পার্বত্য রাঙামাটির রাজস্থলী উপজেলার বিলাইছড়ি ইউনিয়নের নতুন পাড়ার বাসিন্দা অম্বামণি ত্রিপুরা। দুর্গম এলাকায় পড়াশোনার সুবিধা না থাকায় নিজের চার সন্তানকে পড়াচ্ছেন আবাসিক স্কুলে রেখে। এরই মধ্যে তিন ছেলে-মেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে থেকে পড়াশোনা করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশোনা করছে। ছোট মেয়ে সুস্মিতা ত্রিপুরাকে নিয়ে এসেছেন রাঙামাটির কুতুকছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে। সুস্মিতা ত্রিপুরা এখানে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। পাহাড়ের জুমচাষী অম্বামণি নিজের ছোট মেয়েকে ছাত্রাবাসে রেখে উচ্চতর পড়াশোনা করানোর পরিকল্পনা রয়েছে। সেজন্য জুমচাষের পাশাপাশি পার্বত্য এলাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন আবাসিক ছাত্রাবাসে নিয়মিত নিয়ে যান।
একই অবস্থা চিত্র রাঙামাটির বরকল উপজেলার সুবলং এর রমেশ চাকমার। নিজের দুই ভাই-বোন এই স্কুল থেকে পড়াশোনা করে মাধ্যমিকে অধ্যয়ন করছে। তার পিতামাতাও রমেশ চাকমাকে এই ছাত্রাবাসে নিয়ে এসেছে দুই বছর আগে। বর্তমানে সে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। রমজানসহ বিভিন্ন সরকারি ছুটিতে বাড়িতে যায়। এছাড়া ছাত্রাবাসে পড়াশোনা করে বড় কিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখে রমেশ চাকমা।
পার্বত্য জেলাগুলোর এসব শিশুরা দুর্গম পাহাড়ি এলাকা থেকে শিক্ষার আলো নিতে শিশু বয়সেই ছাত্রাবাসের থাকছে। কিন্তু প্রশাসনিক দুর্বলতা, অপ্রতুল বরাদ্দ, শিক্ষক সংকট, জরাজীর্ণ অবকাঠামোসহ নানান সংকটে পাহাড়ের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর এসব আশার আলোও আজ ধুঁকে ধুঁকে জ¦লছে। ১৯৮৫ সাল থেকে শুরু হওয়া পার্বত্য এলাকার এসব প্রাথমিক ছাত্রাবাসের অধিকাংশই এখন সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছু কিছু ছাত্রাবাস সরকারি বরাদ্দ পেলেও অনেকগুলোই চলছে জেলা পরিষদ ও অভিভাবকদের দেয়া অর্থে। প্রতিষ্ঠার প্রায় এক দশক হয়ে গেলেও রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির ৫টি ছাত্রাবাস এখনো চালু করতে পারেনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতর। জেলা পরিষদের অর্থে চালু থাকা ছাত্রাবাসগুলোর বিদ্যুৎ বিল ও সংস্কার কার্যক্রমের উদ্যোগ না থাকায় কোন রকমে দিনানিপাত করছে ছাত্রাবাসে থাকা কোমলমতি পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা। তাছাড়া অপর্যাপ্ত খাবার, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের পাশাপাশি অপর্যাপ্ত কর্মচারীর কারণে পরিপূর্ণ প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর শিক্ষার্থীরা।
পাবর্ত্য অঞ্চলের তিন জেলা বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব, অর্থনৈতিক সংকট ও যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রতিকূল পরিবেশের কারণে পাহাড়ি অঞ্চলের বসবাসরত জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষায় প্রবেশের হার দেশের যেকোন অঞ্চলের চেয়ে কম। এসব এলাকায় পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর শিশুদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় নিয়ে আসতে ১৯৮৫ সাল থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়কে আবাসিকে রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই সময়ের মধ্যে ১৯টি ছাত্রাবাস স্থাপিত হলেও অপ্রতুল বরাদ্দ, প্রশাসনিক দুর্বলতায় ছাত্রাবাসগুলোই এখন ধুঁকছে। বরাদ্দ না থাকার কারণে পার্বত্য জেলা পরিষদ, অভিভাবকদের অর্থায়নে কোন রকমে চালু থাকলেও কয়েকটি ছাত্রাবাস পরিচালনায় নিয়োজিত কর্মীরা ২০১৯ সালের নভেম্বর থেকে বেতন ভাতা পাচ্ছে না। আবার অধিকাংশ ছাত্রাবাসের কর্মীদের চাকরি সরকারি রাজস্বভুক্ত না হওয়ায় নিম্নতম বেতনে কাজ করছে। ফলে সংস্কারহীন এসব ছাত্রাবাসের শিক্ষার্থীরা চরম অবহেলা আর ঝুঁকি নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে।
সরেজমিনে পার্বত্য এলাকায় একাধিক প্রাথমিক ছাত্রাবাস পরিদর্শনে দেখা গেছে, কুতুকছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে ভবন রয়েছে ছয়টি। এর মধ্যে মাত্র দুটি ছাত্রাবাসে শিক্ষার্থীরা থাকেন গাদাগাদি করে। অপর তিনটি একতলা টিনশেডের পাকা ঘর দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত। অপর একটি ঘর পরিত্যক্ত হলেও ওখানে শিশুদের প্রার্থনা, খেলাধুলার জন্য ব্যবহার করা হয়। প্রায় দুই একর জমিতে ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রাবাসটির ভবন মেরামতে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে চার লাখ ৮৩৫ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে ৭ জন কর্মচারী নিয়োজিত থাকা কর্মচারীরা সরকারি রাজস্ব খাত থেকে বেতন ভাতা পেলেও ২০১৯ সালের নভেম্বর থেকে বরাদ্দ না থাকায় বেতন পাচ্ছে না। ছাত্রাবাসের ৭৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৮ জন মেয়ে ও ৪৭ জন ছেলে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রাঙামাটি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. খোরশেদ আলম বলেন, রাঙামাটিতে দুর্গম এলাকার শিক্ষার্থীদের জন্য ছয়টি ছাত্রাবাসসহ প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। তবে দুটি ছাত্রাবাস তৈরি হলেও এখনো কার্যক্রম চালু করা যায়নি। চালু থাকা ছাত্রাবাসগুলোর মধ্যে তিনটিতে কর্মচারীরাও সর্বশেষ নভেম্বর থেকে বেতন পাচ্ছে না। আমরা ছাত্রাবাসগুলোর সার্বিক বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার অবহিত করেছি। সরকারি বরাদ্দ পেলে বকেয়া বেতন ভাতা ছাড়াও ছাত্রাবাসগুলোকে আধুনিকায়ন করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে পার্বত্য এলাকার ছাত্রাবাসগুলো সম্পর্কে সার্বিক একটি প্রতিবেদন দেয় প্রাথমিক শিক্ষা চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়। গত ২২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বিভাগের উপ-পরিচালক মো. সুলতান মিয়া স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে ছাত্রাবাসগুলোর করুণ চিত্র উঠে আসে। প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯টির মধ্যে ১৪টি ছাত্রাবাস চালু রয়েছে। চালু এসব ছাত্রাবাস কার্যত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। এর মধ্যে ২০১১-১২ অর্থ বছরে খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠা হলেও খাইÑখরচের বরাদ্দ না থাকায় চালু করা সম্ভব হয়নি। ৮০ জন শিক্ষার্থীর থাকার ব্যবস্থাসম্পন্ন ছাত্রাবাসটি ব্যবহার না হওয়ায় স্থাপিত একতলা ভবন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। একই সময়ে স্থাপিত খাগড়াছড়ির পানছড়ি বাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়, মানিকছড়ির রাজবাড়ী মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস তৈরি হলেও চালু করা সম্ভব হয়নি। অপর দিকে রাঙামাটির লংগদুতে আটরকছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কাউখালীর চেলাছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস দুটি ২০১১ সালের প্রতিষ্ঠিত হয়। ছাত্রাবাস দুটির জন্য প্রতিটিতে পাঁচজন করে কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়েছে এবং কর্মচারীদের বেতনভাতাও (পিইডিপি-৩) দেয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রতিটিতে ৭৫ জন করে শিক্ষার্থীর জন্য খাই-খরচের বরাদ্দ না পাওয়ায় ছাত্রাবাস দুটি এখনো চালু করতে পারেনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর।
বান্দরবান: বান্দরবানের ৭টি আবাসিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মধ্যে ৬টিই জেলা পরিষদ ও অভিভাবকদের অর্থে পরিচালিত হয়। শুধুমাত্র বান্দরবান সদরের বালাঘাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসটি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর থেকে বরাদ্দ প্রাপ্তি সাপেক্ষে জেলা পরিষদ থেকে ৬ জন কর্মচারীর বেতন প্রদান করা হয়। ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ৭৫ শিক্ষার্থী রাখতে সক্ষম এই ছাত্রাবাসটি ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে মেরামতের জন্য ৪ লাখ টাকা দেয়া হলেও এখনো সম্পূর্ণ মেরামত হয়নি। অপর দিকে ২০১৪ সালে চালু হওয়া কালাঘাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাত্রাবাসের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। জেলা পরিষদ সীমিত পরিসরে ৮০ জন শিক্ষার্থীর তিন বেলার আহারের খরচ দিলেও যা শিক্ষার্থীদের জন্য অপর্যাপ্ত। পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকে ২/৩ জন কর্মচারী ছাত্রাবাসটিতে কাজ করলেও যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এছাড়া আলীকদম আদর্শ ছাত্রাবাস, চাম্বি, রোয়াংছড়ি মডেল ছাত্রাবাস, থানচি বাজার ও রুমা বাজার ছাত্রাবাস জেলা পরিষদ ও অভিভাবকদের মাধ্যমে কোন রকমে চালানো হচ্ছে। ২০১৪ সালে থানচি বাজার ও রুমা বাজার ছাত্রাবাস চালু করলে দুর্গম পাহাড়ি এলাকার শিক্ষার্থীদের ভর্তি করতে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হলেও শিক্ষার্থীদের নিয়মিত খাবার সরবরাহের সমস্যায় অনেকেই নিরুৎসাহিত হচ্ছেন বলে মনে করছেন শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তারাও।
খাগড়াছড়ি: খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় ছাত্রাবাসভিত্তিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬টি। তিনটি প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই বন্ধ। ২০১১-১২ অর্থ বছরে নির্মাণ কাজ শেষের পর শিক্ষার্থীদের খাবার ও নিয়মিত পরিচালন খরচের অর্থ বরাদ্দ নিতে না পারায় লক্ষ্মীছড়ি, পানছড়ি ও মানিকছড়ি আবাসিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস তিনটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে ছাত্রাবাস তিনটি চালু হওয়ার আগেই সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়ায় বরাদ্দ চেয়ে চিঠি দিয়েছে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস। এছাড়াও জনবল নিয়োগের মাধ্যমে ছাত্রাবাস তিনটি চালু করতে একাধিক বার পত্র দেয়া হলেও এ বিষয়ে উদাসীন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর। যদিও মহালছড়ি, কাঁঠালতলী ও গুইমারা আবাসিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যাবতীয় খরচ রাজস্ব খাত থেকে বহন করা হচ্ছে। কিন্তু চালু থাকা তিনটি ছাত্রাবাসে কর্মরত কর্মচারীদের চাকরি রাজস্ব খাতভুক্ত না হওয়ায় বরাদ্দ প্রাপ্তি সাপেক্ষে পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকে বহন করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীর তুলনায় নিয়োজিত কর্মচারী কম থাকায় ছাত্রাবাস তিনটির অব্যবস্থাপনা চরম পর্যায়ে রয়েছে।
রাঙামাটি: রাঙামাটিতে ছাত্রাবাস ভিত্তিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬টি। এর মধ্যে দুটি ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠার পর থেকে (২০১১-১২ অর্থবছর) এখনো চালু করতে পারেনি। চালু থাকা দক্ষিণ কুতুকছড়ি, দীঘলছড়ি, পাকুজ্যাছড়ি, চংড়াছড়ি আবাসিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ও নানান সমস্যায় ধুঁকছে। স্কুলগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীর পাশাপাশি প্রতিটিতে ৭৫ জন করে আবাসিক শিক্ষার্থী রয়েছে। কিন্তু দক্ষিণ কুতুকছড়ি, দীঘলছড়ি ও পাকুজ্যাছড়ি ছাত্রাবাসের কর্মীরা গত ৬ মাস ধরে বেতন পাচ্ছে না। এছাড়া ৪টি ছাত্রাবাসের মেরামতে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বরাদ্দ দেয়া হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। ফলে ছাত্রাবাসে থাকা শিক্ষার্থীরা নানান দুর্ভোগের মধ্যে দিনানিপাত করছে।
জানতে চাইলে বান্দরবানের জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) সিদ্দিকুর রহমান বলেন, একটি ভালো উদ্যোগ নিয়েই পার্বত্য এলাকার ছাত্রাবাসগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল। বান্দরবানের সবগুলো ছাত্রাবাসই চালু রয়েছে। দুর্গম এলাকাগুলো থেকে আসা শিক্ষার্থীরা এসব ছাত্রাবাসে থেকে অনেকেই ভালো ফলাফলও করছে। কিন্তু নিয়মিত বিরতিতে ভালো সুযোগ সুবিধা দেয়া না গেলে শিক্ষার আলো বঞ্চিত এলাকাগুলো থেকে শিক্ষার্থী আসবে না। যা পার্বত্য এলাকার মানুষের জন্য অশনি সংকেত বলেই মনে করছেন তিনি।
অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান: পার্বত্য তিন জেলায় চালু থাকা ১৪টি ছাত্রাবাসের শিক্ষার্থীদের থাকার ঘরগুলো অস্বাস্থ্যকর। শিক্ষার্থীদের পয়নিষ্কাষনসহ পড়ার স্থান, খাবার ঘর, বিনোদনসহ বিভিন্ন গৃহের অবস্থা খুবই নাজুক। দীর্ঘদিনের পুরনো একতলা টিনশেডের পাকা ঘরগুলোর অধিকাংশই পরিত্যক্ত। বরাদ্দ না থাকা ও মেরামতের সুযোগ না থাকায় এখনো কিছু কিছু ঘর ঝুঁকি নিয়েই ব্যবহার করছে ছাত্রাবাস কর্তৃপক্ষ। অতিথিশালা না থাকায় শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসা অভিভাবকরা আপদকালীন সময়ে থাকার সুবিধা নেই। ফলে বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে বসবাস করে দুর্গম এলাকা থেকে আসা শিশুরা।
অপুষ্টিকর খাবার: ছাত্রাবাসগুলোতে মূলত দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থীই সবচেয়ে বেশি থাকে। তবে অনেক ছাত্রাবাসের সরকারি বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল। এছাড়া অনেকগুলো ছাত্রাবাসে দরিদ্র অভিভাবকদের বহন করতে হয়। তিন বেলা আহার সরবরাহে দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ দেয়া থাকলেও তদারকির অভাবে অনেক সময় পর্যাপ্ত পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবার পায় না শিক্ষার্থীরা। এসব কারণে ছাত্রাবাসগুলোতে থাকা অধিকাংশ শিক্ষার্থীই অপুষ্টিতে ভুগছে। সরেজমিন পরির্দশনের সময় অনেক শিক্ষার্থীদের মধ্যে চর্মরোগের আধিক্য দেখা গেছে।
ছাত্রাবাস কর্মীদের বেতনহীন কর্মজীবন: ছাত্রাবাসগুলোর প্রতিটিতে ৭৫ থেকে ১০০ জন পর্যন্ত শিক্ষার্থী রয়েছে। কিন্তু এসব ছাত্রাবাসের সর্বোচ্চ জনবল রয়েছে ৭ জন। অধিকাংশ ছাত্রাবাসের কর্মী সংখ্যা ৩ থেকে ৪ জনে সীমিত। এছাড়া প্রায় সিংহভাগ ছাত্রাবাসের নিয়োজিত কর্মীদের চাকরি রাজস্বখাত ভুক্ত নয়, এদের অনেকের বেতন ভাতাও দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। কয়েকটি ছাত্রাবাসের কর্মীদের বেতন-ভাতা রাজস্ব খাত থেকে বরাদ্দ প্রাপ্তি সাপেক্ষে পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকে দেয়া হচ্ছে। বেতন ভাতা ও নিয়োগ সংক্রান্ত জটিলতায় এসব ছাত্রাবাসের কর্মীদের মধ্যেও রয়েছে অসন্তোষ। যা ছাত্রাবাসে থাকা শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত সেবা বঞ্চিত করছে বলে মনে করছেন শিক্ষা কর্মকর্তারাও।
আবাসিক শিক্ষকের অভাব: যেকোন ছাত্রাবাসে আবাসিক শিক্ষক থাকা বাধ্যতামূলক। স্কুলের প্রধান শিক্ষককে ছাত্রাবাসে ২৪ ঘণ্টা অবস্থানের নির্দেশনা থাকলেও অনেকেই থাকেন না। এই দায়িত্ব পালনের জন্য আবাসিক শিক্ষককে মাসে ভাতা দেয়া হয় মাত্র ১০০ টাকা। যা অপ্রতুল হওয়ায় অধিকাংশই ছাত্রাবাসে অবস্থান করেন না। ফলে বেসরকারি পর্যায়ে স্থানীয় কোন শিক্ষক কিংবা কলেজে পড়–য়া শিক্ষার্থী আবাসিক শিক্ষক হিসাবে শিক্ষার্থীদের পড়ানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের পরিবার থেকে দেয়া ন্যুনতম অর্থেই ওই শিক্ষক পুরো ছাত্রাবাসের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা দেখভাল করেন।
পার্বত্য এলাকায় আবাসিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সমস্যা সমাধানে করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর চট্টগ্রাম বিভাগের উপ-পরিচালক মো. সুলতান মিয়া বলেন, পার্বত্য দুর্গম এলাকার শিশুদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা এখনো কষ্টসাধ্য। এজন্য সরকার পার্বত্য এলাকায় আবাসিক প্রাথমিক বিদ্যালয় কার্যক্রম চালু করেছে। কিন্তু পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাবে সবগুলো ছাত্রাবাস ভালোভাবে চালানো সম্ভব হচ্ছে না। স্থানীয় উদ্যোগ ও জেলা পরিষদের সহযোগিতায় কিছু কিছু ছাত্রাবাস চালু থাকলেও নিয়মিত বরাদ্দ প্রাপ্তি ছাড়া সরকারের উদ্যোগটি দীর্ঘ সময় ধরে টিকিয়ে রাখা অসম্ভব বলেই মনে করছেন তিনি।