——-ঞ্যোহ্লা মং
ফিরে চল, ফিরে চল, ফিরে চল, মাটির টানে / যে মাটি আঁচল পেতে চেয়ে আছে মুখের পানে। – রবী ঠাকুরের অতি পরিচিত একটি গান। গানটি থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে হয়তো মিডিয়া ব্যত্তিত্ব শাইখ সিরাজের হৃদয়ে মাটি ও মানুষের একটি পর্বের নাম রেখেছেন ‘ফিরে চল মাটির টানে’। শহর সমাজে নামকরা স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের গ্রামীন মানুষের জীবনযাত্রা এবং কৃষিতে তাদের অবদানকে অনুধাবন করাতে এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে সরাসরি কৃষিকাজে হাতে কলমে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেওয়া হয়। শাইখ সিরাজের ছাদ কৃষিতেও বিত্তবান সৌখিন মানুষদেরকে প্রকৃতির সংস্পর্শে আনতে দেখা যায়। বিত্তবানদের ছাদ কৃষির ফলে সমাজে আমূল পরিবর্তন না হোক তাজা বিষমুক্ত খাবার খেতে পারছেন। ইটের দালানের ভিড়ে এক টুকরো সবুজ সৃষ্টি করে পৃথিবীতে বালুকনা পরিমান হলেও অবদান রাখছেন। বাগান পরিচর্যা করে অনেকের অবসরও কাটবে বেশ।
পাহাড় সমাজে প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মের উচ্চ শিক্ষিত বড় চাকরিজীবি, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উন্নয়নকর্মীদের কর্মস্থল কিংবা ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার জন্য বড় বড় শহরে অনেকে স্থায়ী কেউ বা অস্থায়ী দীর্ঘ মেয়াদে বসতি গড়ে তুলেছেন। তাঁরা নিজেদের সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী সমাজ প্রতিষ্ঠা করছেন। পাহাড় সমাজে তাঁরা মান্যজন, গুণীজন একই সাথে তাঁদের অনেকে বড় ছোট ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানগুলোতে প্রধান আয়োজক, দাতা, অংশীদার হতে দেখা যায়।
পাহাড় সমাজে উচ্চ শিক্ষিতদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে সরব উপস্থিতি পাওয়া যায়। তাছাড়াও আত্নীয় স্বজনদের বিয়ের ন্যায় সামাজিক উৎসবগুলোতে উজ্জ্বল উপস্থিতি অনেকের নজর কাড়ে। যা দেখে অনেকের ন্যায় আমারও ভাল লাগে।
অন্যদিকে কিছু উচ্চশিক্ষিতরা আত্নীয়দের অনুষ্ঠানে, বন্ধু-বান্ধবদের অনুষ্ঠানে, নিজেরা অংশগ্রহণ করলেও নিজেদের পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলোকে সাজাতে, চাকচিক্য বাড়াতে শহরে কমিউনিটি সেন্টারগুলোকে বেছে নিতে দেখা যায়। ফলে গ্রামের আত্নীয় স্বজনদের বদলে শহরে থাকা বন্ধু-বান্ধব পরিচিতজনরা উৎসবে অংশগ্রহণের বেশি সুযোগ পায়। আবার বাবুদের ভাল দিনগুলোতে শহরের বন্ধু-পরিচিতজনরা অধিক প্রাধান্য পেলেও বাবুদের অসুখ-বিসুখে, অসময়ে নিকট আত্নীয় স্বজনরা গুরুত্ব পায়। খাওয়া দাওয়া-বেড়ানোর ন্যায় ভাল সময়ে নিকট আত্নীয়রা স্থান না পেলেও শেষের দিকে জীবনের সায়াহ্নে এসে স্বল্প শিক্ষিত, নিরক্ষর আত্নীয়- স্বজনদের ভিড় দেখা যায়। লক্ষ্য করবেন, এই সময়ে গ্রামবাসী আত্নীয়-স্বজনরা সেবা করাকে ধর্মীয় দায়িত্বে রূপান্তর করে নিরবে তাদের সম্ভবপর সেবা দেওয়ার চেষ্টা করেন। শহুরে পিতা-মাতার ব্যস্ততার ছায়ায় বেড়ে উঠতে গিয়ে সন্তানরাও মাটির টান অনুভব করতে সময় নেয়।
শহুরে শিক্ষিত চাকরিজীবিরা সমাজের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণের ফলে বিহারগুলো দিনকে দিন সুন্দর হয়ে উঠছে। সকলের মাঝে বিহারের প্রতি দুর্বলতাকে কাজে লাগাতে রাজনীতিবিদরাও আগ্রহী হয়ে বিহারের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে। বিহারের সৌন্দর্য বাড়াতে সরকারি-বেসরকারি উভয়খাত থেকে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ অব্যাহত রয়েছে। শিক্ষিতদের বিহার উন্নয়নে পাওয়া যায় বলে গ্রামবাসীরাও খুশি। সে দিক থেকে বিচার করলে শহর শিক্ষিতদের শুধু বিহার উন্নয়নে কাজে লাগিয়েছি। পুরো গ্রামকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, দক্ষতাকে কাজে লাগাতে পারিনি। গ্রামবাসী আর শহর শিক্ষিতদের মাঝে নিরাপদ দূরত্ব রেখে শুধু বিহারকে উন্নয়ন করতে পেরেছি। গ্রামের অন্য দশটি সমস্যায় তাদের অংশগ্রহণ করাতে পারিনি। কিংবা করিনি। একইভাবে শহর শিক্ষিতরা গ্রামের সমস্যার সমাধানে এগিয়ে যায়নি। গেলেও গ্রামীণ মানুষদের নানা বিশেষ্য বিশেষণ ব্যবহার করে নিরাপদে শহরকে আঁকড়ে থেকে শহরে পাহাড়ী সমাজে নিজেকে আবিস্কার করার চেষ্টা করেছি, করে চলেছি।
কালে ভদ্রে উচ্চ শিক্ষিতরা গ্রামে যায়। ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যায়, বিঝু, সাংগ্রাইংতে যায়। মা-বাবাকে উৎসর্গ করার মতো কোন সামাজিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যায়। এর বাইরে গ্রামের ছোটখাট নানা সমস্যাকে আপন করে নিয়ে সমস্যা সমাধানের বেলায় আমরা অনেকে সদা সর্বদা সর্তক দূরত্ব বজায় রেখেছি। ফলে গ্রামে বিহার সুন্দর হলেও আমাদের প্রত্যেকের জীবনে সর্বশেষ ঠিকানা শ্মশানকে চরম অযতœ অবহেলায় ফেলে রেখেছি। লক্ষ্য করলে দেখবেন, গ্রামে কেউ একজন মারা গেলে পরেই ঝোপঝাড়ে পড়ে থাকা শ্মশানগুলো একটু পরিস্কার হয়। পরে আবার জঙ্গলে রূপ পায়। অবহেলায় ফেলে রাখা হয় বলে আমাদের পূর্ব পুরুষদের শ্মশানসব হাত ছাড়া হয়ে গেছে। অনেক পাড়া পাওয়া যাবে শ্মশানও নেই। শ্মশান অবহেলায় রাখার ক্ষেত্রে এক নাম্বারে থাকবেন আমাদের মারমারা। এমনকি গ্রামের সাথে থাকা শ্মশান দখল হয়ে গেলেও টু শব্দটি করি না। বিহার নিয়ে আমাদের যত চিন্তা শ্মশান থাকে ততটা অবহেলায়।
শ্মশানকে আমরা ভয়ের, ভূতপ্রেতের, অপবিত্রের মর্যাদা দিয়ে রেখেছি। শ্মশানকে আমাদের জীবনের শেষ ঠিকানা মানলেও গুরুত্বের বিচারে একেবারে তলানিতে রেখে দিয়েছি।
শ্মশানগুলোকে অন্ধকারে রাখার ফলে আমাদের নিকট আত্নীয়দের মরা মৃত্যুর দিনগুলো চলে যায় হেলায় ফেলায়। মারমাদের গ্রামে গেলে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের জিজ্ঞেস করে দেখুন, খুব ব্যতিক্রম ছাড়া তাদের কেউ প্রপিতামহ-প্রপিতামহীর নাম ঠিকানা বলতে পারবে না।
শ্মশান নিয়ে ধর্ম কি ব্যাখ্যা দেয় জানি না, তবে ইতিহাস জানার জন্য, ইতিহাস সংরক্ষণের প্রয়োজনে শ্মশানগুলোর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হওয়া আবশ্যক। আমরা প্রয়োজনে ছেলেমেয়েদের জন্মদিন ঘটা করে পালন করি, কিন্তু আপনজন, নিকট আত্নীয়দের মরা মৃত্যুকে স্মরণ করি না। হলেও বয়স্কদের দুইএকজনের মুখে মুখেই থাকে। মৃত মানুষটি সর্ম্পকে কোন তথ্য সংরক্ষণের আয়োজন হয় না।
আমরা পূণ্যের প্রয়োজনে বিহার উন্নয়ন, বড় বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেও, আমাদের প্রত্যেকের শেষ ঠিকানা শ্মশানকে দিন দিন অযত্ন অবহেলায় ফেলে রেখে হাত ছাড়া করে চলেছি পুরো পাহাড় সমাজে। আত্নীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবদের শেষ বিদায় জানাতে শ্মশানে মিলিত হই। তাই বিদায় দেয়ার স্থানটিও আরো আকর্ষণীয়, উন্নত, আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন হওয়া আবশ্যক। আমরা যাদেরকে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে বিদায় দেওয়ার জন্য মিলিত হই – সে কি আদৌ বেশি দূর যেতে পারবেন কিনা ভাবতে হবে। আমরা জানি বিমান উড়ার জন্য ছিমছাম পরিপাটি খুঁতহীন রানওয়ে থাকা চাই। আমাদের পঁচা মার্কা বিমানবন্দর থেকে বিদায় দিয়ে খুব বেশি দূর পাঠানো সম্ভব হবে কি? এবং আমরা যাদের বিদায় জানাতে সমবেত হই তাঁকে নিয়ে যেতে আসা দায়িত্ব প্রাপ্ত দেবতা তাঁর উন্নত প্রযু্িক্ত সম্পন্ন বিমানটি আমাদের অন্ধকার শ্মশানে নামিয়ে আনতে কতটুকু আগ্রহী হবেন চিন্তা করতে পারি। ‘স্বর্গের পরিবেশে’ চলে যেতে হলে আমাদের বিমানবন্দরগুলোকেও ঢেলে সাজানো দরকার।
শ্মশানগুলোর (আমি বলি বিমান বন্দর) সুন্দর সীমানা থাকা চাই। হতে হবে যতটা সম্ভব বড় এলাকা নিয়ে। ফুলের বাগান থাকবে। ফলমূলের গাছ গাছালিও থাকবে। ছিমছাম অতীব প্রয়োজনীয় দুই একটি ছোট ছোট স্থাপনা থাকবে। যেমন লাশ ঘর। ভিক্ষুসংঘের বসার ব্যবস্থা। বৃষ্টি বা ঝড়ের দিনে শামিয়ানা টাঙানোর জন্য উন্নতমানের স্থায়ী ফ্রেম থাকবে। ওয়াশ রুমের সুবিধাদি থাকবে। মৃত ব্যক্তির নাম খোদাই করে রাখার একটি স্থায়ী তালিকাও থাকবে, নিয়মিত দেখভালের জন্য লোক থাকবে ইত্যাদি।
ছেলেবেলায় অনেক বার পায়ে হেঁটে মহালছড়ি থেকে খাগড়াছড়ির পুরাতন পথ দিয়ে গিয়েছি। বর্তমান রাস্তা দিয়েও গাড়ি চলার পথ হওয়ার আগে বেশ কয়েকবার হেঁটে গিয়েছি। ফলে এই দুটি রাস্তায় কোথায় কোথায় শ্মশান ছিল আমার খুব ভাল মনে আছে। গত ৩০-৩৫ বছরের ব্যবধানে এই রাস্তার দু ধারে থাকা স্মৃতিচিহ্নগুলোর কোনটিই আর চোখে পড়ে না। সবকটি দখলে গেছে। ফলে আতœীয় স্বজনদের স্মৃতি চিহ্নও আমাদের মাঝে থাকার কথা নয়। থাকলেও হালকা, ভাসা ভাসা কিংবা কারো মুখে শুধু নামটিই থাকবে মাত্র। আমরা যদি শ্মশানগুলোকে অন্ধকার আর ভয়ের থেকে বিমান বন্দরের মর্যাদা দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারতাম, আত্নীয়, স্বজনদের স্মৃতি চিহ্নগুলো অক্ষুন্ন থাকতো। এত সহজে হারিয়েও যেতো না।
‘বিমানবন্দর’ নিয়ে কেউ কাজ করে না বলে শ্মশানগুলো শুধু অন্ধকারই থাকেনি এই শ্মশানকে ঘিরে অন্যান্য নানা আনুষ্ঠানিকতাগুলোও আদি, পুরনো এবং সেকেলের মধ্যেই আটকে আছে। গ্রামের বাইরে কেউ মারা গেলে তাকে আর গ্রামে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। গ্রামে প্রবেশ করতে না পাবার ভয়ে গ্রামে গ্রামে অনেককে পাওয়া যাবে, যারা আধুনিক চিকিৎসা নিতে বাইরে যেতে অনিচ্ছুক। আবার শহরের শিক্ষিত মানুষটিও শহরে চিকিৎসা নিতে গিয়ে মারা গেলে নিজের পিতৃ-মাতৃভিটায় প্রবেশ করতে পারেন না। বান্দরবানে এই প্রথাটি অন্য দুই জেলার তুলনায় খুবই শক্ত বলেই আমার মনে হয়েছে। আমি কিছু পাড়ার কথা জানি যেমন বটতলী পাড়া, মাঝের পাড়া, মেফুওয়া পাড়ায় ডায়রিয়ায় শিশুরা মারা যেতে থাকলেও এক গ্রামের ভিতর দিয়ে অন্য গ্রামের ডায়রিয়া রোগীকে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই বলে অভিভাবকরা শিশুদেরকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে নারাজ।
বিমান বন্দরগুলো অন্ধকারে রাখি বলে, বিমান বন্দর সংশ্লিষ্ট নানা আচারগুলোও এখনো সেকেলের রয়ে গেছে। সময়ের সাথে সাথে কিছু চাকচিক্য দেখা গেলেও বিমান বন্দরকে অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত করে রেখেছি। শ্মশানের আধুনিকায়ন আবশ্যক। গরীব হোক, পয়সাওয়ালা হোক প্রত্যেকের মৃত্যুতে শ্মশানের স্মৃতি ফলকে তাঁর নাম থাকার কথা চিন্তা করতে পারি।
শহর সমাজে থিতু হওয়া অফিসারদের নানা সুযোগ সুবিধাদি থাকলেও শেষ যাত্রার সময়ে ইচ্ছা অনিচ্ছা সত্ত্বেও গ্রামে ছুটতে হয়। গ্রামে প্রবেশ নিয়ে নানা দ্বন্দ্ব শুনা যায়। ভুল বুঝাবুঝির ঘটনাও ঘটে। এমন নানা অসুবিধার কারণে শহরবাসীরা আগামীতে শহরের অদূরে কোথাও শ্মশান বানিয়ে আধুনিক রূপ দিয়ে থাকলে এতে শহর ও গ্রামবাসীর মাঝে যে দূরত্ব বিদ্যমান, তা আরো বাড়িয়ে দেবে।
প্রত্যেক গ্রামের বিমান বন্দরগুলোকে নিয়ে ভাবতে পারলে আমাদের মাঝে সুপ্ত দ্বন্দ্বগুলো কিছুটা হলেও সমাধান হবে বলে আমার ধারণা। শহরবাসী মারমারা সকলে জানেন তাদের এই সমস্যাটি পড়তে হতে পারেন তারপরও এই নিয়ে কথা বলছি না, আলোচনা করছি না। শহরবাসী উচ্চ শিক্ষিত, পয়সাওয়ালা সকলকে শ্মশান সংশ্লিষ্ট সংস্কার নিয়ে কাজ করা উচিত। পাড়ায় পাড়ায় শিক্ষিতদের সমন্বয়ে ঘোষণা থাকা উচিত ‘পাড়াবাসীদের কেউ বাইরে মারা গেলে পাড়া প্রবেশের কোন বাঁধা থাকবে না’। কিংবা ‘আধুনিক চিকিৎসা বান্ধব একটি মারমা গ্রাম’ ইত্যাদি। সংগঠন হিসেবে বিএমএসসি’র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। সমাজে ডাক্তার, নার্স, সমাজকর্মী, উন্নয়নকর্মীদেরও এগিয়ে আসা চাই। স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীদেরও এই সমস্যা নিয়ে কথা বলা উচিত। বড় বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ভিক্ষুদের আলোচনায় সমস্যাটি আসা দরকার। প্রায় প্রতিদিনই হেডম্যান কার্বারীদের নিয়ে নানা প্রশিক্ষণের আয়োজন হতে ফেসবুকে পাওয়া যায়। প্রথাগত নেত্রীবৃন্দদের নিয়ে প্রশিক্ষণ আলোচ্যসূচিতে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এই সমস্যা শুধু শহরে থাকা বাবুদের সমস্যা নয়, গ্রামে বসবাসকারী গ্রামবাসীর জন্যও সমান সমস্যা। সকলে মিলে একযোগে একসাথে গ্রামের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা গ্রহণকে হ্যাঁ বলতে হবে। আধুনিক চিকিৎসা পাওয়া না পাওয়া প্রথা দিয়ে বেঁধে রাখাটি চরমতম অন্যায়। এটি প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার।
শ্মশান বন্দরকে আধুনিক করতে সরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকেও অগ্রাধিকার দিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি শহরে বসবাসকারী মানুষটিকেও গ্রামবাসীর কল্যাণে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। আমাদের কত কত প্রয়োজনে, কত শত মানুষের মোবাইল নাম্বার সংরক্ষণ করে রাখি, অথচ খুঁজলে দেখা যাবে নিজ গ্রামের পাঁচজন মানুষের মোবাইল নাম্বার আমাদের নেই। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে গ্রামবাসীদের সাথে সুন্দর, বন্ধুসুলভ যোগাযোগ থাকা চাই। উভয়ের মাঝে দূরত্ব কমানো গেলে আমাদের অনেক বাঁধা মিলে যেতে বাধ্য। আসুন আমাদের মোবাইলে নিজ নিজ গ্রামের অন্তত পাঁচজনের মোবাইল নাম্বার সেভ করে রাখি। তাদের সাথে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে কথা বলি, সময় মিললে গল্প করি। একইসাথে স্থানীয় প্রথাগত নেতা নেত্রীদেরও স্বীকার করে নেওয়া উচিত, মানুষকে তাঁর প্রয়োজনে গ্রাম ছেড়ে বের হতে হয়। জীবনের গতিশীলতা বাড়াতে মোবিলিটি বাড়াতে হয়। গ্রামের প্রতি টান, মাতৃ-পিতৃভূমির প্রতি ভালবাসাকে অস্বীকার করার, বঞ্চিত করার কোন সুযোগ থাকতে পারে না।
পাহাড় সমাজে শাইখ সিরাজের মতো ব্যত্তিত্ব না থাকুক আমরা নিজ অবস্থানে থেকে ফিরে চল মাটির টানে প্রোগ্রামের ন্যায় নানা গঠনমূলক কার্যক্রম চালু রাখতে পারি। গ্রামে প্রবেশ নিয়ে সমস্যা, গ্রামের বাইরে চিকিৎসা গ্রহণ নিয়ে ভয় ভীতি, শ্মশানের দুরাবস্থার চিত্রের পরিবর্তন আনা আমাদের সকলের দায়িত্ব।
—————————————————————–
[টীকা: ছবিতে থাকা শিশুটি মারা গেছে ১ঘন্টা আগে। গ্রামবাসীদের অনেকে বাড়িটির মাচাং এ বসেছিলেন। আমরা কয়েকজন উন্নয়নকর্মী গ্রামটিতে গেলে মানুষের জড়ো হওয়া দেখে সেখানে গিয়ে জানলাম -তাঁরা মূলত অপেক্ষা করছিলেন শিশুটির মা কখন মারা যাবেন। যাতে একই সাথে মা ও শিশুটিকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া যায়। ঘটনাটি ছিল ২০ জানুয়ারি ২০০৪ সালে মেফুয়া পাড়া, বান্দরবানে। ছবিটি তুলেছেন, ফিরোজ আলম। শ্রদ্ধেয় ফিরোজ আলম এই নিয়ে বাংলাদেশ অবজারভারে একটি লেখাও প্রকাশ করেছিলেন, যা প্রকাশিত হয় ৪ মার্চ ২০০৪ সালে ‘‘Many People in the Hills Dying Unnoticed’’ শিরোনামে। ]
ঞ্যোহ্লা মং, কলাম লেখক। ইমেইল: nyohlamong2@gmail.com