শংকর হোড়
রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়ক যেন দুর্ঘটনার সড়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত সাড়ে তিন মাসে রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের রাঙামাটি অংশে ছোট-বড় অন্তত সাত থেকে আটটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে কমপক্ষে পাঁচজন নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে অন্তত ২০জন। যাদের অনেকেই এখনো মৃত্যুযন্ত্রণা নিয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক মোড়, পাহাড়ি খাদের কিনারায় রেলিং না থাকা এবং সড়ক প্রশস্ত না হওয়ার কারণে এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে বলে মত স্থানীয়দের। পাশাপাশি অদক্ষ অটোরিক্সা চালকদের দৌরাত্ম এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ির কারণে এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয়রা জানান, গত বছরের ৪ নভেম্বর শহর মুখে ভেদভেদীতে দাঁড়িয়ে থাকা একটি সিএনজি অটোরিক্সাকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয় একটি বাস। ভেদভেদী বাজারের মুখে সড়কের পাশে সংস্কার কাজের ঢালাই মেরামত করার কাজ চলায় সামনে এগোতে না পেরে দাঁড়িয়ে ছিল সিনএনজিচালিত অটোরিকশাটি। এসময় চট্টগ্রাম থেকে আসা রাঙামাটি-চট্টগ্রাম যাত্রী পরিবহনকারী ‘খাজা গরীবে নেওয়াজ’ নামের একটি বাস সজোরে আঘাত করে অটোরিকশাটিকে। এতে মূহূর্তেই তছনছ হয়ে যায় অটোরিকশাটি। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান দুজন। ঘটনায় আহত হন চারজন। অভিযোগ রয়েছে, বাসটির ফিটনেস নেই এবং নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বেপরোয়া গতিতে এসে অটোরিক্সাকে ধাক্কা দেয়ার কারণে ঘটনাস্থলেই দুইজনের মৃত্যু ঘটে। গত ৭ ফেব্রæয়ারি একই দিনে রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কে পৃথক দুইটি ঘটনায় নয়জন আহত হয়। এদিন জেলা শহরের রেডিও স্টেশন এলাকায় কাঠ বহনকারী একটি ট্রাক রাঙামাটি ছেড়ে যাওয়ার সময় বিপরীত থেকে আসা একটি কাভার্ডভ্যানের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। এতে ঘটনাস্থলে উভয় বাহনের চালকসহ চারজন আহত হন। একইদিন রাঙামাটি শহর থেকে শিক্ষার্থীদের বহন করা সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশা কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া সড়কে এলে বিপরীত দিক থেকে আসা আরেকটি অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলে পাঁচ শিক্ষার্থী আহত হন। স্থানীয়রা আহতদের উদ্ধার করে রাঙামাটি সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। এরমধ্যে কাউখালী কলেজের পাঁচ শিক্ষার্থীও রয়েছে। এরপর বৃহস্পতিবার রাঙামাটি থেকে চট্টগ্রামগামী একটি সিএনজি অটোরিক্সা কাউখালী উপজেলার সাপছড়ি এলাকায় পৌঁছুলে পিছন থেকে আসা একটি লরি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা দেয়। এতে সিএনজি ও লরিটি রাস্তার পাশে ৩০-৪০ ফুট পাহাড়ের খাদে পড়ে যায়। ঘটনাস্থলেই দুইজন মারা গেছে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর একজন মারা যায়। এছাড়া আরো কয়েকটি ছোট ছোট ঘটনায় এই সড়কে আরো কয়েকজন আহত হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কে অসংখ্য পাহাড়ি বাঁক রয়েছে। বাঁকগুলো ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপরীতমুখী গাড়ি না দেখার কারণে অনেক সময় গাড়ি মুখোমুখি সংঘর্ষ হচ্ছে। এছাড়া নানান নির্মাণ সামগ্রী বহনের জন্য চট্টগ্রাম থেকে রাঙামাটিতে কাভার্ডভ্যান, লরির আনাগোনা বেড়েছে, এসব গাড়ির জন্য প্রশস্ত যে সড়ক প্রয়োজন সেটা না থাকাসহ লরি, ক্যাভার্ডভ্যানগুলোর বেপরোয়া গতির কারণেও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। সড়কটির ঝুঁকিপূর্ণ খাদের কিনারায় মজবুত রেলিং না থাকার কারণে গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ে খাদে পড়ে যাচ্ছে। এতে প্রাণহানির ঘটনা বেশি ঘটছে এবং গাড়িরও বেশি ক্ষতি হচ্ছে। পাশাপাশি এই সড়কে নাম্বারবিহীন গাড়ির দৌরাত্ম্য ও অদক্ষ চালকদের বেপরোয়া গতির কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। এছাড়া যাত্রীবাহি বাসগুলো ফিটনেস না থাকায় পাহাড়ি পথে দুর্ঘটনায় পড়ে হতাহতের ঘটনা বাড়ছে।
রাঙামাটি যাত্রী কল্যাণ সমিতির আহŸায়ক জাহাঙ্গীর আলম মুন্না বলেন, রেজিস্ট্রেশনবিহীন অটোরিক্সার দৌরাত্ম্য, চালকদের লাইসেন্স না থাকা, বেপরোয়া গতি এবং সড়ক প্রশস্ত না থাকার কারণে সড়কে দুর্ঘটনা বেড়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ সড়কে ধারক দেয়ালের পাশাপাশি রেলিং নির্মাণ করাও জরুরি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক(সুজন)এর রাঙামাটি জেলার সাধারণ সম্পাদক এম জিসান বখতেয়ার বলেন, ভৌগোলিক কারণে রাঙামাটির সড়কগুলো উঁচু-নিচু ও আঁকাবাঁকা। সড়ক বিভাগ যতটা সম্ভব এসব উঁচু-নিচু ও আঁকাবাঁকা সড়কগুলো সংস্কার করলে দুঘর্টনা অনেকাংশে কমে আসবে। এছাড়া সড়ক প্রশস্ত এবং ঝুঁকিপূর্ণ সড়ক এলাকায় বিশেষ মার্কিং করাও জরুরি। যেহেতু রাউজান পর্যন্ত চার লেইন সড়ক হয়েছে, রাঙামাটি অংশে ঢুকলে সরু সড়ক অনেক সময় বড় বড় গাড়িগুলোর জন্য সমস্যা সৃষ্টি করে আবার তারা পাহাড়ি সড়ক বিষয়ে অনভিজ্ঞ হওয়ায় এই দুর্ঘটনা বাড়ছে। শহরের বাইরে যারা অটোরিক্সা চলাচল করে তাদের গতিও নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি(বিআরটিএ) রাঙামাটি অফিসের মোটরযান পরিদর্শক কে. মো. সালাহ উদ্দিন বলেন, চালকদের লাইসেন্স নবায়নের সময় আমরা তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। এটা আমাদের নিয়মিত কর্মসূচি। তবে চালকদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য জেলা প্রশাসন থেকে উদ্যোগ নিলে আমরা অবশ্যই সহযোগিতা করবো। এছাড়া ফিটনেস ও রেজিস্ট্রেশনবিহীন গাড়ি ও চালকদের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন থেকে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে আর আমরা এক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা করে থাকি। তিনি জানান, সরাসরি আমরা কারো বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারি না, প্রশাসনের ভ্রাম্যমান আদালতের ওপর আমাদের নির্ভর করতে হয়।
রাঙামাটি সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ চাকমা সড়কে দুর্ঘটনার জন্য ওভারলোডিং, বেপরোয়া গতি, ফিটনেসবিহীন গাড়ির দৌরাত্ম্য এবং অভিজ্ঞ চালক না থাকাকে দায়ি করেন। সড়ক প্রশস্তকরণের বিষয়ে তিনি বলেন, সড়ক প্রশস্তকরণের জন্য অর্থাৎ চার লেইন সড়ক নির্মাণের জন্য কনসালটেন্ট নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে তারা সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু করেছে। এরপর তারাই প্রকল্প প্রস্তুত করে দিবে। এছাড়া নিয়মিতভাবে সড়কের যে কাজ করা হয় সেগুলো চলমান রয়েছে। বরাদ্দ সাপেক্ষে খাদের কিনারায় রেলিং বসানো হবে বলে তিনি জানান।
এই বিষয়ে রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ খানের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, চালকদের সচেতনতা বাড়াতে তাদেরকে নিয়ে কর্মশালা করার জন্য আমরা বিআরটিএ’কে নির্দেশনা দিয়েছি। এছাড়া সড়ক প্রশস্ত করার জন্য আমার জানামতে সড়ক বিভাগ কাজ করছে। সকলের সমন্বিত চেষ্টায় ও সচেতনতায় সড়ক দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।