শংকর হোড়
২০১২ সালের ৫ অক্টোবর তৎসময়ে রাঙামাটি পৌর টাউন হলে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ রাঙামাটি জেলা শাখার সর্বশেষ সম্মেলন। সম্মেলনে অমর কুমার দে সভাপতি ও পঞ্চানন ভট্টাচার্য সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়। সেই সম্মেলনের পর কেটে গেছে প্রায় ১১ বছর। কিন্তু আর হয়নি রাঙামাটিতে পূজা উদযাপন পরিষদের সম্মেলন। এই ১১ বছরে তিনবার সম্মেলনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও একবারও হয়নি কাঙ্ক্ষিত সেই সম্মেলন। সবশেষ ২৮ এপ্রিল শুক্রবার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও অমর কুমার দে এর এক রিটের কারণে আপাতত সম্মেলন নিয়ে স্থগিতাদেশ দিয়েছে আদালত। রিটে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক অমলেন্দু হাওলাদার ও সদস্য সচিব রণতোষ মল্লিককে বিবাদী করা হয়েছে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাদির আবেদনের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
পূজা উদযাপন পরিষদের নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলে জানা যায়, ২০১১ সালে পূজা উদযাপন পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে অমর কুমার দে আহ্বায়ক ও সাবেক কাউন্সিলর শিব প্রসাদ মিশ্রকে সদস্য সচিব করে একটি আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন দেয়। তিন মাসের মধ্যে সম্মেলনের মাধ্যমে একটি কমিটি গঠনের কথা বলা হয়। তবে এক বছরের মধ্যে আহ্বায়ক কমিটি সম্মেলন আয়োজন করে। যা তৎসময়ে পৌর টাউন হলে অনুষ্ঠিত হয়। দিনের প্রথম পর্বের সম্মেলন শেষে বিকালের কাউন্সিলে উপস্থিত মন্দির কমিটির সদস্যদের ভোটাভুটিতে অমর কুমার দে সভাপতি ও পঞ্চানন ভট্টাচার্য সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়। এই কমিটি দীর্ঘ সময় পরও সম্মেলন না দেওয়ায় এবং অন্যান্য সদস্য ও স্থানীয় সনাতনীদের মতামতকে গুরুত্ব না দেওয়ায় ২০১৭ সালের রাঙামাটি পূজা উদযাপন পরিষদ নামে রাঙামাটিতে আরেকটি সংগঠন সৃষ্টি হয়। যার নেতৃত্বে ছিল শিক্ষক বাদল চন্দ্র দে ও স্বপন মহাজান। ২০১৮ সালের ১১মে জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ সম্মেলন আয়োজনের উদ্যোগ নিলেও পরবর্তীতে সেই সম্মেলন আর অনুষ্ঠিত হয়নি। এরপর রাঙামাটি সনাতনী সমাজ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যার ফলে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে জন্মাষ্টমীতে রাঙামাটিতে প্রথমবারের মতো দুইটি র্যালি অনুষ্ঠিত হয়। এদিকে বারবার কেন্দ্রের কাছে ধর্না দেওয়ার পরও সম্মেলনের বিষয়ে কেন্দ্র থেকে কোনও সিদ্ধান্ত না দেওয়ার কারণে সনাতনীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। ২০২২ সালের মার্চে রাঙামাটিতে সনাতন যুব পরিষদের সম্মেলনে কেন্দ্রীয় পূজা উদযাপন পরিষদের সহ সাধারণ সম্পাদক ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক দায়িত্বে থাকা শ্যামল পালিত সনাতনীদের ক্ষোভের বিষয়টি উপলব্ধি করে শীঘ্রই সম্মেলন আয়োজনের ঘোষণা দেন। এজন্য জেলা পূজা উদযাপন পরিষদকে দুইপক্ষকে নিয়ে একটি সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেন। নির্দেশনার প্রেক্ষিতে স্বপন মল্লিককে আহ্বায়ক ও কুশল চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করে একটি সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করে জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ। কিন্তু এতে অনীহা প্রকাশ করে রাঙামাটি জেলা পূজা উদযাপনের নেতৃবৃন্দ। তাদের অভিযোগ, দুই সংগঠন থেকে সদস্য নিয়ে উভয় পক্ষের আস্থাশীল ব্যক্তিদের দিয়ে একটি সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠনের কথা থাকলেও সেটা মানা হয়নি। পরবর্তীতে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক স্বপন মল্লিক পদত্যাগের পর বিষয়টি আরো জলঘোলা হলে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে স্থানীয় সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদারের আন্তরিকতায় কেন্দ্রীয় কমিটির উপস্থিতিতে একটি সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠনের কথা থাকলেও কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক শ্যামল পালিত সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি না দিয়ে অমলেন্দু হাওলাদার ও রণতোষ মল্লিকের নেতৃত্বে সমন্বয় কমিটি নামে একটি অস্থায়ী কমিটি গঠন করে, যে কমিটিকে প্রাথমিকভাবে দুর্গাপূজা সুষ্ঠুভাবে উদযাপনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এসময় বাকি দুই কমিটির কার্যক্রম পকেটে রাখার ঘোষণা দেন শ্যামল পালিত। পরবর্তীতে দুর্গাপূজা উদযাপনের পর গত মাসে সমন্বয় কমিটি থেকে একটি সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়। এতে আহ্বায়ক অমলেন্দু হাওলাদার ও রণতোষ মল্লিককে সদস্য সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই কমিটি এক মাসের মধ্যে সম্মেলন আয়োজন করে। কিন্তু অমর কুমার দে এর এক রিটে আবারো আটকা পড়েছে কাঙ্খিত সেই সম্মেলন।
কেন রিট করেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি অমর কুমার দে বলেন, গঠনতন্ত্র অনুসরণ না করে সম্মেলন আয়োজন করায় কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েক নেতার পরামর্শে নিরুপায় হয়ে আমি আইনের আশ্রয় নিয়েছি। আমরা দীর্ঘদিন ধরে সম্মেলন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সর্বশেষ গত বছরের ২৫ মার্চ একটি সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটিও গঠন করেছিলাম, কিন্তু শ্যামল পালিতের কারণে সেই সম্মেলন আর করতে পারেনি। তাঁর সাথে আমরা একাধিকবার দেখা করেছি, কিন্তু তিনি আমাদের সহযোগিতা করেননি। অমর কুমার দে আরো বলেন, গত ১৬ এপ্রিল কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে গিয়েছি, তাদেরকে সব জানিয়েছি আমরা। এদিকে আমরা জানতে পেরেছি অদৃশ্য শক্তির ইশারায় কমিটি গঠন করা হবে। আমরা চাই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কমিটি গঠন হোক, এসব অপতৎপরতা বন্ধের জন্য বাধ্য হয়ে আইনের আশ্রয় নিয়েছি। ২৮ এপ্রিলের সম্মেলন নিয়েও কেউ আমার সাথে কথা বলেনি। ১১ বছরেও সম্মেলন আয়োজন করতে না পারা সেটা গঠনতন্ত্র বিরোধী নয় কি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, না, এটা গঠনতন্ত্র বিরোধী নয়। কারণ বেশিরভাগ কমিটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হয় না। আর সম্মেলন না হওয়ার জন্য কেন্দ্রই দায়ি বলে তিনি জানান।
সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব রণতোষ মল্লিক বলেন, রিটের বিষয়টি আমরা জেনেছি, তবে এখনো কাগজ পাইনি। তারপরও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আমরা। কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ সকলেই রাঙামাটি এসেছেন সম্মেলনের জন্য। তাদের সাথে বৈঠকের পর আইনগত বিষয় আইনিভাবে মোকাবেলার কথা বলা হয়েছে। আইনি নিষ্পত্তির পর পরবর্তীতে কেন্দ্র যে নির্দেশনা দিবে, সেটাই পালন করবো আমরা।
অমর কুমার দে’র অভিযোগের বিষয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক শ্যামল পালিত বলেন, সংগঠন বলতে কোনও একজন ব্যক্তিকে বুঝায় না। সাংগঠনিক বিষয়ে সাংগঠনিক নিয়মকানুনের মধ্যে থেকে কাজ করার চেষ্টা করেছি। কারো কোনও অভিযোগের বিষয়ে এই সময় কোনও কথা বলতে চাই না। যা বলার আমার সাধারণ সম্পাদকই বলবে।
কেন্দ্রীয় পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দারের কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইনি বিষয় আমরা আইনগতভাবে মোকাবেলা করবো। এটা তেমন কোনও বিষয় না। আদালত গঠনতন্ত্র পর্যালোচনা করলে আশা করছি মামলা টিকবে না। কেন্দ্রীয় কমিটির পরামর্শে অমর কুমার দে’র রিটের বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, এগুলো ভুল, বিভ্রান্তিকর তথ্য। মিসগাইড করার জন্য তিনি অযৌক্তিক এসব কথাবার্তা বলছেন। কেন্দ্রের কেউ এই ধরনের পরামর্শ দেয়নি। মামলা নিষ্পত্তির পর সম্মেলনের বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হবে তিনি জানান।