নিজস্ব প্রতিবেদক
বেইনঘর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে রাঙামাটির রাজবন বিহারে শুরু হয়েছে দুই দিনব্যাপী ৪৮তম দানোত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব। রাঙামাটির রাজবিহারের চীবর দান উৎসবই পার্বত্যাঞ্চলে বৌদ্ধদের বৃহত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব। এই উৎসবে দেশ বিদেশের লাখো পুণ্যার্থী অংশ নেয়। বৃহস্পতিবার বিকেলে রাঙামাটি রাজবন বিহারের উপাসক-উপাসিকা পরিষদের সভাপতি গৌতম দেওয়ান ও অন্যান্য সদস্যবৃন্দ ফিতা কেটে বেইনঘর উদ্বোধন করেন। পাশাপাশি বেগম রোকেয়া পদক প্রাপ্ত রাঙামাটির নারী উদ্যেক্তা মিসেস মঞ্জুলিকা খীসা চরকায় সুতা কেটে চীবর বুননের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ধর্মীয় দেশনা প্রদান করেন রাজবন বিহারের আবাসিক প্রধান শ্রীমৎ প্রজ্ঞালঙ্কার মহাস্থবির। পরে আবাসিক ভান্তেরা বেইনঘর প্রদক্ষিণ করেন এবং চীবর বুননে অংশ নেয়া পুণ্যার্থীদের আশীর্বাদ করেন।
উদ্বোধনের পর রাঙামাটি রাজ বনবিহার উপাসক-উপাসিকা কার্যনির্বাহী পরিষদের সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, রাঙামাটি রাজবন বিহারের এই কঠিন চীবর দানোৎসবটি তিন পার্বত্য জেলার সবচেয়ে বড় কঠিন চীবর দানোৎসব। পাহাড়ের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং পাহাড়ী জনগোষ্ঠী এই কঠিন চীবর দানের জন্য সারাবছর অপেক্ষা করে থাকেন। এই রাজবনবিহারের উৎসবটি ছাড়াও রাজবন বিহারের অর্ন্তগত আরো অনেকগুলো বিহারে দানোৎসব হয়। তবে এটি সবচেয়ে বড়। রাঙামাটি জেলার পাশাপাশি অন্যান্য অনেক জেলা থেকে ২৪ ঘন্টায় চীবর তৈরি করে সেটি দান করার এই প্রথায় অংশ নেয়ার জন্য অনেকেই এসেছেন। তাদের আমি ধন্যবাদ জানাই এবং পাশাপাশি এই পূণ্যানুষ্ঠানের মাধ্যমে বিশে^র মঙ্গল ও শান্তি কামনা করি।
রাঙামাটি রাজ বনবিহার উপাসক-উপাসিকা কার্যনির্বাহী পরিষদের সহ-সভাপতি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের সদস্য নিরুপা দেওয়ান বলেন, বৌদ্ধ ধর্মীয় নিয়ম ও নীতি অনুযায়ী এই কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠানটা হয়। আষাঢ়ি পূর্ণিমার তিনমাস পর প্রবারণার পূর্ণিমার পরপরই এই চীবর দান অনুষ্ঠানটা হয়। ভগবান গৌতম বুদ্ধের উপাসিকা বিশাখা ভগবানের কাপড় ছেড়া দেখতে পেয়ে এক রাতের মধ্যে তুলা থেকে সুতা, সুতা থেকে চীবর তৈরি করে ভগবান বুদ্ধকে দান করেন। সেই থেকে বিশাখা প্রবর্তিত এই সংস্কৃতি চলে আসছে।
রাঙামাটি রাজবন বিহার উপাসক-উপাসিকা পরিষদের সুত্রে জানা গেছে- এ বছর প্রতিবেশীদেশ ভারতের মহারাষ্ট্র থেকে ৭৬জন পুণ্যার্থী রাঙামাটি রাজবন বিহারের ৪৮তম দানোত্তম কঠিন চীবর দানানুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করছেন। রাজবন বিহারের ভিক্ষুসংঘ ও উপাসক-উপাসিকা পরিষদের আমন্ত্রণে তারা আসছেন।
রাঙামাটি রাজবন বিহার উপাসক-উপাসিকা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অমিয় খীসা বলেন- বৃহস্পতিবার বিকেলে পঞ্চশীল গ্রহণের পর বেইনঘর উদ্বোধনের মধ্যে দিয়ে ৪৮তম দনোত্তম কঠিন চীবর দানোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। বেইনঘর উদ্বোধন করেন রাঙামাটি রাজবন বিহারের আবাসিক প্রধান শ্রীমৎ প্রজ্ঞালংকার মহাথেরো। এবারের কঠিন চীবর প্রস্তুত করার জন্য ২০৫টি বেইন বুনা হচ্ছে। প্রতিটি বেইনে ৪জন বেইনকর্মী বুনন কাজ করবেন। অনুষ্ঠানে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে ৫ শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক নিয়োজিত রয়েছে।
২৪ ঘন্টার মধ্যে তুলা থেকে সুতা বের করে সেই সুতা রং করে শুকিয়ে কাপড় বুনে তা ভিক্ষুদের পরিধেয় বস্ত্রে পরিণত করে ভিক্ষুসংঘকে দান করা হয়। শুক্রবার সকালে মুল অনুষ্ঠানের আগে প্রথমপর্বে সংঘদান,অষ্ট পরিষ্কার দান, সদ্ধর্ম দেশনা ও ভিক্ষুসংঘকে পিন্ডদানের পর দুপুরে কঠিন চীবর ও কল্পতরু শোভাযাত্রা শুরু হবে। বেইনঘর থেকে কঠিন চীবর ও কল্পতরু শোভাযাত্রা শুরু করে বিহার এলাকা প্রদক্ষিণ করে রাজবন বিশ^শান্তি প্যাগোডার পাশে বড় মাঠে অনুষ্ঠান মঞ্চে নিয়ে আসা হবে। অনুষ্ঠানে কঠিন চীবরটির সঙ্গে বুদ্ধমুর্তি দান, অষ্ট পরিষ্কার দান, কল্পতরু দান, রাজবন বিশ^ শান্তি প্যাগোডা নির্মাণে টাকাসহ বিভিন্ন দানীয় সামগ্রী দান করবেন পুণ্যার্থীরা। এছাড়া থাকবে ভিক্ষুসংঘের সদ্ধর্ম দেশনা, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও অতিথিদের ধর্মীয় ভাষণ।
রাঙামাটি রাজবন বিহার সুত্র জানায়- রাঙামাটি রাজবন বিহারে এবছর কঠিন চীবর দানোৎসবে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩ লক্ষ টাকা। কঠিন চীবর দানোৎসব উদযাপন উপলক্ষে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ৩ লক্ষ টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে। বাকী টাকা পুণ্যার্থীদের শ্রদ্ধাদান থেকে আসে।
অনুষ্ঠানের সার্বিক শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে পুলিশের অস্থায়ী কন্ট্রোল রুম বসানো হয়েছে রাজবন বিহারের উপাসক-উপাসিকা পরিষদের কার্যালয়ের পাশে। রাঙামাটি কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অরিফুল আমিন বলেন- কঠিন চীবর দানানুষ্ঠানের নিরাপত্তা ও শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় ৩’শ পুলিশ মোতায়েন থাকবে। পাশাপাশি সাদা পোশাকে আমাদে লোকজন ডিউটি করবে। অন্যান্য বছরের চাইতে এবছর যাতে আরো বেশি সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা যায় সেটা আমরা দেখছি। বিহার কম্পাউন্ডের বাইরে সড়কের আশেপাশে, চলাচল রাস্তার ধারে যাতে কোন ধরণের মেলা, অস্থায়ী দোকানপাট বসানো না হয় সেজন্য লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব দনোত্তম কঠিন চীবর দান শুরু হয় প্রবারণা পূর্ণিমার পর থেকেই। মাসব্যাপী বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহারে চলে কঠিন চীবর দান। এবছর কঠিন চীবর দানোৎসব শুরু হয়েছে ২৬ অক্টোবর থেকে। শেষ হবে আগামী ২৬ নভেম্বর। আড়াই হাজার বছর আগে গৌতম বুদ্ধ জীবিতকালে তারই এক অনুসারী মহা উপাসিকা বিশাখা ২৪ ঘন্টার মধ্যে তুলা থেকে সুতা বের করে কাপড় তৈরি করে তা থেকে ভিক্ষুদের পরিধেয় বস্ত্র চীবর প্রস্তুত করে দান করেন। এ দানের ফল কখনো ক্ষয় হয় না শীলাখন্ড বা পাথরের চেয়েও কঠিন বলে বৌদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থে উল্লেখ আছে। এ কারণে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা এ দানের নাম দিয়েছেন কঠিন চীবর দান।
পার্বত্য চট্টগ্রামের কিংবদন্তী বৌদ্ধ সাধক মহাত্যাগী শ্রীমৎ সাধনানন্দ মহাথেরো বনভান্তে ১৯৭৪ সালে রাঙামাটির লংগদু উপজেলার তিনটিলা এলাকার শ্রদ্ধাবান দায়ক-দায়িকা ও উপাসক-উপাসিকাদের দিয়ে দানোত্তম কঠিন চীবর দানানুষ্ঠানের পুনঃপ্রবর্তন করান। তখন থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে দানোত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে পালন করে আসছেন পাহাড়ের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা।