জয়নাল আবেদীন, কাউখালী
রাঙামাটি জেলার কাউখালী উপজেলার ১০১ নং ঘিলাছড়ি মৌজা। যেখানে পাহাড়ি বাঙালি উভয় সম্প্রদায়ের লোক বসবাস করে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পাহাড়ি পরিবারের বসবাস হলেও বাঙালি প্রায় ১৫০ টি পরিবার বসবাস করে এই মৌজার ঘিলাছড়ি ও মিয়াপাড়া এলাকায়। আর এই ১৫০ পরিবারের প্রায় ৩০০ একর জমির খাজনা ১২ বছর ধরে না নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ঘিলাছড়ি মৌজার হেডম্যান পুষ্পল কুসুম তালুকদারের বিরুদ্ধে। খাজনা না নেওয়ার কথাও স্বীকার করেছেন তিনি।
ফলে দীর্ঘদিন খাজনা দিতে না পেরে নানাবিদ সমস্যায় পড়েছে ১৫০টি পরিবার। রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে রাষ্ট্র। ভূমি হারানোর সঙ্কার কথা জানিয়েছেন পরিবার গুলো।
উপজেলার ঘাগড়া ইউয়িনয়নের ১০১ নং ঘিলাছড়ি মৌজাস্থ ৪নং ওয়ার্ডের ঘিলাছড়ি ও মিয়াপাড়া এলাকা ঘুরে ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে অনুসন্ধানে জানাযায়- ১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালে ততকালীন সরকার দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভুমিহীনদের স্থানান্তার করে পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় বসবাসের ব্যবস্থা করে দেয়। প্রতি পরিবারেকে দেওয়া হয় পাহাড়ও সমতল ভূমি। তারই সূত্রধরে ঘিলাছড়ি ও মিয়া পাড়ায় ১৫০টিরও অধিক পরিবার বসবাস করছে দীর্ঘ বছর ধরে।
বিপত্তি বাধে ২০১১ সাল থেকে। ২০১১ সালের ২৫ এপ্রিল পিতার স্থলে হেডম্যান হিসেবে নিয়োগ পাওয়া পুষ্পল নিয়োগের পর থেকে হঠাতই বাঙালী ১৫০ এর অধিক পরিবারের রেকর্ডভূক্ত জমির খাজনা নেওয়া বন্ধ করে দেয়। ততসময়ে খাজনা রশিদ দিয়ে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সেবা পাওয়ার বাধ্য বাধকতা না থাকায় খুব একটা সমস্যার মুখে পড়তে হয়নি পরিবার গুলোকে। কিন্তু বর্তমানে জমির খাজনা দিতে না পারায়, খাজনা রশিদের অভাবে ব্যাংক ঋণ, জমি ক্রয়/বিক্রয় সহ নানা জটিলতায় পড়তে হচ্ছে পরিবারগুলোকে। এমনকি হেডম্যান রিপোর্ট না পাওয়ায় ওয়ারিশন সূত্রে পৈত্রিক সম্পত্তি থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে অনেক পরিবার।
অনুসন্ধানে জানাযায়, পিতার স্থলে ২০১১ সালে ১০১ নং ঘিলাছড়ি মৌজার হেডম্যান হিসেবে নিয়োগ পায় পুষ্পল কুসুম তালুকদার। নিয়োগের পর থেকেই অজ্ঞাত কারণে বাঙালী পরিবারগুলোর খাজনা আদায় বন্ধ করে দেয়। পরের বছর ২০১২ সালে খাজনা প্রদান, জমি বিক্রয়ের মিউটেশনে সুপারিশ না দেওয়ার অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসক বরাবরে গণ স্বাক্ষর নিয়ে অভিযোগ দেয় ভুক্তভোগীরা। অভিযোগের প্রেক্ষিতে ২০১২ সালের ১৩ ডিসেম্বর তৎকালীন রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসনের রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর কে এম সালাহউদ্দিন ভুক্তভোগীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে খাজনা আদায় ও জমি ক্রয়/বিক্রয়ের আবেদনে সুপারিশ প্রদানে অনিহা মৌজা হেডম্যান কার্যক্রমের পরিপন্থী উল্লেখ করে ২৭ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখের মধ্যে জবাব দাখিলের জন্য নির্দেশ দেন।
একই বিষয়ে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে তৎকালীন জেলা প্রশাসনের রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর এ এস এম রিয়াদ হাসান গৌরব উভয় পক্ষকে শুনানীর জন্য নোটিশ জারি করেন।
এই চিঠির পর শুনানীর জন্য ধার্য্যকৃত তারিখে জেলা প্রশাসক বরাবরে লিখিত জবাব দেন হেডম্যান পুষ্পল। তাতে তিনি লিখেন তার নিয়োগ পাওয়ার পূর্বে ২০০৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক সর্বশেষ তিন পার্বত্য জেলার ভূমি বন্দোবস্ত ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত নির্দেশনা থাকায় খাজনা আদায় থেকে বিরত আছে।
সেখানে তিনি আরও লিখেন ভুক্তোভোগীদের পার্বত্য অঞ্চলের আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুসরণ না করে মৌজা হেডম্যান এর সুপারিশ ব্যতীত বন্দোবস্ত প্রদান করা হয়েছে।
২০১৩ সালের ১০ জানুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক অস্থায়ী/অ-উপজাতীদের নিকট হতে বিতর্কিত/বিধি বহিভূতভাবে বন্দোবস্তকৃত জমির মিউটেশনসহ খাজনা/কর আদায় স্থগিত রাখার অনুরোধ জানিয়ে সচিব, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, তিন পার্বত্য জেলার জেলা প্রশাসক’কে পাঠানো চিঠিকে মিউটেশনসহ খাজনা আদায় স্থগিত রাখার নির্দেশনা উল্লেখ করে মিউটেশনের সুপারিশ প্রদানসহ খাজনা কর আদায় করা সম্ভব নয় বলে উল্লেখ করেন।
অথচ হেডম্যানদের নিয়ন্ত্রনকারী কর্তৃপক্ষ উপজেলা ও জেলা প্রশাসন থেকে এধরনের খাজনা আদায় বা মিউটেশনে সুপারিশ না করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়নি বলে অনুসন্ধানে জানাগেছে।
এছাড়ও উপজেলার অন্যান্য সকল হেডম্যান নিয়মিত ভাবেই পাহাড়ী বাঙালী উভয়ের কাছ থেকে খাজনা আদায় করছেন। দিচ্ছেন মিউটেশন সহ বিভিন্ন বিষয়ে সুপারিশও। ২০১১ সালে হেডম্যান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পূর্বে পুষ্পল এর পিতা নিয়মিতই বাঙালীদের খাজনা আদায় ও জমি ক্রয়/বিক্রয়ের মিউটেশন আবেদনে সুপারিশ করতেন বলে জানিয়েছিলেন ভুক্তোভোগীরা।
ঘিলাছড়ি ও মিয়াপাড়া এলাকার সমাজ কমিটির সভাপতি ও উপজেলা আওয়ামীলীগের উপজেলা কমিটির সদস্য মজিবর রহমান ও সমাজ কমিটির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন ও স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জানান- হেডম্যান কোন সুযোগ সুবিধা দিচ্ছেনা। ১০/১২ বছর আগে বাপ মারা গেলেও বাবার নামে থাকা জায়গা এখনো নিজেদের নামে আনতে পারি নাই। হেডম্যানের সাথে বহুবার আলাপ করছি। হেডম্যান সাফ জানিয়ে দেয় তার পক্ষে হেডম্যান রিপোর্ট দেওয়া সম্ভব না। খাজনা দিতে চাইলে তাও নেয়না। বলে যে আঞ্চলিক পরিষদের সমস্যা, এই সেই বিভিন্ন অজুহাত দেখায়। পাহাড়ীদের কাছ থেকে খাজনা নেয় অথচ বাঙালীদের কাছ থেকে নেয়না। পুষ্পলের পিতা দায়িত্বথাকালীন বাঙালীর খাজনা নিতেন। পুষ্পল দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে সে সব বন্ধ করে দিছে।
এবিষয়ে বক্তব্যের জন্য ১০১ নং ঘিলাছড়ি মৌজার হেডম্যান পুষ্পল কুসুম তালুকদার জানান- আঞ্চলিক পরিষদ হচ্ছে সরকারের একটা অংশ, ওটাতো সরকারের সাথে কানেকটেড, আমাদেরকে (পার্বত্য জেলার সকল হেডম্যানদের) ওখান থেকে একটা নির্দেশনা দিয়েছিলো, যেগুলা ঝামেলা নাই ওগুলাতো নিচ্ছি, যেগুলা ঝামেলা আছে ওগুলা আপাতত রাখতেছি (নিচ্ছিনা) আরকি। সকল হেডম্যানদের আঞ্চলিক পরিষদের এমন নির্দেশনা দিয়ে থাকে তবে কাউখালী উপজেলার অন্যান্য হেডম্যানরা কিভাবে খাজনা নিচ্ছে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে রাঙামাটি সদরের শুকরছড়ি মৌজা সহ আরও কয়েকটি উপজেলায় এরকম হচ্ছে বলে জানান তিনি। এসময় তিনি জানান, তাদের কাছ থেকে খাজনা না নিলেও তার পকেট থেকে সরকারকে খাজনা পরিশোধ করছেন তিনি। তিনি আরও বলেন আমি ডিসি স্যারকে বলছিতো, মোস্তাফা কামাল স্যারকে বলছি, আর মামুনুর রশিদ স্যারকে বলছি। স্যার আপনারা, রাজা বাবু আর আঞ্চলিক পরিষদ সহ তিন জনে বসে আমাকে একটা সমাধা দিয়ে দেন। ওনারা তো ডাকেন নাই।’
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার সৈয়দা সাদিয়া নূরীয়া জানান, বিষয়টি আমি জানার পর (প্রতিবেদকের কাছ থেকে তিনি বিষয়টি অবগত হয়েছিলেন) হেডম্যান কে ডেকে কথা বলেছি, উনি বলছেন যাদের ডকুমেন্ট আছে তাদের ব্যাপারে ওনি দেখবেন। তারপরও যদি কারও কোন অভিযোগ থাকে লিখিত অভিযোগ দিক, আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নিবো। আমরা লিখিত অভিযোগ পাই নাই, লিখিত অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নিবো।