শ্যামল রুদ্র রামগড়
খাগড়াছড়ির রামগড়ে হিমাগার না থাকায় প্রতি বছর নষ্ট হচ্ছে লাখ টাকার মৌসুমি ফল-ফলারি। আহরণ, সংরক্ষণ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সঠিক বিপণনের অভাবে নষ্ট হয় এই সব ফল-ফলারি। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় স্থানীয় কৃষকেরা। এই অবস্থায় সরকারি কিংবা বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এলাকায় হিমাগার স্থাপনে এগিয়ে আসার আহŸান জানিয়েছেন বাগান মালিকেরা।
বাগান মালিক যুগেশ চন্দ্র ত্রিপুরা, তরুণ ত্রিপুরা ও মো.মোস্তফা জানান, পাহাড়ে হাজার হাজার একর পাহাড়ি টিলা জুড়ে আম, কাঁঠাল, লিচু, আনারস, পেয়ারা, লেবু, কলা, সফেদা, জাম্বুরা ও জামরুল প্রভৃতি ফলের বাগান রয়েছে। এই সব ফল সঠিক পদ্ধতিতে আহরণ করে সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণের মাধ্যমে সারা বছরই ব্যবহার করা সম্ভব। কিন্তু হিমাগার নেই বলে এগুলো নষ্ট হয়।
রামগড় উপজেলা কৃষি কার্যালয়ের উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা সানাউল হক জানান, প্রতি বছর প্রায় তিন হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে ২৩ থেকে ২৫ হাজার মেট্রিক টন মৌসুমি ফল উৎপন্ন হয়। তা ছাড়া সবজি উৎপন্ন হয় এর চেয়ে অনেক বেশি। উপজেলায় কৃষকদের উৎপাদিত তরিতরকারি ও ফলমূলের মধ্যে রয়েছে- আলু, টমেটো, শসা,বরবটি, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, মিষ্টি আলু, আদা, কাঁচামরিচ, হলুদ ও কুমড়া। ফলমূলের মধ্যে রয়েছে কলা- আনারস, লিচু, পেঁপে, কাঁঠাল ও আমসহ বিভিন্ন ধরনের ফল। এসব কাঁচামাল সাধারণত পচনশীল হওয়ায় সংরক্ষণের প্রয়োজন পড়ে।
রামগড় পাহাড়াঞ্চল কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এস এম ফয়সাল বলেন, এই এলাকায় যে পরিমাণ মৌসুমি ফলের উৎপাদান হয় এতে জেম, জেলি, জুস ও বিভিন্ন প্রকার আচারের কারখানা অনায়াসে করা যায়। কাঁঠাল, আনারস, লিচু, আমসহ বিভিন্ন ফল ফলারি প্রক্রিয়াজাত করে সারা বছরই সংরক্ষণ সম্ভব।
অন্যদিকে, স্থানীয় বাজারে রয়েছে প্রকট বিপণন সমস্যা। পাহাড়ের ঢালে, উঁচু টিলায় অবস্থিত বাগানের ফলফলারি ত্রুটিপূর্ণ যাতায়াত ও পরিবহন ব্যবস্থার কারণে কৃষক সঠিক মূল্য পায় না।
এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল। দ্রুত বাজারজাত করা যায় না। ফলে বাগানে কিংবা মাঝ পথে পচে নষ্ট হয়। কাঁধে, সাইকেল ও রিকশায় এবং ভ্যান গাড়ি ও খোলা জিপে (চাঁদের গাড়ি) বাজারে এনে স্তূপাকারে রাখা হয়। দুর্গম এলাকার চাষীরা কষ্ট করে বাজারে এনে ফসলের ন্যায্যমূল্য পায় না।
রয়েছে চাঁদাবাজদের উৎপাত। পড়তে হয় দালাল ও ফরিয়াদের খপ্পরে। দালালদের মর্জিতে উঠানামা করে দাম। একজোট হয়ে দাম হাঁকে। তখন বাজারমূল্য অনেক কমে যায়। উপরন্তু রয়েছে নামে-বেনামে বিভিন্ন সংস্থার স্থানীয় কর। কেবল মাত্র হিমাগার না থাকায় এই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বলেও অভিযোগ কৃষকদের।
স্থানীয় বাসিন্দা অধ্যক্ষ ফারুকুর রহমান বলেন, নিরূপায় কৃষক অনেক সময় রাগ করে ফলফলারি বাজারেই ফেলে যান। এরকম দুঃখজনক ঘটনা হরহামেশাই দুর্গম পাহাড়ি বাজারগুলোয় দেখা যায়। উপজেলা বিপণন কর্মকর্তা মো. ফরহাদ হোসেন বিষয়গুলো নিয়ে ভাবেন। তাঁর ভাষ্যমতে, হিমাগার থাকলে ভালো হতো। ফলফলারি কম নষ্ট হতো। সম্ভাব্যতা যাচাই পূর্বক সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি লিখে বিষয়টি তুলে ধরবেন বলে উলেখ করেন মো.ফরহাদ হোসেন।
রামগড় বাজার সেক্রেটারি দেবব্রত শর্মা বলেন, মাঝে মধ্যে বাজার অনুসন্ধান কার্যক্রম চালিয়ে ত্রুটিবিচ্যুতি দূর করার চেষ্টা করেন। নানা অনিয়ম-দুর্নীতি বিষয়েও ওয়াকবিহাল তাঁরা।
খাগড়াছড়ি ফল বাগান মালিক সমিতির উপদেষ্টা অনিমেষ চাকমা রিংকু বলেন, এ সমস্যা দীর্ঘদিনের। প্রশাসসিক উদ্যোগ এ ক্ষেত্রে জরুরি। অন্যদিকে, পাহাড়ের কোথাও হিমাগার নেই। এটিও বড় সমস্যা। অবিক্রিত পণ্য সংরক্ষণও করা যায় না। প্রতি বছর পঁচে গলে নষ্ট হয় বিরাট একটা অংশ। ক্ষতিগ্রস্ত হন স্থানীয় কৃষক। আর্থিক ক্ষতির কারণে ফসল উৎপাদনে উৎসাহ পায় না।
এ প্রসঙ্গে রামগড় পৌরসভার মেয়র রফিকুল আলম কামাল বলেন, পাহাড়ে মৌসুমি ফল-ফলারি ও সবজির প্রচুর ফলন হয়। কিন্তু অনেক সময় অবিক্রিত পণ্য পচেগলে নষ্ট হয়। হিমাগার থাকলে এমনটা হতো না। সরকারিভাবে হিমাগার স্থাপনের চেষ্টা করবেন, ব্যক্তি উদ্যোগে কেউ হিমাগার স্থাপনে এগিয়ে আসলে সর্বাত্মক সহায়তা করবেন বলে জানান।
রামগড় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বিশ্ব প্রদীপ কুমার কারবারি বলেন, বর্তমান সরকার কৃষকদের স্বার্থে কাজ করছে। হিমাগার স্থাপনে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দরকার। এটা নিশ্চিত করা গেলে কাঁচা পণ্য সংরক্ষণ করা সম্ভব। তিনি এ লক্ষ্যে কাজ করছেন।