুযোগ হয়নি কারণ রাঙামাটির প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিলো।আন্দোলন থেকে শুরু করে গত ৭ মাসে এই বৈষম্যবিরোধী প্ল্যাটফর্মের পিছনে অনেক সময়,শ্রম দিয়েছি। সিনিয়র, জুনিয়র অনেকের সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। অনেকের সাথে মনমালিন্যও হয়েছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। তবুও সবকিছু উপেক্ষা করে চেয়েছি এই প্ল্যাটফর্মে থেকে নিজের শহরের জন্য,শহরের মানুষগুলোর জন্য ভালো কিছু করার। এই চিন্তা চেতনা থেকেই গত ৭ মাস এই প্ল্যাটফর্মে সময় দেয়া। আর সময় দিতে গিয়ে নিজের পড়াশোনা, একমাত্র ইনকাম সোর্স টিউশন,নিজের পরিবার পরিজন,বন্ধু বান্ধব সবকিছুতে এসেছে দূরুত্ব।কিন্তু, দিনশেষে উপলব্ধি করলাম আসলে এসব কিছুই নয়। কিছু সহযোদ্ধাদের আচরণে খুবই কষ্ট পেয়েছি। সব কেমন যেন অগোছালো, সিনিয়র জুনিয়র মান্য নাই,শৃঙ্খলা নাই। সবাই কেমন যেন নেইম,ফেইম,স্বার্থের পিছে দৌঁড়ায়। সুপরামর্শ দাতা যাদের ভাবতাম দিনশেষে দেখি তাদের অনেকের সেইম অবস্থা। সবাই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে বৈষম্যবিরোধী প্ল্যাটফর্মকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে।তাছাড়া রাঙামাটির বৈষম্যবিরোধী ব্যানারেই যখন বৈষম্য করা হয় (নারী পুরুষ বৈষম্য, সাম্প্রদায়িক বৈষম্য ইত্যাদি) তখন আর এই প্ল্যাটফর্মে কাজ করার পক্ষে আমি অন্তত নই। তাই, সিদ্ধান্ত নিলাম আজ থেকে এই প্ল্যাটফর্মে আমি আর থাকবো না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সকল প্রকার কাজ থেকে নিজেকে অব্যাহতি দিলাম। আমার পড়াশুনার অবস্থা, শারীরিক অবস্থা, মানসিক অবস্থা,আর্থিক অবস্থা সবই বিধ্বস্ত। তাই ভাবলাম এখন নিজেকে টাইম দেয়া উচিত।যেখানে কোন শৃঙ্খলা নাই,লক্ষ্য নাই সেখানে থাকাটা আমার জন্য বেমানান। এই প্ল্যাটফর্মে আমার আবেগ,ভালোবাসা জড়িত। অনেক শ্রম দিয়েছি এই প্ল্যাটফর্মে।তাই কষ্ট হচ্ছে খুব এই প্ল্যাটফর্মের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে। বিগত সময়গুলোতে কারো মনে কোন কষ্ট দিয়ে থাকলে,আমার কাজে কেউ কষ্ট পেলে দয়া করে এই পবিত্র মাহে রমজানের উছিলায় সকলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

আফিয়ার স্ট্যাটাসের পরদিনই ৪ মার্চ নিজের ওয়ালে পোস্ট করেন দ্যুতিমনি তালুকদার। রাঙামাটি জেলা বিএনপির সভাপতি দীপন তালুকদারের কণ্যা ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কৃষিবিদ কাজল তালুকদারের ভাতিজি দ্যুতিমনি তালুকদার নিজের ফেসবুক ওয়ালে লিখেন- দেশের স্বার্থে দেশে হওয়া বৈষম্য ও দুর্নীতি দূর করার উদ্দেশ্যে জীবনের পরোয়া না করে মাঠে নামা। পারিবারিক, সামাজিক ও জাতিগত সকল বাঁধাবিপত্তি উপেক্ষা করে দেশের ভালোর জন্য এতদিন পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সর্বকনিষ্ঠ ছাত্র প্রতিনিধি হিসাবে প্রথম সারিতে থেকে কাজ করেছি, সবসময় চেয়েছি আমার ভালবাসা ও আবেগের এই বৈষম্য বিরোধী প্লাটফর্মকে রাঙ্গামাটিতেও প্রতিষ্ঠা করা হবে জুলাইয়ের চেতনা দিয়ে।