সুহৃদ সুপান্থ
আয়তনে দেশের সবচে বড় সংসদীয় আসন ২৯৯,রাঙামাটি পার্বত্য জেলা। পুরো জেলা মিলেই একটি আসন। পাহাড়ের রাজধানীখ্যাত এই জেলায় ভোটেও বৈচিত্র্য বিপুল। নানান জাতিগোষ্ঠির মানুষের ভোটেই নির্বাচিত হয় সংসদ সদস্য। তবে এই জেলায় স্বাধীনতার পর গত ৫৪ বছরে অনুষ্ঠিত বারোটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কোনটিতেই জয় পায়নি কোন বাঙালী। এবারও তার ব্যতিক্রম হওয়ার ন্যূনতম সম্ভাবনা নেই। বড় দলগুলোর পাহাড়ী প্রার্থীরাই ভোটের মাঠ যেমন মাতাবে, তেমনি ভোটেও থাকবে তাদের বিপুল সম্ভাবনা। তবে আওয়ামীলীগহীন ভোটের মাঠে বিএনপিকে ছেড়ে কথা কইবেনা আঞ্চলিক দল জনসংহতি সমিতিও। যদিও আদৌ তারা ভোট করবে কিনা তা নিশ্চিত নয় এখনো। রূঢ় বাস্তবতা হলো,সর্বশেষ তিনটি নির্বাচনে সারাদেশে ভোট যেমনই হোক না কেনো, পার্বত্য রাঙামাটিতে আওয়ামীলীগকে লড়াই করেই জিততে হয়েছে। এমনকি ২০১৪ সালে সারাদেশে আওয়ামীলীগের ভূমিধ্বস জয়ের মধ্যেও এই আসনে হেরেছে আওয়ামীলীগ ! এবারও ভোটের মাঠে জাতীয় দলগুলোকে একচুলও ছেড়ে কথা বলবে না আঞ্চলিক দলগুলো, সেটা নিশ্চিত। এবং আঞ্চলিক দলগুলোর সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনার উপরই নির্ভর করছে জাতীয় দলগুলোর জয় পরাজয়।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি
আওয়ামীলীগের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই আসনে বিএনপি সর্বশেষ ২০০১ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলো,তাও একেবারেই নিজস্ব কাউকে দিয়ে নয়,ভোটের আগে উড়িয়ে আনা সাবেক পৌর চেয়ারম্যান ও উপজেলা চেয়ারম্যান মনিস্বপন দেওয়ানের উপর ভর করেই। এবার বহুবছর পর ভোটের মাঠে আবারো জয়ের বেশ ভালো সম্ভাবনার সামনেই দাঁড়িয়ে দলটি। এবার দলের মনোনয়ন চাওয়ার দৌড়ে আছেন সাবেক উপমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য মনিস্বপন দেওয়ান, সাবেক জেলা বিএনপির সভাপতি ও বর্তমানে কেন্দ্রীয় কমিটির সহ ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট দীপেন দেওয়ান,কেন্দ্রীয় কমিটির আরেক নেতা লে:কর্ণেল (অব) মনীষ দেওয়ান, জেলা বিএনপির সভাপতি দীপন তালুকদার দীপু। এদের চারজনের যেকেউ মনোনয়ন পেতে পারেন, নানা বিবেচনায়। দলের ভেতরে বাহিরে সবখানেই বেশ প্রভাব আছে চারজনেরই। মনিস্বপন দেওয়ানের দলের বাহিরেও আছে বেশ শক্ত সামাজিক ভীত,একইসাথে ক্যারিশম্যাটিক ও অনলবর্ষী বক্তা হিসেবেও আছে তার সুখ্যাতি। আবার নানা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ততা এবং স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে ব্যক্তি ইমেজেই বারবার নির্বাচিত হওয়ায় তার প্রতি দলের উচ্চ মহলের পৃথক সংবেদনশীলতাও আছে। সেই বিবেচনায় তিনি হতে পারেন প্রথম পছন্দ। তবে ২০০৬ সালে সরকারি চাকুরি ছেড়ে রাজনীতিতে আসা দীপেন দেওয়ান সেইবার সরকারি চাকুরিবিধির কারণে মনোনয়ন বঞ্চিত হলে দল মনোনয়ন দেয় তার স্ত্রীকে। তিনি পরাজিতও হন। বিএনপি পরে ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিলেও তবে দীপেন দেওয়ান পরে আর কখনই মনোনয়ন পান নাই। সেই নির্বাচনেও মনোনয়ন পান মনিস্বপন দেওয়ান। সেই কারণে এবার মনোনয়ন দৌড়ে বেশ ভালোভাবেই ফ্রন্টলাইনে আছেন দীপেন দেওয়ান। শারীরিক অসুস্থতাকে যদি জয় করতে পারেন, এবারকার মনোনয়ন পাওয়ার বেশ ভালো সম্ভাবনাই আছে তার। দলের একটি বড় অংশ তাকে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চাইছেন এবার।
মনোনয়ন চাইবেন কেন্দ্রীয় নেতা মনীষ দেওয়ান। সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা ব্যক্তিগতজীবনে বেশ সজ্জন ও বিনয়ী মানুষ হিসেবে পরিচিত। আবার বেগম খালেদা জিয়ার ভাই মরহুম সাঈদ ইস্কান্দার এর ঘনিষ্ঠজন হিসেবেও জিয়া পরিবারের সিম্বেথি পাবেন হয়ত। স্থানীয় রাজনীতিতে খুব বেশি উপস্থিত না থাকলেও নেতাকর্মীদের সাথে আছে তার ভালো সখ্যতা। সাবেক সেনা কর্মকর্তা হিসেবেও বিএনপির একটি অংশের সমর্থন পাবেন তিনি। ফলে তিনি মনোনয়ন পেলেও অবাক হওয়ার কিছু নাই।
তবে সবাইকে ছাড়িয়ে হঠাৎ করেই ভীষণ সিরিয়াস হয়ে উঠেছেন জেলা বিএনপির সভাপতি দীপন তালুকদার দীপু। নিজেকে প্রার্থী হিসেবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন,করছেন প্রচুর পরিশ্রমও। প্রায় প্রতিদিনই জেলা উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন সাংগঠনিক কাজে। সাথে পাচ্ছেন জেলা বিএনপির সাধারন সম্পাদক,বিশ^স্তজনক অ্যাডভোকেট মামুনুর রশীদ মামুনকে। প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে বাকিদের বেশ চ্যালেঞ্জেই ফেলে দিয়েছেন দীপন।
এই চারজনের বাহিরেও কেউ কেউ হয়ত মনোনয়ন চাইবেন,কিন্তু তারা কারা সেই সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা মিলছে না। প্রার্থীরা বা তাদের সমর্থকরা কেউই মুখ খুলছেন না। পরিস্থিতির উপরই যেনো নজর তাদের।
রাঙামাটি জেলা বিএনপির সাধারন সম্পাদক অ্যাডভোকেট মামুনুর রশীদ মামুন বলছেন, যেহেতু আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সম্ভাব্য একটি সময় পাওয়া গেছে,তাই আমরা মাঠ গোছানোর কাজ করছি,প্রায় প্রতিদিনই আয়তনে দেশের সবচে বড় এই সংসদীয় আসনের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে সংগঠনের শক্তিশালী ভীতকে প্রস্তুতি করছি আমরা।’ তবে এবার জয়ের ব্যাপারে আশাবাদের কথা জানিয়ে তিনি বলছেন, ২০০১ সালের পর এবার গনতান্ত্রিক পরিবেশে ভোট দেয়ার যে সুযোগ তৈরি হয়েছে তাতে জয়ের ব্যাপারে আমরা ভীষণ আশাবাদী।’
ইতোমধ্যেই তারেক জিয়ার সাথে অনলাইনে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে অংশ নিয়েছেন মনোনয়ন প্রার্থীরা। মনোনয়ন পাওয়ার দৌড়ে নিজ নিজ নেতার ব্যাপারে ‘শতভাগ আশাবাদী’ কর্মী সমর্থকরা। নেতারাও ভেতরে যতই টেনশন থাকুক,বাইরে ঠিকই ফুরফুরে মেজাজ ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। দেখাচ্ছেন-‘আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ’। কিন্তু বাস্তবতা বলছে বহু কথাই,যার উত্তর হয়ত মিলবে প্রার্থী ঘোষণার পর।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি
১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা গেরিলা সংগঠন শান্তিবাহিনীর রাজনৈতিক শাখা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ২০০১ সালের নির্বাচন বর্জন করলেও ২০০৮ থেকে নিয়মিত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আসছে স্বতন্ত্র পরিচয়ে। এর মধ্যে ২০১৪ সালে বিজয়ীও হয় তারা। এবার প্রার্থী দিবে কিনা সেই সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত করছে না দলটির কোন সূত্র। প্রতিবারই দলের সহসভাপতি ঊষাতন তালুকদারকে প্রার্থী করা দলটি এবার তাকেই প্রার্থী করবে কিনা, কিংবা নতুন কাউকে মাঠে নামাবে কিনা,সেই সম্পর্কেও কিছুই বলছে না। অথচ তাদের ভোটে অংশগ্রহণের উপরই নির্ভর করছে ভোটের ফলাফল। তবে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, ঊষাতন তালুকদার অথবা গৌতম চাকমা হতে পারেন জনসংহতি সমিতির প্রার্থী। তবে দলের বাহিরে গিয়ে পাহাড়ী সুশীল সমাজ থেকেও প্রার্থী করতে পারে দলটি। সেইক্ষেত্রে হয়ত কোন চমকই দেখাবে দলটি। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত না হওয়ায় দলটির সমর্থিত প্রার্থীরা স্বতন্ত্র পরিচয়েই নির্বাচন করে থাকে। তবে কি করবেন, সেই বিষয়ে এখনই কথা বলতে নারাজ দলটি। তবে সবচে কঠিন সত্য হলো, এই দলটির নির্বাচনে অংশ নেয়ার উপরই নির্ভর করছে এই আসনের ফলাফল !
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী
১৯৯১ সালে সর্বশেষ এই জেলা থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়া দলটি প্রায় ৩৫ বছর পর এই আসনে নির্বাচনে করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইতোমধ্যেই দলটি প্রবীন আইনজীবি অ্যাডভোকেট মোখতার আহমেদকে প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করেছে। নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ হিসেবে জেলা উপজেলায় প্রায় প্রতিনিয়তই নানান সামাজিক রাজনৈতিক কাজে অংশ নিচ্ছেন তিনি। ভোটের পুরো মুডেই আছে দলটি। তবে এইখানে জামায়াতের ফিক্সড ভোট আর বাঙালী প্রার্থী ইমেজকে ব্যবহার করে কিছু ভোট হয়ত বেশি পাবে দলটি,কিন্তু তা জয়ের জন্য খুব বেশ যথেষ্ট হবেনা মোটেও। ফলে তাদের প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা ভীষণ কঠিন এখানে। যদিও দেশের বর্তমান পরিবর্তিত বাস্তবতায় জামায়াতের ভোট সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া কঠিন বৈকি।
ইউপিডিএফ
কখনো না ভোট,কখনো স্বতন্ত্র পরিচয়ে ভোট,কখনো বর্জন নানাভাবেই জাতীয় নির্বাচনে থাকা ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এবারও ভোটের মাঠে থাকার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু কিভাবে থাকবে,কোন পরিচয়ে সেটা স্পষ্টতর হবে ভোট যত কাছে আসবে,ততই। দলটির প্রধান প্রসীত বিকাশ খীসা,সংগঠক সচিব চাকমা কিংবা আলোচিত নেতা মাইকেল চাকমা এইখানে প্রার্থী হতে পারেন বলে ইঙ্গিত দিচ্ছে দলটির সাথে সংশ্লিষ্ট অসমর্থিত নানা সূত্র। তবে দলের পক্ষ থেকে এখনই নির্বাচনের বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ মুখপাত্ররা। তারা বলছেন, আগে নির্বাচনের তফশিল ঘোষিত হোক,তারপর দেখবেন সব। তবে নির্বাচনে থাকুক বা না থাকুক, রাঙামাটির অন্তত চারটি উপজেলার ভোটে বেশ প্রভাবই ফেলবে দলটি।
জাতীয় পার্টি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ
সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রার্থী হয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী। খুব বেশি ভোট পায়নি দলটি, এখানে ভোটের মাঠে তাদের প্রভাবও নেই ততটা। একই অবস্থা জাতীয় পার্টিরও। এই দল দুটি এবার প্রার্থী দিবে কিনা কিংবা দিলেও কাকে দিবে সেই সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা মিলছেনা এখনই।
জাতীয় নাগরিক পার্টি
দেশে এখন বেশ জোয়ার চলছে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি’র। দলটির রাঙামাটিতে আহ্বায়ক কমিটিও গঠিত হয়েছে। তবে আহ্বায়ক কমিটিতে নেই সিনিয়র কোন সিটিজেন বা সর্বজনগ্রাহ্য কেউ। ফলে দলটির প্রার্থী হিসেবে কে মাঠে থাকবেন সেটি স্পষ্ট বোঝাও যাচ্ছেনা। এনিয়ে এখনো কোন ভাবনা হয়নি বলে জানাচ্ছেন দলটির নেতারা। দলের আহ্বায়ক বিপিন জ্যোতি চাকমা বলছেন, আমরা এখনো কোন সিদ্ধান্ত নিইনি,সময় হোক,তখন সিদ্ধান্ত নিব।’
জাতীয় ও আঞ্চলিক দলগুলোর বাহিরে অন্য কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হবে কিনা সেই সম্পর্কেও কোন কিছুর আঁচ পাওয়া যাচ্ছেনা এখনো। হয়ত সময়ের সাথে সাথেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হবে সবকিছুই। সেই জন্য অপেক্ষাই করতে হবে আরো বেশ কিছু সময়। তবে যদি আঞ্চলিক দলগুলোর কেউ একটি প্রার্থী দেয়,তবে ভোটের হিসাব হবে এক, আর যদি প্রার্থী নাই দেয়,তাহলে ভোট হবে একদম একচেটিয়া, এবং সেখানে বিএনপির জয় শুধুই সময়ের অপেক্ষামাত্র !

