প্রকল্পের টাকায় এনজিও’র কোটি টাকার জমি ক্রয়!
নজিরবিহীন অনিয়ম,দুর্নীতি এবং লুটপাটের কারণে ভেস্তে যেতে বসেছে পার্বত্য জেলা রাঙামাটির জন্য বরাদ্দ পাওয়া সবচে বড় জলবায়ু তহবিলটি। পরিবেশ ও বন মন্ত্রনালয়ের জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন দারিদ্র দূরীকরণ ও জীবনযাত্রার নিরাপত্তা বিধান প্রকল্প নিয়ে বিস্তর সমালোচনা নিয়ে বিপাকে পড়েছে খোদ প্রকল্প বাস্তবায়নকারি প্রতিষ্ঠান রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ। প্রায় ৬ কোটি ৫৩ লক্ষ টাকার এই প্রকল্পের প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা ইতোমধ্যেই খরচ হয়ে গেছে। অথচ প্রকল্পের ধারনাপত্র এর কার্যক্রমের মধ্যে গোজামিল প্রতি পদে পদেই। অভিযোগ উঠেছে প্রকল্প বাস্তবায়নের সাথে জড়িত পর্বত মানব উন্নয়ন সংস্থা ( পাড়া)’ই মূলত এই অনিয়ম ও লুটপাটের সাথে জড়িত। আর জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের নীরব সম্মতিতেই চলেছে এই অনিয়ম।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১২ সনের জানুয়ারীতে শুরু হয়ে ২০১৩ সনের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা প্রকল্পটির। প্রকল্পের মুল উদ্দ্যেশ্য কাপ্তাই হ্রদের কচুরিপানাকে বিকল্প ব্যবহার করে জৈবসার তৈরি, রাঙামাটি শহরের বর্জ্য ব্যবহার করে জৈবসারে রূপান্তর করে পর্যটন নগরী রাঙামাটিকে পরিবেশ বান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা, বনায়ন ও মিশ্র ফলজ বাগানের মাধ্যমে পাহাড়ি পরিবেশ উন্নয়ন ও সংরক্ষন, কাপ্তাই হ্রদে মাছের অভয়াশ্রম সংরক্ষন ও পাহাড়ে বন্যপ্রানীর অবাধ বিচরনের অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি এবং বন ও তার আশে পাশে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার উন্নয়ন ও বায়োগ্যাস উৎপাদনের মাধ্যমে বিকল্প জ্বালানি ব্যবস্থা করা।
এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য জেলা পরিষদ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে এনজিও বাছাই করার কথা থাকলেও জানা গেছে,বিশেষ বিবেচনায় এই বাছাই প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই কাজ দেয়া হয় জলবায়ু ইস্যুতে কখনই কোন কাজের অভিজ্ঞতা না থাকা জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত স্থানীয় এনজিও ‘পাড়া’কে। আর ‘পাড়া’ নিজের কাজের সুবিধার্থে চট্টগ্রামের এনজিও সুখী বাংলা ফাউন্ডেশন এবং চাকমা সার্কেল চীফ দেবাশীষ রায়ের টংগ্যা নামক এনজিওকে কাজের সাথে সম্পৃক্ত করে। এই বিষয়ে টংগ্যার সাধারন সম্পাদক এডভোকেট সুস্মিতা চাকমা বলেন,পাড়া কেনো আমাদের নাম ব্যবহার করেছে আমরা জানিনা,আমি তাদের সাথে জলবায়ু তহবিলের কোন কাজই করিনি। পাড়া এনজিওটি আমাদের ভিসিএফ এলাকায় চারা লাগাতে চাইলে আমরা তাদের সাথে কাজ করব না সাফ জানিয়ে দেই এবং কোন কাজও করেনি।
জলবায়ু পরিবর্তন তহবিলের এই প্রকল্পে প্রথম কিস্তিতে ৩ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা ছাড় করা হয়। এই টাকার মধ্যে ১ কোটি ২৩ লক্ষ টাকা বরাদ্দ রাখা হয় জেলায় ৫ লক্ষ গাছের চারা রোপন তথা বনায়নে,বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপনে বরাদ্দ করা হয় ১ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা এবং কাপ্তাই হ্রদে ভাসমান মিশ্র সব্জি বাগান স্থাপনে বরাদ্দ করা হয় ২০ লক্ষ টাকা। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গেছে,পরিবেশ রক্ষার এই প্রকল্পের অধীনে জেলা শহরের কিছু স্থানে এবং কাপ্তাই কর্ণফুলি কাগজ কল এলাকায় পরিবেশবিরোধী হিসেবে পরিচিত ইউক্যালিপটাস,আকাশমনিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছে চারা লাগানো হয়েছে। কিন্তু প্রকল্পের যে পরিমাণ গাছে চারার কথা বলা হয়েছে তার সাথে ন্যুনতম সামজ্ঞস্য নেই লাগানো চারার।
জেলার দশটি উপজেলায় পাড়া সরকারী ও ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ১২শ ৫২ একর জমিতে ৫ লাখ ৪৩ হাজার বিভিন্ন প্রজাতির ফলজ, বনজ ও ঔষুধী চারা গাছ লাগানোর দাবী করলেও বাস্তবে তার কোন হদিস মেলেনি। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, কেবল কর্ণফুলী পেপার মিল এলাকায় কয়েকশ গাছ লাগানো হয়েছে। রাঙামাটি শহরের যে সব সরকারী প্রতিষ্ঠানে বনায়ন করা হয়েছে দাবী করা হয়েছে সে সব বনায়ন এলাকা ঘুরে দেখে গেছে কোন কোন জায়গায় চারার চিহ্নও নেই, আবার অনেক জায়গা জঙ্গলে পরিপুর্ন হয়ে আছে। আবার সামান্য কয়েকটি পরিবারকে নিজেদের জমিতে বনায়নের জন্য চারা দেয়া হলেও তাদের লাগানোর খরচ বাবদ অর্থ দেয়া হয়নি। সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, রাঙামাটি শহরের পর্যটন, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল এলাকায় চারা রোপন করা হলেও সেগুলো এখন আর নেই। চারা রোপন করেই এনজিওটি দায়িত্ব শেষ করেছে, চারা পরিচর্যা বা অন্য কোন আনুষঙ্গিক কাজও করেনি ।
এনজিওটির পক্ষ থেকে রাঙামাটি পর্যটন কমপ্লেক্সের ৩ একর জায়গায় চার হাজার দুইশত চারা লাগানোর দাবি করা হলেও খোদ পর্যটন ম্যানেজার আখলাকুর রহমান জানিয়েছেন, সেখানে দেড় একর জায়গায় সর্বোচ্চ হাজারখানেক গাছের চারা লাগানো হয়েছে মাত্র।
কর্নফুলী পেপার মিলের ফরেষ্ট কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ জানিয়েছেন, তারা ২শ একর জমিতে বনায়নের প্রস্তাব দিলেও অর্ধশত একর জায়গাতে নিজেদের ইচ্ছামত চারা লাগিয়েছে এনজিওগুলো। লাগানোর সময় কেপিএমের সাথে কোন ধরনের আলোচনাও করেনি। অথচ এনজিওগুলো কিন্তু কাগজ কলমে ১৩২ একর জমিতে বনায়নের কথা দাবী করা হয়েছে। কাজ শেষে কেপিএম থেকে কোন ছাড়পত্রও তারা নেয়নি বলে অভিযোগ করেন তিনি।
সবচে গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে,ব্যক্তি পর্যায়ে বনায়ন কার্যক্রমে। বিভিন্ন ব্যক্তির নিজেদের বাগানে শুধুমাত্র অর্থের বিনিময়ে সাইনবোর্ড লাগানোরও কথাও স্বীকার করেছেন বিভিন্ন বাগান মালিকরা। কাউখালীর বাসিন্দা ধীমান খীসা জানান, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখার পর তিনি আবেদন করেন। আবেদনের পর তাকে বাগান করার জন্য প্রথমে ৫ হাজার পরে আরো ৫ হাজার টাকা দিয়ে এবছর নতুনভাবে চারা সার দেয়ার কথা থাকলেও আজ অবধি তা দেয়নি। তার কাছ থেকে সাদা কাগজে দস্তখত নেয়া হয় বলেও জানান তিনি।
প্রকল্পের অধীন বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন কার্যক্রমে দশটি উপজেলায় একশটি বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন দেখানো হয়েছে। শহরে কয়েকটি পরিবারকে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন করে দেয়া হলেও বাকীগুলেরা কোন হদিস নেই। সবচে অবাক কান্ড ব্যক্তিগতভাবে অনেক আগে থেকেই বায়োগ্যাস ব্যবহার করছেন,এমন অনেক অনেক মানুষকে প্রকল্পের সুবিধাভোগী হিসেবে দেখানোরও ঘোরতর অভিযোগ পাওয়া গেছে পাড়া এনজিওটির বিরুদ্ধে। কাপ্তাই উপজেলার হেডম্যান পাড়ার বাসিন্দা অরুন তালুকদার অভিযোগ করেছেন,তারা ২০০৭ সালে গ্রামীন শক্তি থেকে ঋন নিয়ে নিজ বাড়ীতে বায়োগ্যাস ব্যবহার করে আসছেন,কিন্তু সম্প্রীতি সংবাদকর্মীদের কাছ থেকে তারা জেনেছেন পাড়া নামের একটি এনজিওর সুবিধাভোগীর তালিকায় তাদেরও নাম আছে। তিনি দৃঢ়তার সাথে এই দাবি অস্বীকার করে বলেন, উন্নয়নের নামে এই ধরণের প্রতারণা দুঃখজনক। ‘পাড়া’ নামের কোন এনজিওকেও তিনি চেনেননা বলে জানান । একই অভিযোগ করেন একই পাড়ার অজিত তালুতদারও।
জলবায়ু তহবিলের এই প্রকল্পের টাকায় ধারনাপত্রের বাইরে জেলা পরিষদের নিজস্ব আগ্রহে রাঙামাটি শহরে স্থাপন করা হয় তিন স্তর বিশিষ্ট তিনরঙা ডাস্টবিন,যা ত্রিবিন হিসেবে পরিচিত। উন্নত বিশ্বের এই ধরণের বিনের ব্যবহার দেখা গেলোও এইসব স্থাপনা কেনো রাঙামাটি শহরে স্থাপন করা হয়েছে না নিয়েও রয়েছে নানান আলোচনা। অর্ধসমাপ্ত এই ত্রিবিনগুলো ব্যবহার অনুপযোগি এবং ইতোমধ্যেই বেশ কিছু ত্রিবিন অযতেœ নষ্ট হয়ে গেছে। থ্রিবিনের দরজা এত ছোট আকৃতির যে ময়লা ফেললে উল্টো নিজের গায়েই এসে পড়ে,ফলে জনগণ এইসব ব্যবহারেও আগ্রহী নয়। আর ত্রিবিন নির্মাণের ব্যয় এবং স্থাপনা নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। প্রকল্পের এই ত্রিবিন কার্যক্রমের সাথে রাঙামাটি পৌরসভাকে সম্পৃক্ত দেখানো হলেও রাঙামাটি পৌরসভার মেয়র সাইফুল ইসলাম ভূট্টো জানিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ফান্ডের সাথে আমাদের কোন সর্ম্পক নেই। এর কাজ কি, কত টাকা বরাদ্দ কিছু জানি না। আমাদের সাথে একটা পোগ্রাম করে জেলা পরিষদ তাদের দুর্নীতি জায়েজ করতে চায়,কিন্তু আমরা তাদের সেই সুযোগ দেবোনা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে,প্রকল্পের সাথে জড়িত এনজিও পাড়া’র নির্বাহী পরিচালক আব্বাস উদ্দিন চৌধুরী প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করে ইতোমধ্যেই রাঙামাটি শহরের কাঠালতলিকে প্রায় এক কোটি টাকা (৯০ লক্ষ টাকা) দিয়ে একটি বাণিজ্যিক প্লট ক্রয় করেছেন। আর প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করা নিয়ে সংস্থাটির নির্বাহী কমিটির সদস্যদের মধ্যেও তৈরি হয়েছে বিরোধ। নির্বাহী কমিটির একাধিক সদস্য জানিয়েছেন,এই প্রকল্পের অনিয়মের কারণে এনজিওনটি নিবন্ধন বাতিল হলে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে নিজ স্ত্রীর নামে আরেকটি এনজিও নিবন্ধন নিয়ে রেখেছেন আব্বাসউদ্দিন চৌধুরী। এই বিষয়ে আব্বাসউদ্দিনের সাথে কথা বলার জন্য বারবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাংবাদিকদের সাথে এই বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
তবে প্রকল্পের পার্টনার এনজিও সুখী বাংলা ফাউন্ডেশনটি এর নির্বাহী পরিচালক মোঃ সালাউদ্দিন বলেন, এই প্রকল্পের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নাই,আমরা শুধুমাত্র বনায়ন কার্যক্রমে সহযোগি হিসেবে কাজ করেছি। পাড়া’র কোন অনিয়ম বা দুর্নীতির দায় আমরা নেবোনা। কারণ পুরো প্রকল্পের সাথে আমাদের কোন সম্পর্কই নাই।
তবে প্রকল্পটি বর্তমান পরিচালক ও রাঙামাটি জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইরফান শরীফ বলেন, আমি দায়িত্ব নিয়েছি কয়েকমাস আগে,এর আগে কি হয়েছে আমি তা জানিনা। তিনি বলেন, আপনাদের কাছে কোন তথ্য থাকলে আমাকে জানান আমি ব্যবস্থা নিব। আমি দায়িত্ব নেবার পর বাস্তবায়নকারী সংস্থা পুরো টাকা চাইলেও আমি দুইবারে ৩০ লাখ টাকা ছাড় করেছি। কাপ্তাই রাঙামাটি সড়ক এবং চট্রগ্রাম কাপ্তাই সড়কের রাস্তার দুপাশে গাছ লাগানো হয়েছে দাবি করে তিনি জানান, প্রকল্প অনুযায়ী ৫ লাখ চারা সংগ্রহের জন্য এনজিওটিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।