অপু দত্ত ও শ্যামল রুদ্র
অবশেষে সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে উদ্বোধন করা হলো বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার প্রথম মৈত্রী সেতু-১। মঙ্গলবার দুপুরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে সেতুর উদ্বোধন ঘোষণা করেছেন।
মঙ্গলবার উদ্বোধন হলেও এখনই সেতু দিয়ে দুই দেশের যোগাযোগ শুরু হচ্ছেনা। কারণ পরিপূর্ণভাবে সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হলেও সেতু ঘিরে সড়ক যোগাযোগ, ইমিগ্রেশন, কাস্টমসহ অবকাঠামো এখনো নির্মিত হয়নি। এখনো জমি অধিগ্রহন পর্যায়ে রয়েছে। ‘বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু-১; দিয়ে চট্টগ্রম বন্দর থেকে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় ত্রিপুরা রাজ্যসহ মেঘালয়, আসাম, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং অরুনাচলের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য স¤প্রসারণ হবে। পরিবর্তন হতে পারে আর্থ-সামাজিক অবস্থার।
এদিকে আগাম ঘোষণা ছাড়া সেতুটি উদ্বোধন হওয়ায় কিছুটা হতাশ রামগড়ের স্থানীয়রা। গত ৫ মার্চ পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমেন সেতুটি সরেজমিন পরিদর্শন করেন। তখন সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তিনি আগামী ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সুবর্ণ জয়ন্তীতে অনেকগুলো স্থাপনার সাথে ‘বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু-১’ আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হতে পারে বলে জানিয়েছিলেন। হঠাৎ উদ্বোধনের খবরে স্থানীয়দের মধ্যে নেই উৎসব।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৫ সালের ৬ জুন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী সেতুটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। খাগড়াছড়ির রামগড়ে মহামুনি এলাকায় ৪১২ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৪ দশকি ৮০ মিটার প্রস্থ আন্তর্জাতিক সেতুটি নির্মাণে খরচ হয়েছে ১৩৩ কোটি টাকা। ফেনী নদীর ওপর মূল সেতুটি ১৮০ মিটারের। দুই পারেই থাকছে ৯০ মিটার করে। সেতুর সঙ্গে থাকছে ২৩২ মিটারের সহযোগী সেতু। এ সেতুর মোট পিলার ১২ টি। এরমধ্যে বাংলাদেশ অংশে নির্মাণ ৮টি ও ভারতের অংশে ৪টি।
ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ন্যাশনাল হাইওয়ে ইনফাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন লিমিটেড এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স দীনেশচন্দ্র আর আগরওয়াল ইনফ্রাকম প্রাইভেট লিমিটেডের তত্বাবধানে কাজটি হয়েছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সেতুটির কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে বেশ কয়েকমাস সেতু নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকায় পুরো কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি। সবশেষ চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি সেতুটির কাজ শেষ হয়।
স্থলবন্দর চালু হলে পশ্চাৎপদ পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি-বাঙালি সকল জনগোষ্ঠীর ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে বলে আশা স্থানীয়দের। এখানকার মানুষের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নতি হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন শিল্পের জন্যও স্থলবন্দর হবে গেটওয়ে।
রামগড়ের স্থানীয় সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন লাভলু জানান, মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে আশ্রয়, খাদ্য বস্ত্র আর যুদ্ধে সহায়তা দিয়ে ত্রিপুরাবাসীর সঙ্গে আমাদের আত্মার সম্পর্ক হয়। এখন ফেনী নদীর ওপর ভারত সরকারের নির্মিত বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু-১ হবে ত্রিপুরাবাসীর সাথে আমাদের অর্থনৈতিক সেতুবন্ধন। আমরা আশা করি রামগড়-সাব্রুম একটি পুর্নাঙ্গ স্থলবন্দর হবে। এতে অনেকাংশে দুদেশের মধ্যে আমদানি-রফতানি বাড়বে।
এদিকে এ মৈত্রী সেতুকে কেন্দ্র করে রামগড়-হেঁয়াকো-বারৈয়ারহাট প্রধান সড়ক প্রশস্তকরনের অনুমোদন দিয়েছেন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। রামগড় পৌর মেয়র কাজী মো.শাহজাহান রিপন জানান, স্থল বন্দর চালু হলে রামগড়সহ পুরো জেলার দৃশ্যপট পাল্টে যাবে। রামগড় পৌরসভার রাজস্ব আয় বাড়বে। এছাড়াও স্থানীয়দের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে আমি বিশ^াস করি। রামগড় স্থলবন্দরের অবস্থানগত সুবিধা কাজে লাগানো গেলে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সর্ম্পক সুদৃৃঢ় হবে বলে মনে করেন সংশি¬ষ্টরা।
খাগড়াছড়ির বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সুদর্শন দত্ত ও অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরী মনে করেন, অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে রামগড়-সাব্রুম স্থল বন্দর অবশেষে আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে অবশ্যই তা একটি ইতিবাচক খবর। একটা সময় ধরেই নেওয়া হয়েছিল এটা বোধহয় আর হচ্ছে না। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষের আগ্রহ এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতায় সফলতার দিকে এগুচ্ছে রামগড়-সাব্রু, স্থল বন্দরের অগ্রযাত্রা। পার্বত্য চট্রগ্রামে প্রথম স্থাপিত এই বন্দরের বিশাল কর্মযজ্ঞ এ সব দরিদ্র মানুষের মুক্তির নতুন দিগন্ত উম্মোচন করবে বলে তাঁরা মনে করেন। এ বন্দর দু’দেশের মানুষের জন্যই হবে আর্শীবাদ স্বরুপ। এই বিশ্বায়নের যুগে কোন দেশ কিংবা একই দেশের সব অঞ্চল কোন বিশেষ পণ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ না-ও হতে পারে। প্রাকৃতিক ও বৈষয়িক সুবিধা, উৎপাদনে বিশেষজ্ঞতা ও শ্রম বিভাগের কারণে উৎপাদিত পণ্য পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে আদানÑপ্রদানের বিষয়টি স্বাভাবিক নিয়মেই হয়।
রামগড় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বিশ্ব প্রদীপ কুমার কারবারী ও রামগড় বাজারের ব্যবসায়ী তাপস বিশ্বাসের ভাষ্যমতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সহজ যোগাযোগ স্থাপনে ফেনী নদীর ওপর সেতু নির্মাণে ভারত দীর্ঘদিন ধরেই সচেষ্ট ছিল। এটা সম্ভব হওয়ায় ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো ত্রিপুরা, মেঘালয়,আসাম,মনিপুর মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং অরুনাচল (সেভেন সিস্টার্স) চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আনতে সক্ষম হবে বলে মনে করেন দুদেশেরই ব্যবসায়ীরা। খাগড়াছড়িসহ চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যেই রামগড় স্থল বন্দরের অগ্রগতি বিষয়ে খোঁজখবর রাখছেন; সরেজমিন পরিদর্শনও করেছেন অনেকে। রামগড় স্থল বন্দর চালু হলে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রেই অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটবে, পুরো এলাকার চেহারাটাই পাল্টে যাবে বলে মনে করেন তাঁরা।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কংজুরী চৌধুরী বলেন, রামগড়েই চালু হবে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা। দীর্ঘদিন ধীরগতিতে কাজ চললেও স¤প্রতি ভারত-বাংলাদেশ উভয় পক্ষ ত্বরিত গতিতে স্থলবন্দর বাস্তবায়নের কাজ শুরু করায় ব্যবসায়ীসহ সকল মহল আশার আলো দেখছেন। সব মিলিয়ে রামগড় স্থল বন্দর পূর্নাঙ্গভাবে চালু হলে বিশ্বায়নের এই যুগে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার পাশাপাশি বিপুল জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে যে বিশাল ভূমিকা রাখবে নিশ্চিত ভাবেই তা বলা যায়। আর যোগাযোগের ক্ষেত্রে সূচিত হবে এক নতুন দিগন্তের। আঞ্চলিক গ-ি ছাপিয়ে এ যেন বিশ্বব্যাপি সেতুবন্ধনের এক পূর্বাভাস।