সাগর চক্রবর্তী কমল, মাটিরাঙ্গা ॥
বর্তমানে আমাদের দেশের রফতানি আয়ের অন্যতম উৎস তৈরি পোশাক খাত। আর এই খাতের প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে তুলা। স্বাধীনতাত্তোর দেশে প্রতিনিয়ত তুলার চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার পরও দেশে বাড়ছে না তুলা চাষ কার্যক্রম। অথচ ব্যপকভাবে তুলা চাষের ফলে দেশের তৈরি পোষাক খাত তথা অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে।
তুলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশের ঐতিহ্য, ইতিহাস, সভ্যতা ও অর্থনীতি। এটি আমাদের দ্বিতীয় মৌলিক চাহিদা, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের তুলার তৈরি বস্ত্রের প্রয়োজন হয়। বস্ত্র ছাড়া আমরা একদিনও চলতে পারব না।
খাগড়াছড়ি মাটিরাঙ্গায় ২০২৪-২৫ মৌসুমে ২৭০ জন কৃষক ১৫০ টি প্লটে “সাদা সোনা খ্যাত”হোয়াইট গোল্ড -১/২ সিবি হাইব্রিড-১ জাত এবং পরিক্ষামূলকভাবে বিটি জাতের তুলা চাষ করে সফলতা পেয়েছেন তারা। আগের তুলনায় তুলার উৎপাদন ও দাম উভয় বেড়েছে। তুলা চাষ করলে কৃষি জমির উর্বরতা বাড়ে। তুলা চাষ করতে আগ্রহী কৃষকদের স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়ে থাকে। তাদেরকে তুলা চাষ পদ্ধতি শেখানো হয় এবং মাঠ পর্যায়ে তাদের খোঁজখবর নেয়া হয়।
প্রতি বছর প্রাইভেট জিনার কর্তৃক চাষীদের উৎপাদিত বীজতুলার সুষ্ঠুভাবে বজারজাত করণ বীজতুলার গুনগতমান ও তুলা চাষী কতৃর্ক তুলার ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণে নিয়মিতভাবে তদারকি ও সমন্বয় করা হয়। ফলে তুলা চাষিদের তুলা বিক্রয় করতে বেগ পোহাতে হয় না। হেক্টর প্রতি উফশী ৩টন এবং হাইব্রিড সাড়ে ৩টন তুলা উৎপাদনের আশা করছেন তুলা বিভাগ। গত বছর তুলার প্রতি কেজি ৯৫ টাকা একই সাথে প্রতিমণ তুলা ৩৮০০ টাকা করে বিক্রি করা হয়েছে। যদিও এ বছর এখনো দাম নির্ধারণ করা হয় নি।
এদিকে দেশে তুলার চাষ বাড়লে আমদানি নির্ভরতা কমবে এতে করে দেশ ও কৃষক অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হবে। তুলার আঁশ দিয়ে তৈরি সুতা আর তুলা বীজ থেকে তৈরি তৈল দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভুমিকা পালন করবে বলে মনে করেন অনেকে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সবুজে মোড়ানো ক্ষেতে ধবধবে সাদা তুলা শীতের সকালের শিশির ভেজা শীতল বাতাসে দোল খাচ্ছে। দেখে যেন মনে হয় চন্দ্রিমা রাতে সবুজের মাঠে আলো জ্বলছে। তুলা ক্ষেতটি খাগড়াছড়ি চট্টগ্রাম সড়কের পাশে হবার দরুণ পথে যেতে যেতে যে কারো দৃষ্টি এড়ানো অসম্ভব। তাই পথ চলতে এক ফলক হলেও দৃষ্টিনন্দন তুলা বাগানে নজর দিতেই হবে।
মাটিরাঙ্গা তুলা উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ২০২২-২০২৩ মৌসুমে উফসী জাতের তুলার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮০.১৮ হেক্টর, আর হাইব্রিডে ৪.৮২ হেক্টর। মোট লক্ষ্যমাত্রা ৮৫ হেক্টর জমি। ওই বছরে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা উফসী ২৩৯.১০ মেট্রিক টন, হাইব্রিড ১৫.৯ মেট্রিকটন। মোট ২৫৫ মেট্রিক টন বীজ তুলা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। একই বছরে উফশী তুলা চাষে অগ্রগতি ৭৬.১৭ হেক্টর জমি, হাইব্রিড ৪.৫ হেক্টর জমি। অগ্রগতি উৎপাদন হয় উফসী ২২৮.৫১ মেট্রিকটন, হাইব্রিড১৪.৮৫ মেট্রিকটন। ওই বছরে ১৮০ জন কৃষক তুলা চাষ করে।
২০২৩-২৪ মৌসুমে উফসী জাতের তুলার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮০.১৮ হেক্টর, আর হাইব্রিডে ৪.৮২ হেক্টর। মোট লক্ষ্যমাত্রা ৮৫ হেক্টর জমি। ওই বছরে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা উফসী ২৪৮.৫৫ মেট্রিক টন, হাইব্রিড ১৬.১৪ মেট্রিকটন। মোট ২৬৪.৬৯ মেট্রিক টন বীজ তুলা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। একই বছরে উফশী তুলা চাষে অগ্রগতি ৭৫.৩৬ হেক্টর জমি, হাইব্রিড ৪.৫ হেক্টর জমি। অগ্রগতি উৎপাদন হয় উফসী ২২৬.০৮ মেট্রিকটন, হাইব্রিড১৪.৭৮ মেট্রিকটন। ওই বছরে কৃষকের সংখ্যা বেড়ে ২৩০ জন কৃষক তুলা চাষ করে।
২০২৪-২৫ মৌসুমে উফসী জাতের তুলা চাষ কমে হাইব্রিড বা উচ্চফলনশীল জাতের তুলা চাষে আগ্রহ বাড়ে কৃষকদের। ওই বছরে উফসী জাতের তুলার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫০ হেক্টর, আর হাইব্রিডে ২৫ হেক্টর। মোট লক্ষ্যমাত্রা ৭৫ হেক্টর জমি। ওই বছরে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা উফসী ১৫০ মেট্রিক টন, হাইব্রিড ৮২.৫মেট্রিকটন। মোট ২৩২.৫ মেট্রিক টন বীজ তুলা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। একই বছরে উফশী তুলা চাষে অগ্রগতি ৪৭.৫ হেক্টর জমি, হাইব্রিড ২০হেক্টর জমি। বর্তমানে বীজতুলা উত্তোলন চলমান রয়েছে। এ বছরে কৃষকের সংখ্যা বেড়ে ২৭০ জন।
মাটিরাঙ্গা তুলা উন্নয়ন বোর্ড বিনামূল্যে বীজ সার এবং কীটনাশক প্রদান করা হয়। একই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম তুলা চাষ বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্প কর্তৃক সেচের জন্য প্রণোদনা দেয়া হয়।
তুলা চাষি বিপ্লব ত্রিপুরা বলেন, মাটিরাঙ্গা তুলা উন্নয়ন বোর্ড থেকে বীজ সার সহ সকল ধরণের পরামর্শ পেয়ে আমি তুলা চাষে আগ্রহী হই। গতবার অল্প পরিসরে তুলা চাষে লাভবান হয়ে এবার বেশি জমিতে তুলা চাষ করি এবারও বাম্পার ফলন হবে বলে আশা করছি।
তুলা একটি লাভজনক ফসল, পরিত্যক্ত জমিতে তুলা চাষ করে লাভবান হওয়া যায় জানিয়ে তুলা চাষি বিজয় কৃষ্ণ বলেন, আমি এবারই এক বিঘা জমিতে তুলা চাষ করি। ফলনও বেশ ভাল হয়েছে আশা করছি এই জমিতে ৬০-৭০ হাজার টাকার তুলা বিক্রি করতে পারবো। এছাড়াও সাথি ফসল হিসেবে আমি এ জমিতে বরবটি, লাল শাক ফলাতে পারবো।
মাটিরাঙ্গা তুলা উন্নয়ন বোর্ডের কটন ইউনিট অফিসার মো. সুমন প্রতিনিধি’কে বলেন, মাটিরাঙ্গা উপজেলা তুলা উন্নয়ন বোর্ডের সহযোগিতায় গত ৫ বছর ধরে মাটিরাঙ্গায় তুলা চাষ শুরু হয়েছে। তুলা উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক বিনামূল্যে বীজ সার ও কীটনাশক দেয়ায় কৃষক তুলা চাষে উদ্ধুদ্ধ হয়। ফলে দিন দিন তুলা চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবার আবহাওয়া অনুকূল থাকায় বিঘা প্রতি ১০-১৪ মণ ফলন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।