শুভ্র মিশু ॥
পার্বত্য জেলা রাঙামাটির পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা নিয়ে গল্প প্রায়শই সভা সেমিনারে আলোচনা হয়। মেলে আশ্বাস উন্নয়ন ও পরিবর্তনের। কিন্তু বাস্তবতা হলো এতো বছরেও এগোয়নি এ জেলার পর্যটন। অবকাঠামোগত উন্নয়ন না হওয়ায় আগ্রহ হারাচ্ছে রাঙামাটিতে ঘুরতে আসা পর্যটকরা। কিন্তু কেনো? পর্যটনের উন্নয়নে স্থানীয় উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকারের দায়িত্বশীলরা শুধুমাত্র পরিকল্পনার বৃত্তে আটকে থাকায় কাক্সিক্ষত উন্নয়ন হচ্ছে না এই খাতে, এমন অভিযোগ স্থানীয়দের।
১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ সৃষ্টির পর হ্রদকে পর্যটকবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার জন্য নানান পরিকল্পনা হাতে নেয় সরকার। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৮৩ সালে দুই পাহাড়ের মাঝখানে ঝুলন্ত সেতু তৈরি করে যাত্রা শুরু হয় পর্যটন কর্পোরেশনের। এরপর পর্যটন শিল্প বিকাশে কার্যত আর কোনও সরকারি উদ্যোগ দেখা যায়নি। সেই থেকে একটিমাত্র সেতু দিয়ে চলছে এখানকার পর্যটন ব্যবসা। বর্তমান সময়ে কাপ্তাই হ্রদ ঘিরে কিছু হাউজ বোট ও রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠলেও পর্যটন শিল্পে সরকারি পরিকল্পনা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন না থাকায় তাদেরও পর্যটক সংকটসহ নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় বিভিন্ন সময়। অথচ হ্রদ, পাহাড়ের মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব এখানে। যার মাধ্যমে হতে পারে পাহাড়ের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন।
যুগের সাথে তাল মিলিয়ে রাঙামাটির পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন প্রয়োজন। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন ও উন্নয়ন সংস্থাগুলো এগিয়ে না আসায় এই এলাকার পর্যটন শিল্প বিকশিত হচ্ছে না বলে মনে করেন তরুণ উদ্যোক্তা, পর্যটক, বোট ব্যবসায়ীরা।
কাপ্তাই হ্রদে ভাসমান দোল রেস্টুরেন্ট এর সত্ত্বাধিকারী নুর তালুকদার মুন্না জানান, রাঙামাটির পর্যটন শিল্পের পুরাতন যে চিরায়ত ব্যবস্থা সেগুলো যদি নতুন করে সাজানো যেত, তাহলে পর্যটকদের রাঙামাটি এসে মনভাঙ্গা অবস্থায়, হতাশা নিয়ে রাঙামাটি ত্যাগ করতে হতো না বলে আমি মনে করি।
মুন্সিগঞ্জ থেকে ঘুরতে আসা পর্যটক দেলোয়ার হোসেন জানান, আমি দশবছর আগে পর্যটন ঝুলন্ত ব্রিজে এসে ছিলাম, দশবছর পর এসেও দেখছি একই রকম, নতুন কোন সংযোজন নাই। পাশাপাশি বেলাশেষে সন্ধ্যায় বা দ্বিতীয় দিন যে এখানে সময় কাটাবো তেমন কোন স্পটও নাই। টেলিভিশনে ঝুলন্ত সেতু দেখে যে সুন্দর লাগে বাস্তবতা ভিন্ন। অথচ কাপ্তাই হ্রদ ঘিরে সরকারি আরো পর্যটন স্পট গড়ে তোলাগেলে এখানে প্রচুর পর্যটক আসতো বলে মনে করি।
বোট ব্যবসায়ী রমজান আলী জানান, রাঙামাটি ঝুলন্ত সেতু অন্যতম প্রধান পর্যটন স্পট হওয়া সত্যেও এখানে কোন পাবলিক টয়লেট নাই, পর্যটকরা এসে ভোগান্তিতে পরে। বিশেষ করে নারীরা। রাঙামাটিতে সরকারিভাবে নতুন নতুন পর্যটন স্পট করা গেলে পর্যটক আসার হার আরো অনেকগুণ বাড়তো।
পর্যটন শিল্পের বিকাশে স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থাগুলোর অনেক কিছু করার আছে, যার মাধ্যমে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নও সম্ভব, তার সত্যেও তারা কিছু করছে না এবং ব্যবসায়ীদের কাজ থেকেও কখনো পরামর্শ নেননি বলে অভিযোগ করেছেন আবাসিক হোটেল মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ।
রাঙামাটি আবাসিক হোটেল মালিক সমিতির সভাপতি মঈনুদ্দীন সেলিম জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও পার্বত্য তিন জেলা পরিষদ রয়েছে। রাঙামাটির পার্শ্ববর্তী দুই পার্বত্য জেলায় পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে কাজ করা হলেও রাঙামাটি তার তেমন কোন প্রভাব পড়েনি। রাঙামাটিতে উন্নয়ন সংস্থাগুলোর উন্নয়ন মানে পাহাড়কাটা, জঞ্জাল কাটা। রাঙামাটিতে পর্যটকরা আসলে কাপ্তাই হ্রদ ও যে কয়েকটা স্পট রয়েছে সেগুলো ঘুরে দ্বিতীয় দিন আর কোথাও ঘুরার জায়গা নাই। কিন্তু রাঙামাটি কাপ্তাই হ্রদ, কাট্টলি বিল, কর্ণফূলি নদীর উৎপত্তিস্থলসহ প্রকৃতি রাঙামাটিকে অপার সম্ভাবনা দিয়ে সাজিয়েছে সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে রাঙামাটিকে পর্যটক বান্ধব একটি জেলায় রুপ দেয়া সম্ভব। শহরকে পর্যটনবান্ধব করে সাজানো যায়। বিভিন্ন সময় সভা সেমিনার হয় আলোচনা হয়, কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না। রাঙামাটিকে পর্যটন বান্ধব করে গড়ে তোলা গেলে রাঙামাটিতেই প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ দেশি বিদেশি পর্যটকের ঢল নামবে। যার মাধ্যমে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি এই শিল্প জাতীয় অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখবে। রাঙামাটির পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে আবাসিক হোটেল ব্যবসায়ীদের থেকে কখনো কোন পরামর্শ উন্নয়ন সংস্থাগুলো নেইনি বলেও জানান এই আবাসিক হোটেল ব্যবসায়ী সমিতির নেতা।
অতীতে না নিলেও বর্তমান সময়ে পর্যটন শিল্পের বিকাশে ১২শত কোটি টাকার একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে, যা পাশ হলে রাঙামাটির পর্যটন শিল্পের আমুল পরিবর্তন হবে বলে মনে করছেন রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী জানান, রাঙামাটির পর্যটন খাতকে উন্নয়ন করতে হলে সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোক্তদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারিভাবে পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিতে যেমন মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, তেমনিভাবে আমরা রাঙামাটি পর্যটন শিল্পের বিকাশে একটি ১২শত কোটি টাকার প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। সেটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সেটি গ্রহণ করা হলে রাঙামাটির পর্যটন শিল্পের আমুল পরিবর্তন হবে বলে মনে করি।
তবে যে যাই বলুক না কেনো, বাস্তবতা হলো, পার্বত্য এই জেলার পর্যটন বিকাশে এখনোও সমন্বিত কোন উদ্যোগ দৃশ্যমান নই। কবে হবে তাও জানেন না সংশ্লিষ্টরা। এখনো তাই শুধুই আশাবাদের গল্প।