খাদিজা আক্তার
ভাদ্র-আশ্বিন দুই মাস মিলে শরৎকাল। নানা উৎসবের আগমনীবার্তা এবং প্রকৃতিকে নতুনরুপে সাজিয়ে আমাদের মাঝে উপস্থিত হয় ঋতুরানী শরৎ। ধুয়ে মুছে নতুন সাজে সজ্জিত হয় প্রকৃতি। কখনো পরিষ্কার নীল আকাশে ভেসে বেড়ায় সাদা মেঘের ভেলা, কখনো বা কালোমেঘে ঢেকে আসে বৃষ্টি। শিশিরভেজা শিউলি, দূর্বাঘাস প্রকৃতিতে ছড়ায় স্নিগ্ধতা, মোহিত করে সবকিছুই। নদীর কিনারায় কাশফুল, শাপলা, শালুক, পদ্মে ভরে উঠে পুকুর জলাশয় এবং রাস্তার ধারে পর্যটন কেন্দ্রসহ পাহাড়ে পাহাড়ে ফুটতে থাকে শিউলি, জবা, জুই, কেয়া, কামিনী, মালতি, জারুল, নয়নতারা, বেলি, দোলনচাপাসহ নানা ফুল। পাকা তালের মিস্টি গন্ধে মৌ মৌ করে চারপাশ। এছাড়াও শরতে আমলকি, জলপাই, জগডুমুর, করমচা, চালতা, ডেউয়া ফল পাওয়া যায়। শরৎকালের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে বাংলার প্রায় সকল কবিই লিখেছেন কবিতা, গান, রম্য রচনা।
জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম শরতের সৌন্দর্য্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাঁর কাব্যে লিখেছেন-
“সই পাতাল কি শরতে আজিকে স্নিগ্ধ আকাশ ধরণী?
নীলিমা বাহিয়া সওগাত নিয়া নামিছে মেঘের তরণী!
অলকার পানে বলাকা ছুটিছে মেঘ-দূত-মন মোহিয়া
চঞ্চুতে রাঙা কলমির কুঁড়ি-মরতের ভেট বহিয়া।
সখীর গাঁয়ের সেঁউতি-বোঁটার ফিরোজায় রেঙে পেশোয়াজ
আশমানি আর মৃন্ময়ী সখী মিশিয়াছে মেঠো পথ-মাঝ।”
শরতে প্রতিটা সকাল পাহাড়ে এক অভূতপূর্ণ আন্দন অনুভূতি নিয়ে আসে। সূর্য্য উদিত হয়ে মাঠের ধান ও পাহাড়ে জুম ফসলের জমিতে আলোক রশ্মি ছড়ায়। জুমের নতুন ধানের পিঠা, পুলিতে আনন্দে ভরপুর থাকে কৃষকের মন। নীল আকাশের বুকে ভেসে থাকা মেঘ যেনো সাদা কার্পেট বিছানো। মাথার উপর মাঝে মাঝে উড়ে যায় সাদাবক, শালিক ও টিয়া পাখির ঝাক। পুকুরের কলকল পানিতে দোল খায় শাপলা,শালুক, পদ্ম।
পাহাড়ে শরৎ মানেই ভিন্ন মাত্রার আগমনীবার্তা। চারপাশ পরিস্কার যতদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। বড় বড় গাছের ফাকে দোল খায় জুমের ফসল। পাহাড়ের গায়ে রোপিত জুম হতে ফসল উত্তোলনের ধুম পড়ে। উৎপাদিত হয় ধান, ভুট্টা, তিল, কুমড়া, কাচা মরিচ, মারফাসহ নানা জাতীয় ফসল। বলা যায় পাহাড়ের সৌন্দর্য্য শরতে বহুগুন বেড়ে যায়। পাখিদের কলকাকলিতে ভরে থাকে চারপাশ। নানা জাতীয় ফুল ফলে পাহাড় নতুন এক রুপে সজ্জিত হয়। সকালের উদিতসূর্য্য রশ্মি পাহাড়ে যেমন অদ্ভুত রকম সৌন্দর্য্যে সবাইকে মোহিত করে তদ্রুপ পাহাড়ের কোলে ঢলে পড়া অস্তগামী সূর্য্যের লাল আভা পুরো পাহাড়ি অঞ্চলকে ধুসর আলোয় আলোকিত করে আমন্ত্রন জানায় রাতের অন্ধকারকে।
সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত উপভোগ করার জন্য আমরা সাগর কিংবা দ্বীপকে প্রাধান্য দিলেও শরতের সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত উপভোগে পাহাড়ের জুড়ি নেই।
শরতে পূর্ণিমারাত পুরো পাহাড় জুড়েই জোছনায় ছেয়ে ফেলে। জোছনার আলোয় স্পষ্ট দেখা যায় উঁচু উঁচু দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়। থেমে থেমে ডেকে উঠে ঝিঁঝিঁ পোকা ও পাখিদের দল। শরৎকাল প্রকৃতি অত্যন্ত লাবণ্যময়ী ও বৈচিত্রময়ী যা কলমের কালিতে পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা দেয়া কঠিন কেবল নিজ চোখেই উপভোগ করা যায়।