শংকর হোড়
২০০২ সালে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান মানিক লাল দেওয়ানের একান্ত আগ্রহে শহরের সুখী নীলগঞ্জ নামক স্থানে প্রায় ৩০ একর জায়গার ওপর বোটানিক্যাল গার্ডেন ও মিনি চিড়িয়াখানা স্থাপন করা হয়। শুরুতেই দুইটি বাচ্চা ভাল্লুকসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী এনে মিনি চিড়িয়াখানাটি এই অঞ্চলে তাক লাগিয়ে দেয়। জেলার মানুষ এর আগে বিভিন্ন বন্যপ্রাণী স্বচক্ষে দেখার সুযোগ না পেলেও চিড়িয়াখানার সুবাদে এই অঞ্চলের মানুষ বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিশেষ করে ভাল্লুক, মথুরা, বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, পাখি, বানর, বনমোরগ, সজারু, কচ্ছপ, ময়ূরসহ আরো বিভিন্ন প্রাণী দেখার সুযোগ মেলে। কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই ধীরে ধীরে চিড়িয়াখানাটি জৌলুস হারাতে থাকে। অযতেœ, অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার কারণে একের পর এক প্রাণী মৃত্যুবরণ করতে থাকে। চিড়িয়াখানা যাত্রার প্রাক্কালে বাচ্চা একটি ভালুক আনা হয়। যেটি গত ২৩ বছর ধরে এই চিড়িয়াখানায় নিঃসঙ্গ পড়ে আছে। ভেঙ্গে পড়েছে একের পর এক খাঁচার ছাদ। দীর্ঘসময় ধরে জরাজীর্ণ ও অবহেলায় পড়ে থাকার পর অবশেষে চিড়িয়াখানাটির অস্তিত্ব সোমবার শেষ হয়েছে। জেলা পরিষদ বর্তমানে রয়ে যাওয়া ছয় প্রজাতির ১৯টি প্রাণীকে বন বিভাগকে হস্তান্তরের মাধ্যমে প্রাণীগুলোকে বন্দিদশা মুক্ত করেছে।
সোমবার দুপুুরে বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তারা সুখী নীলগঞ্জের মিনি চিড়িয়াখানায় এসে স্থানীয় বনবিভাগের সহায়তায় ১৯টি প্রাণী চিড়িয়াখানা থেকে নিয়ে যায়। ভাল্লুক, হরিণ ও বানরগুলো চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে অচেতন করে তারপর খাচায় ভরে চট্টগ্রামের ডুলাহাজরার সাফারি পার্কের উদ্দেশে নিয়ে যায়। কর্মকর্তারা জানান, প্রথমেই ডুলাহাজরার সাফারি পার্কে বন্যপ্রাণীগুলোকে চিকিৎসা দেয়ার পর ধীরে ধীরে তাদেরকে বনে ছেড়ে দেয়া হবে।
ঢাকা বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা রথীন্দ্র কুমার বিশ^াস বলেন, ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী আইন অনুযায়ী কোনও বন্যপ্রাণী ক্রয়, বিক্রয়, বন্দি রাখা পুরোপুরি আইন পরিপন্থী। যেহেতু এটি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালনা করা হচ্ছে, তাই আমরা আলোচনার মাধ্যমে বন্যপ্রাণীগুলোকে জব্দ করে ডুলাহাজরা সাফারি পার্কে নিয়ে কোয়ারেন্টিনে রাখবো। তিনি আরো বলেন, এখানে এসে যা দেখলাম, এতে বন্যপ্রাণী কল্যাণ আইন অনুযায়ী এটা নিষ্ঠুরতা। বন্যপ্রাণী মুভমেন্টের পর্যাপ্ত জায়গা নেই। খাঁচাগুলোতে যথেষ্ট আলো-বাতাস নেই। এভাবে বন্যপ্রাণী থাকতে পারে না।
চট্টগ্রাম বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা দীপান্বিতা ভট্টচার্য বলেন, জেলা পরিষদ প্রধান বন সংরক্ষকের মাধ্যমে লাইসেন্স নিয়ে এখানে কিছু বন্যপ্রাণী এনেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা জানতে পারলাম, এখানে যেভাবে বন্যপ্রাণী রাখা হয়েছে, সেগুলো বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন পরিপন্থী। এই বিষয়ে জেলা পরিষদের সাথে যোগাযোগের পর তারা বন্যপ্রাণীগুলো হস্তান্তরে সম্মত হওয়ায় আজকে(সোমবার) আমরা বন্যপ্রাণীগুলো নিয়ে যাচ্ছি।
এদিকে দীর্ঘদিন ধরে অযতেœ ও অবহেলায় পড়েছিল বন্যপ্রাণীগুলো। সোমবার সকালে চিড়িয়াখানায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, খাঁচায় বসে আছে নিঃসঙ্গ ভালুক। একা একা পায়চারি করছেন দুই কক্ষবিশিষ্ট একটি ঘরে। গত ২৩ বছর ধরে এই ঘরটিই ছিল তার একমাত্র আবাসস্থল। সাধারণত ভালুকের জীবনকাল ৩০ বছর হয়ে থাকে, আর এরমধ্যে খাচায় এই প্রাণীটির কেটেছে ২৩ বছর। পাশের একটি খাঁচায় শ্রীহীন চারটি বানর। স্বাভাবিক প্রাণচাঞ্চল্য নেই কারও। যা খাবার পায়, তাতে বন্দি প্রাণীগুলোর কোনোমতে টিকে থাকাই দায়। প্রাণীদের দেওয়া খাবার এতটাই অল্প যে খাঁচায় উঁকি দিয়ে কোথাও উচ্ছিষ্ট কিছু দেখা গেল না। একটি কক্ষে হাঁটু পরিমাণ পানিতে ছয়টি কচ্ছপ। পানিগুলো এতটাই নোংরা যে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। কবে যে এই পানি পরিবর্তন করা হয়েছে, তার কোনও হিসাব নেই। চিড়িয়াখানার সবগুলো প্রাণীর ঘর নোংরায় ভরা। একমাত্র হরিণটি এদিক-ওদিক খুড়িয়ে খুড়িয়ে দৌঁড়ঝাপ করছে। একসময় তিনটি হরিণ থাকলেও এখন একটি মাত্র হরিণ। ভেঙে গেছে প্রাণীদের খাঁচাগুলো। স্থানে স্থানে পাকা স্থাপনায় ফাটল দেখা গেছে। খাঁচার গ্রিলে মরিচা ধরেছে। প্রাণী না থাকায় লোকজনের কোনো আগ্রহ নেই চিড়িয়াখানাটি নিয়ে। এর মধ্যে গত জুলাইয়ে চিড়িয়াখানার প্রাণীদের জন্য পানি তোলার পাম্পটিও চুরি হয়ে গেছে। পাহাড়ের ওপর অবস্থিত চিড়িয়াখানাটির প্রাণীদের জন্য এখন টেনে টেনে পানি আনতে হয়। কিন্তু পানি আনার লোকও নেই। ফলে পর্যাপ্ত পানি প্রতিদিন সরবরাহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। সব মিলিয়ে খারাপ অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছিল চিড়িয়াখানার।
বর্তমানে এখানকার সম্বল একটি মাত্র ভালুক, একটি হরিণ, চারটি বানর, দুটি সজারু, পাঁচটি বন মোরগ ও ছয়টি কচ্ছপ। অজগরও ছিল একসময়, সেটির মৃত্যুর পর সেই নোংরা ঘরে স্থান হয়েছে দুইটি বানরের। খেয়ে না খেয়ে প্রাণীগুলো দিন কাটাচ্ছে অনেকটাই নিঃসঙ্গতায়।
কক্সবাজার সাফারি পার্কের ভেটেরিনারি অফিসার ডা. হাতেম সাজ্জাদ মো. জুলকার নাইন বন্যপ্রাণীগুলোর শারীরিক অবস্থা সম্বন্ধে বলেন, ভালুকের অবস্থা ভালো আছে। বানর ও হরিণের স্কিনে সমস্যা আছে। অন্যান্য প্রাণীগুলোও মোটামুটি আছে। আমরা কিছু প্রাণী ট্রাঙ্কুলাইস করেছি এবং বাকীগুলো ফিজিক্যালি রেসকিউ করে ডুলাহাজরায় নিয়ে যাবো। সেখানে তাদেরকে চিকিৎসার পর অবমুক্ত করা হবে।
চিড়িয়াখানায় ঘুরতে আসা দর্শনার্থী মো. সালাম বলেন, জেলার একমাত্র এই মিনি চিড়িয়াখানাটার এই অবস্থার জন্য অবশ্যই কর্তৃপক্ষ দায়ী। তাদের অবহেলা ও অব্যবস্থানার কারণে প্রাণীগুলো মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। একটি ভালুক ২৩ বছর ধরে নিঃসঙ্গ একটি খাঁচায় পড়ে আছে। এগুলো অমানবিক। অন্তত বনবিভাগের কাছে বন্যপ্রাণীগুলো হস্তান্তরের কারণে প্রাণীগুলো বেঁচে যাবে।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কৃষিবিদ কাজল তালুকদার বলেন, চিড়িয়াখানায় দর্শণার্থীর সংখ্যা খুব একটা নেই। এতে এখান থেকে কোনও আয়ও নেই। বন্যপ্রাণীগুলো হস্তান্তরে গত মাসে আমরা ঢাকা বন অধিদপ্তরকে চিঠি দিই। তারা জানিয়েছিল, অতিসত্ত্বর এসে তারা বন্যপ্রাণীগুলো নিয়ে যাবে। বর্তমানে খালি এই স্থানটিকে আমরা পর্যটন স্পট করার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছি।