সুহৃদ সুপান্থ
চাঁদাবাজি ও দলীয় শৃংখলাভঙ্গের অভিযোগে মঙ্গলবার বিএনপি ও সহযোগি সংগঠনের চার নেতাকে বহিষ্কার করেছে রাঙামাটি জেলা বিএনপি। কিন্তু ঠিক কি কারণে বহিষ্কার হলেন তারা,তা নিয়ে চলছে নানা জল্পনা কল্পনা। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ঘটনার পেছনের ঘটনা।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরীর ভাই অংক্যজ চৌধুরীর বাসায় ডিবি পরিচয়ে হানা দিয়ে ৭ লাখ ৮৪ হাজার টাকা ও ৪ টি মোবাইল ছিনিয়ে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। যদিও অভিযুক্তরা বলছেন ভিন্ন কথা।
কি হয়েছিলো সেদিন ?
ঘটনার দিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত একাধিক সূত্র পাহাড়টোয়েন্টিফোর ডট কমকে জানাচ্ছে যে, ২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল এগারোটার দিকে রাঙামাটি শহরের রাঙাপানির সুখী নীলগঞ্জ এলাকায় রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী অবস্থান করছেন, এমন তথ্যের ভিত্তিতে সেখানে যায় জেলা তাঁতী দলের সাবেক সভাপতি ও জেলা বিএনপির বর্তমান কমিটির সদস্য আনোয়ারুল আজিম আজম। প্রথমে তারা অংসুই প্রু চৌধুরীর ভাই ও বেতবুনিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অংক্যজ চৌধুরীর বাসায় গিয়ে নিজেদের ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে পরিবারের সদস্যদের কাছে চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী কোথায় আছে জানতে চায় এবং বাসায় পুলিশের মতো তল্লাশী শুরু করে। এক পর্যায়ে বাসার লোকজন তাদের চেয়ারম্যান অংসু প্রু চৌধুরী বাসা দেখিয়ে দেয়। সেখানে যাওয়ার সময় তারা চেয়ারম্যানের ভাইয়ের কাছ থেকে নগদ ৩ লক্ষ টাকা, এবং একই বাসায় থাকা আশ্রয় অঙ্গন এনজিও’র কর্মকর্তা উচিং মং মারমা’র কাছে থাকা তার অফিস কর্মচারীদের বেতনের ৪ লক্ষ ৮৪ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। এরপর তারা চেয়ারম্যানের বাসায় গিয়ে তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং চেয়ারম্যান কোথায় জানতে চায়। তারা নিজেদেরকে ডিবি পুলিশের লোক বলে পরিচয় দেয় বলে অভিযোগ করছেন বাসায় থাকা লোকজন। এক পর্যায়ে চেয়ারম্যানের বউয়ের সাথে বাকবিতন্ডা হয় তাদের। এই সময় তারা চেয়ারম্যানের বউকে তার স্বামীকে ফোন করার জন্য জবরদস্তি করে। কিন্তু তা না করায় তারা ফিরে আসেন। পরে ৪ টি মোবাইলের মধ্যে ৩ টি মোবাইল ফেরত দেয়া হলেও দামি আরেকটি ফোন এখনো ফেরত দেয়া হয়নি এবং টাকাও ফেরত দেয়া হচ্ছেনা বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগিরা।
বিষয়টি জানাজানি হলে রাঙামাটি জেলা বিএনপি চাঁদাবাজিসহ সামাজিক নানা অপকর্মের অভিযোগ এনে বিএনপি ও তিন সহযোগি সংগঠনের চার নেতাকে বহিষ্কার করেছে । একইসাথে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহের তদন্তে একটি কমিটিও করেছে দলটি। মঙ্গলবার গনমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানিয়েছে দলটি।
বহিষ্কৃতরা হলেন, জেলা বিএনপির সদস্য আনোয়ারুল আজিম আজম, পৌর তাঁতী দলের সভাপতি আলী আজগর বাদশা,পৌর স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য অনতোষ দাশ ও জেলা কৃষকদলের ক্ষুদ্র ও সমবায় সম্পাদক সুমন চাকমা।
জেলা বিএনপির সভাপতি দীপন তালুকদার দীপু এবং সাধারন স্পাদক এ্যাডভোকেট মামুনুর রশীদ সাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে তাদের দলে ও দলের পথ থেকে সাময়িক বহিষ্কারের বিষয়টি জানানো হয়েছে।
বহিষ্কারাদেশে বলা হয়, অভিযুক্তরা দলীয় পরিচয় ব্যবহার করে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি,হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন,দলের মধ্যে বিশৃংখলা সৃষ্টি, দলের নীতি ও আদর্শ পরিপন্থী কর্মকান্ড জড়িত থাকায় প্রাথমিক সদস্যপদ সহ সকল প্রকার পদপদবী থেকে অব্যাহতি প্রদান করে বহিষ্কার করা হলো। বহিষ্কারাদেশে স্পষ্টভাবে সুখী নীলগঞ্জের ঘটনার বিষয়ে সুস্পষ্ট উল্লেখও করা হয়।
বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে,ঘটনার পরপরই বেতবুনিয়ার চেয়ারম্যান অংক্যজ চৌধুরী ও উন্নয়কর্মী উচিং মং রাঙামাটি জেলা বিএনপির নেতাদের কাছে প্রমাণসহ অভিযোগ করেছেন। যার প্রেক্ষিতে নিজেদের জনসভার ব্যস্ততা শেষ করেই দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি।
যা বলছেন অভিযুক্ত ও বহিষ্কৃত আজম
তবে অভিযুক্তদের প্রধান আনোয়ারুল আজিম আজম অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমরা মোটেও ডিবি পরিচয়ে সেখানে যাই নাই। তিনি বলেন, আমরা গোপনসূত্রে খবর পেয়েছিলাম যে, জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী সুখী নীলগঞ্জ এলাকায় নিজের ভাড়া বাড়িতে পলাতক আছেন। সেটা জেনে আমরা সেখানে গেছি,যেনো তাকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে পারি। যাওয়ার সময় আমি বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শাকিল ভাইকেও বলে গেছি। সেখানে আমরা গিয়ে প্রথমে চেয়ারম্যানের ভাইয়ের বাসা ও পরে চেয়ারম্যানের বাসায় গিয়েছি সত্য,কিন্তু মোবাইল বা টাকা নেয়ার অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। চেয়ারম্যানের ভাই বেতবুনিয়ার চেয়ারম্যান পেছন দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় মোবাইল ফেলে গেছে,সেটা আমরা তখনই তাদের পরিবারকে দিয়েছি এবং টাকার গল্পটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। জেলা বিএনপি ভুল বুঝে আমাদের বেহুদাই বহিষ্কার করেছে,সঠিক তদন্ত হলে সব বেরিয়ে আসবে। আজম উল্টো অভিযোগ করেন, চেয়ারম্যানের বউ আমাদের কাছে বলেছেন,তারা জেলা বিএনপিকে ম্যানেজ করেই সেখানে আছেন।
আজম বলছেন, আমরা ছয়জন ছিলাম। সাইফুল নামের একজন রংমিস্ত্রির কাছে আমরা তথ্য পেয়েছিলাম চেয়ারম্যান অংসুই প্রু সেখানে পালিয়ে আছে। সেই খবরের ভিত্তিতে আমরা নিশ্চিত হতে পৌর তাঁতী দলের সভাপতি আলী আজগর বাদশা,পৌর স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য অনতোষ দাশ , জেলা কৃষকদলের ক্ষুদ্র ও সমবায় সম্পাদক সুমন চাকমা,শ্রমিক দলের এয়াকুব এবং আরেকজন সুমনের পরিচিত চাকমা ছেলেসহ সেখানে গেছি। আমরা কোন টাকা বা মোবাইল নিই নাই,কারো সাথে খারাপ ব্যবহারও করি নাই। আমাদের কাছে তো কোন অস্ত্র বা কিছুই ছিলোনা। একটি পাহাড়ী এলাকায় প্রবেশ করে কি করে আমরা এমন ঘটনা ঘটাব ? এটা আমার বিরুদ্ধে একটি চক্রান্ত। তবে আজম স্বীকার করেছেন, সকাল ১১ টা থেকে পৌনে বারোটা পর্যন্ত তারা সেখানে ছিলেন। আজম দাবি করেন, যাদের বাসায় ঘটনা তারা মামলা বা বাড়াবাড়ি করতে না চাইলেও অতিউৎসাহি কেউ কেউ ঘটনাটি নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে।
যা বলছেন শাকিল ও মামুন
আজমের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল ইসলাম শাকিল বলেন,সে একটা মিথ্যেবাদি। আমাকে সে বলেছে,তারা খবর পেয়েছে মামলার আসামী সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান একটি বাড়িতে পলাতক আছে। আমি তাদের বলেছি,তোমরা নিশ্চিত হলে পুলিশকে জানাইও। এরপর আর কিছুই জানিনা। পরে শুনতেছি তারা সেখানে অনেকটা ডাকাতিই করেছে। তারা টাকা ও মোবাইল ছিনিয়ে এনেছে,পরে ৪ টি মোবাইলের ৩ টি ফেরতও দিয়েছে। কিন্তু টাকার বিষয়টি স্বীকার করছেনা। আমরা তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক পদক্ষেপ নিয়েছি। তদন্তে দোষি প্রমাণিত হলে আরো কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
শাকিল বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীদের কাজ পুলিশিং করা নয়। তারা কোন তথ্য পেলে পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে পারে,কিন্তু এইরকম কাজ করলেও কাউকেই ছাড় দেবেনা বিএনপি।
রাঙামাটি জেলা বিএনপির সাধারন সম্পাদক এ্যাডভোকেট মামুনুর রশীদ জানিয়েছেন, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা সাংগঠনিক পদক্ষেপ নিয়েছি, তাদের পদপদবী ও দলের প্রাথমিক সদস্য পদ থেকেও সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। একটি তদন্ত কমিটিও আমরা করেছি। তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্তে একটি তদন্ত ও যাচাই বাছাই বাছাই কমিটি করা হয়েছে। জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক এসএম শফিউল আজ কে আহ্বায়ক করে,যুগ্ম সাধারন সম্পাদক মাহবুবুল আলম মিন্টু ও মোঃ নুরুজ্জামানকে সদস্য করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে দ্রুত জেলা বিএনপি বরাবরে রিপোর্ট দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
শাকিল এবং মামুন স্পষ্টভাবেই বিএনপির নেতাকর্মীদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, এই ধরণের যেকোন ঘটনায় কাউকেই ছাড় দিবেনা দল।