অর্ণব মল্লিক, কাপ্তাই
রাঙামাটি পার্বত্য জেলার কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনা ইউনিয়নে অবস্থিত কর্ণফুলী পেপার মিলস আবাসিক এলাকা। যেই এলাকায় রয়েছে একটি ঐতিহ্যবাহী জামে মসজিদ। মসজিদটি স্থানীয়দের কাছে এলাকার ‘বড় মসজিদ’ হিসেবে একনামে পরিচিত। তবে এই মসজিদটি কেবল কেপিএম এলাকা কিংবা কাপ্তাইয়ের মধ্যেই সুপরিচিত নয়, বরং সারাদেশেই স্তম্ভবিহীন নান্দনিক মসজিদ হিসেবে এর খ্যাতি রয়েছে। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতার আগে প্রতিষ্ঠিত এই নয়নাভিরাম মসজিদটি অদ্যবদি অনেক ইতিহাস ও ঐতিহ্য লালন করে আসছে।
মসজিদ পরিচালনা কমিটির তথ্যমতে, ১৯৬৭ সালে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা শ্রমিক ও কর্মচারীদের সুবিধার্থে কর্ণফুলী পেপার মিলস আবাসিক এলাকার অভ্যন্তরে এটি নির্মাণ করা হয়। এর আগে ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানের দাউদ গ্রæপ কর্ণফুলী পেপার মিলস এর দায়িত্ব নেওয়ার পর মসজিদটি স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এবং ১৯৬৭ সালের ৮ ডিসেম্বর তৎকালীন দাউদ গ্রæপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান আহমেদ দাউদ এইচ কে এই মসজিদটির ভিত্তি স্থাপন করেন। ১৩ হাজার বর্গফুটের এই মসজিদে একসঙ্গে প্রায় চার হাজার মুসুল্লি নামাজ আদায় করতে পারে।
এছাড়া নান্দনিক এই মসজিদটির কিছু আকর্ষণীয় স্থাপনা রয়েছে যেগুলো মানুষকে মুগ্ধ করেছে। বিশেষ করে মসজিদটির নির্মাণশৈলীতে মুসলিম ঐহিত্যের বিভিন্ন নিদর্শন রয়েছে। এবং সবচেয়ে আকর্ষনীয় বিষয় হচ্ছে মসজিদের চার দেয়াল ছাড়া মাঝে আর কোন স্তম্ভ নেই। স্তম্ভবিহীন এই নান্দনিক মসজিদের ভেতর কাঠের ফ্রেমের ওপর হার্ডবোর্ড দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে সিলিং। মসজিদে বারান্দাসহ ১৭টি কাতার আছে। প্রতিটি কাতারে অনায়াসে দাঁড়াতে পারেন ১শত ২০ জন মুসুল্লি। বিশাল এই মসজিদে দৃষ্টিনন্দন প্রায় ৩৮টি বাতি রয়েছে। এছাড়া মসজিদের তিন পাশে রয়েছে ২৩টি জানালা, ৯টি দরজা। সেইসাথে মসজিদের উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব দিক দিয়ে প্রবেশপথ রয়েছে। মসজিদটির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্তম্ভ না থাকার কারণে মসজিদে মুসুল্লিরা যেখানেই দাঁড়ান না কেন প্রত্যেকেই খতিব কিংবা ইমামকে দেখতে পান। আর মসজিদটি অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ বেষ্টিত এলাকায় স্থাপিত হওয়ার ফলে মসজিদের ভেতরটা প্রায়সময় বেশ শীতল থাকে।
এদিকে কেপিএম এলাকার স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দার সাথে কথা বলে জানা যায়, মসজিদটি নির্মাণে ব্যবহৃত সামগ্রীগুলো তৎকালীন করাচি থেকে আনা হয়েছিলো। পুরো এক বছর লেগেছে এই মসজিদের নির্মাণ কাজ শেষ করতে। এছাড়া স্থানীয়রা আরো জানান, একসময় কর্ণফুলী পেপার মিলস যখন সোনালী দিন পার করছিলো তখন প্রায় প্রতিদিনই প্রচুর মানুষের উপস্থিতিতে এই মসজিদটি মুখরিত থাকতো। তবে বর্তমানে কালের বির্বতনে মসজিদটি হারিয়েছে জৌলুস। এখন কর্ণফুলী পেপার মিলস এলাকায় বাসিন্দা যেমন অধিকাংশ কমে এসেছে। তেমনি এর প্রভাব পড়েছে মসজিদেও। বর্তমানে কেবল শুক্রবারেই বেশ কিছু মানুষের সমাগম হয়ে থাকে। সম্প্রতি মসজিদটি পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, বর্তমানে বয়সের ভাড়ে মসজিদের দেওয়ালের বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে। সেইসাথে বর্ষার সময় বৃষ্টির পানির ঢোকে ভিতরে। কোথাও কোথাও ঝরে পড়েছে সিলিং। মসজিদটির দ্রæত সংস্কারের দাবি জানালেন স্থানীয়রা।
মসজিদের ইমাম মো. এটিএম আব্দুল্লাহ জানান, আমি দীর্ঘ বছর ধরে এই মসজিদের ইমামতি করছি। মসজিদটির দীর্ঘদিন সংষ্কার না হওয়ায় ছাদ ও জানালা দিয়ে পানি ঢোকে। তবে ইতিমধ্যে এলাকার কিছু সহৃয়বান ব্যক্তি এবং সরকারি সহযোগিতায় মসজিদের বাউন্ডারি ওয়ালের কিছু দৃষ্টিনন্দন কাজ করা হয়েছে। এছাড়া বাকি সমস্যগুলো দ্রæত প্রশাসনিকভাবে সমাধানের আহ্বান জানাচ্ছি।
মসজিদে নিয়মিত নামাজ পড়তে আসেন স্থানীয় বাসিন্দা মো. আবুল বাশার, মো. রহমান আলী, আব্দুর সালাম। তারা সকলেই জানান, একসময় এলাকার এই মসজিদে প্রতিদিনই অনেক মানুষের উপস্থিতিতে নামাজ আদায় করা হতো এবং এটি অনেক আনন্দের ছিলো। কিন্তু বর্তমানে এলাকায় মানুষ অনেক কমে গেছে। যার ফলে আগের মতো তেমন মানুষ হয় না। এছাড়া মসজিদটি রক্ষা করার জন্য দ্রæত সংস্কার প্রয়োজন বলে তারা জানান।
মসজিদ পরিচালনা কমিটির সদস্য আব্দুল আজিজ ভুইয়ার সাথে এবিষয়ে কথা হলে তিনি জানান, কাপ্তাইয়ের চন্দ্রঘোনায় অবস্থিত এই কেপিএম জামে মসজিদটি এতদাঞ্চলে একটি দীর্ঘ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী মসজিদ হিসেবে বেশ সুপরিচিত। তবে বর্তমানে মসজিদটি বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত হয়েছে। বিশেষ করে মসজিদের দেওয়ালে ফাটল দেখা দেওয়া সহ, বৃষ্টির পানি ঢুকে মসজিদের ভিতরে। এইসকল সমস্যা সমাধান এবং মসজিদ সংস্কারের জন্য আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছি।
এদিকে ঐতিহ্যবাহী স্তম্ভবিহীন এই মসজিদটির মৌলিকতা ধরে রেখে সংস্কার ও মসজিদটিকে প্রতœতাত্তিক নিদর্শন হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার দাবি জানিয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাসহ সকলেই।